ইউক্রেইন যুদ্ধ পর্যবেক্ষণরত চীন উদ্বিগ্ন মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র, স্যাটেলাইট নিয়ে

এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাত নিয়ে পরিকল্পনায় ইউক্রেইনে রাশিয়ার যুদ্ধ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন চীন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2023, 09:46 AM
Updated : 8 March 2023, 09:46 AM

চীনা সামরিক গবেষকদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায় পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে থাকা স্টারলিংক স্যাটেলাইট গুলি করে নামানো এবং কাঁধে রেখে ছোড়া যায় এমন জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্র থেকে ট্যাংক ও হেলিকপ্টার রক্ষায় চীনের সক্ষমতা অর্জন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার উঠে এসেছে।

এ গবেষকরা এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাত নিয়ে পরিকল্পনায় ইউক্রেইনে রাশিয়ার যুদ্ধ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।

তাইওয়ানে কোনো যুদ্ধ হলে সেখানে চীনা বাহিনীর বিরুদ্ধে যেসব অস্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতে পারে সেগুলোর প্রভাব যাচাইয়ে চীনের সমগ্র সমরখাতের চেষ্টা ও উদ্যোগের বিষয়টি প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ২০টি জার্নালে প্রকাশিত শতাধিক নিবন্ধ পর্যালোচনা করে উদ্ধার করতে পেরেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

এক প্রতিবেদনে রয়টার্স জানিয়েছে, চীনাভাষার এসব জার্নালে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্র মালিকানাধীন অস্ত্র উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ও সামরিক গোয়েন্দা থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের শত শত গবেষকের কাজের প্রতিফলন দেখা গেছে, এসব জার্নালে এমনকী ইউক্রেইনের নাশকতামূলক কার্যক্রমের খুঁটিনাটি নিয়েও আলোচনা আছে।

শান্তি ও আলোচনার আহ্বান জানানো চীনা কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে ইউক্রেইনের যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে রাশিয়ার দক্ষতা বা অর্জন নিয়ে খোলামেলা কিছু না বললেও জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত জার্নালের নিবন্ধগুলোতে মস্কোর খামতি নিয়ে চাঁচাছোলা পর্যালোচনা ঠিকই দেখা যাচ্ছে বলে পর্যবেক্ষণ বার্তা সংস্থাটির।

এসব নিবন্ধে গবেষকরা যা যা বলছেন, সে প্রসঙ্গে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য জানতে চেয়ে রয়টার্স তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা তাতে সাড়া দেয়নি।

গবেষকদের সেসব পর্যালোচনা ও ধারণার সঙ্গে চীনের সামরিক নেতৃত্বের চিন্তার মিল কতখানি আছে সংবাদমাধ্যমটি তাও জানতে পারেনি। 

চীনের প্রতিরক্ষা গবেষণাগুলো সম্বন্ধে অবগত দুই সামরিক অ্যাটাসে ও এক কূটনীতিক বলেছেন, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনই গবেষণার পরিমাণ ও দিক নির্দেশনা ঠিক করে দেয় এবং এখন যে পরিমাণ গবেষণা দেখা যাচ্ছে, তাতে এটা পরিষ্কার যে, ইউক্রেইন যুদ্ধের সুযোগ কাজে লাগাতে চীনের সামরিক নেতৃত্ব মুখিয়েই আছে।

এই তিনজন এবং অন্য যে কূটনীতিকরা রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেছেন, নিজেদের কাজ নিয়ে প্রকাশ্যে বলার মতো দায়িত্বপ্রাপ্ত না হওয়ায় তারা কেউই পরিচয় প্রকাশে রাজি হননি।

মার্কিন এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, তাইওয়ানের পরিস্থিতির সঙ্গে ভিন্নতা থাকলেও ইউক্রেইন যুদ্ধ চীনকে খুঁটিনাটি অনেক কিছু বোঝার সুযোগ করে দিচ্ছে।

“ইউক্রেইনে রাশিয়ার হামলার পর দ্রুতগতিতে দেওয়া আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া থেকে বিশ্বের এই মূল শিক্ষাটা নেওয়া দরকার যে, আগ্রাসন ক্রমাগত ঐক্যবদ্ধ পাল্টা কর্মকাণ্ডের মুখোমুখি হবে,” বলেছেন তিনি।

বিষয়টির সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নিজের পরিচয় প্রকাশে রাজি হননি এ মার্কিন কর্মকর্তা। সুনির্দিষ্ট মার্কিন সক্ষমতা নিয়ে চীনা গবেষণা নিয়ে বাড়তে থাকা উদ্বেগ প্রসঙ্গেও তিনি কিছু বলেননি।  

চোখধাঁধানো স্টারলিংক

পিএলএ-র গবেষকদের আধডজন নিবন্ধে ইউক্রেইনের বিদ্যুৎখাত সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলোতে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্যেও ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনীর ভেতরকার যোগাযোগ সুনিশ্চিত রাখতে স্টারলিংক স্যাটেলাইটের ভূমিকা নিয়ে চীনের উদ্বেগের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

ইলন মাস্কের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মহাকাশ অভিযান বিষয়ক কোম্পানি স্পেসএক্স এই স্টারলিংক স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক বানিয়েছে।

“রাশিয়া-ইউক্রেইন সংঘাতে স্টারলিংক স্যাটেলাইটের অসাধারণ কর্মক্ষমতার কারণে এশিয়ায় সম্ভাব্য যে কোনো যুদ্ধবিগ্রহে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোকে বিস্তৃতভাবে স্টারলিংক ব্যবহারের দিকে নিয়ে যাবে,” বলা হয়েছে সেপ্টেম্বরের এক নিবন্ধে, যার অন্যতম লেখক ছিলেন পিএলএ-র আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির গবেষকরা।

ওই নিবন্ধের লেখকরা স্টারলিংককে নিস্ক্রিয় করতে বা গুলি করে নামিয়ে ফেলার পথ বের করা যে চীনের জন্য ‘খুবই জরুরি’, সে বিষয়ে তাগাদা দিয়েছেন। চীন নিজেও কাছাকাছি ধরনের একটি স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক বানানোর লক্ষ্যে কাজ করছে।

এই প্রসঙ্গে মন্তব্য চেয়ে স্পেসএক্সের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।

ইউক্রেইন-রাশিয়া সংঘাত চীনের গবেষকদের ড্রোন যুদ্ধের জন্য যে প্রচুর বিনিয়োগ দরকার, সে বিষয়ে আপাত ঐকমত্যে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।

চীন তাইওয়ানের আশপাশের আকাশে নিজেদের ড্রোনের পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বশাসিত দ্বীপটিকে নিজেদের কব্জায় নিতে বেইজিং সম্প্রতি তাদের তৎপরতাও বাড়িয়েছে।

“এসব মনুষ্যবিহীন উড়ন্ত যান ভবিষ্যৎ যুদ্ধে ‘দরজায় লাথি মারার’ ভূমিকা পালন করবে,” বলা হয়েছে পিএলএ-র অস্ত্র সরবরাহকারী, রাষ্ট্র-মালিকানাধীন অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি নরিনকোর প্রকাশিত ট্যাংক ওয়ারফেয়ার জার্নালের এক নিবন্ধে।

রয়টার্স যেসব জার্নাল পর্যালোচনা করেছে তার মধ্যে কিছু প্রাদেশিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বের হলেও অন্যগুলো অস্ত্র উৎপাদন ও সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন দেখভালকারী স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ফর ন্যাশনাল ডিফেন্সের মতো কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাধীন বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব প্রকাশনা।

অ্যাডমিনিস্ট্রেশনটির অক্টোবরের নিজস্ব প্রকাশনায় থাকা এক নিবন্ধে ইউক্রেইনীয় যোদ্ধাদের ছোড়া জ্যাভেলিন ও স্টিংগার ক্ষেপণাস্ত্রে ‘রাশিয়ার ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও যুদ্ধজাহাজের মারাত্মক ক্ষতি বিবেচনায়’ নিজেদের সামরিক সরঞ্জাম সুরক্ষার সক্ষমতা বাড়াতে চীনকে জোর দিতে বলা হয়।

সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের নিরাপত্তা ফেলো কলিন কোহ বলছেন, ইউক্রেইন সংঘাত চীনের সামরিক বিজ্ঞানীদের সাইবার যুদ্ধ মডেল ও অত্যাধুনিক পশ্চিমা সরঞ্জাম থেকে নিজেদের সাঁজোয়া যানকে ভালোভাবে রক্ষার পথ বের করার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় গতি দিয়েছে।

“সত্যিকার অর্থেই স্টারলিংক নতুন একটা কিছু, যা তাদের উদ্বিগ্ন করেছে; সামরিক বাহিনী কাজে লাগাতে পারবে এমন অত্যাধুনিক বেসামরিক প্রযুক্তিকে সহজে নকল করতে পারবে না তারা,” বলেছেন তিনি।

প্রযুক্তি ছাড়াও, চীন যে রাশিয়ার ভেতরে ইউক্রেইনের বিশেষ বাহিনীর নাশকতামূলক অভিযান নিয়েও গবেষণা চালাচ্ছে তা তাকে বিস্মিত করছে না বলেও জানিয়েছেন কোহ।

কেননা, রাশিয়ার মতো চীনও তাদের বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র রেলপথেই পরিবহনে অভ্যস্ত, যেখানে নাশকতার ঝুঁকি তুলনামূলক বেশিই, বলছেন তিনি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন তাদের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের গতি বাড়ালেও পিএলএ-র সমর অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। শেষ তারা বড় যুদ্ধে জড়িয়েছিল ভিয়েতনামে ১৯৭৯ সালে।

চীনা জার্নালগুলো নিয়ে রয়টার্সের পর্যালোচনা এমন সময়ে হল যখন ইউক্রেইন যুদ্ধে রাশিয়াকে সহায়তার জন্য বেইজিং মারণাস্ত্র দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে পশ্চিমা দেশগুলো প্রবলভাবে উদ্বিগ্ন।

চীন অবশ্য শুরু থেকেই এই উদ্বেগকে অমূলক বলে উড়িয়ে দিয়ে আসছে।

আরও পড়ুন:

Also Read: নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে হামলায় ‘জড়িত ইউক্রেইনপন্থি গোষ্ঠী’