গবেষকরা বলছেন, ‘সবচেয়ে স্বর্গীয় এ সংবেদনের’ উৎপত্তির ইতিহাস প্রোথিত আছে মানব সভ্যতা ও তার বিবর্তনের গভীরে।
Published : 07 Mar 2024, 11:34 AM
“ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁটের মিলন হল সবচেয়ে নিখুঁত, সবচেয়ে স্বর্গীয় সংবেদন, যা মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে সুখের সর্বোচ্চ সীমায়।”
উনিশ শতকের ফরাসি লেখক গি দ্য মপাসাঁ ১৮৮২ সালে তার ছোট গল্প ‘দ্য কিস’-এ চুম্বনকে এভাবেই বর্ণনা করেছেন।
চুমু নিয়ে এমন পুষ্পশোভিত কল্পনা মপাসাঁ কেবল একা করেননি। যুগে যুগে অসংখ্য গান, কবিতা, গল্পে, চলচ্চিত্র আর শিল্পে গাওয়া হয়েছে প্রেম চুম্বনের জয়গান।
সিএনএন এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ঠোঁটে ঠোঁটে যোগাযোগ যে প্রেম ও কাম প্রকাশের উত্তম মাধ্যম, সেটা মানুষ কবে থেকে বুঝতে শুরু করল, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
তবে ২০২৩ সালের মে মাসে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, মনুষ্য সমাজে চুম্বনের আদিমতম যে নমুনা বিজ্ঞানীরা ইতিহাসে পেয়েছেন, সেটা অন্তত সাড়ে ৪ হাজার বছর আগের।
ওই গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক, কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসিরিওলজির সহকারী অধ্যাপক ড. ট্রোয়েলস প্যাঙ্ক আরবোল বলেন, “আমরা যেটা ধারণা করতে পারি, তার চেয়ে ঢের আগে থেকে হয়ত মানুষের অভ্যাসে চুমুর অস্তিত্ব রয়েছে।”
মেসোপটেমিয়া সভ্যতার হাজার হাজার মাটির ফলক এখনও টিকে আছে, সেখানেও রোমান্টিক ঘনিষ্ঠতার অনুষঙ্গ হিসেবে চুম্বনের ব্যবহার পাওয়া যায়।
ব্লুমিংটনের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার স্টাডিজের অধ্যাপক ড. জাস্টিন আর গার্সিয়া সিএনএনকে বলেন, “মানুষের সামাজিক আচরণের যে ধরন, তার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে রোমান্টিক এবং যৌন অভিজ্ঞতার প্রভাব। এসব আচরণ কীভাবে প্রকাশ, বিবর্তিত এবং বিকশিত হয়েছে, তা বুঝতে পারলে আমাদের বর্তমান অবস্থানকে ভালোভাবে বুঝতে পারব।”
মপাসাঁ যখন প্রেমময় চুম্বন নিয়ে হৃদয়ছোঁয়া বর্ণনা দিয়েছিলেন, তিনি তখন অতীতের বিভিন্ন সভ্যতার মানুষের মধ্যে চুম্বন অভ্যাসের উৎপত্তি নিয়ে অত বেশি মাথা ঘামাতে যাননি সম্ভবত।
তবে গবেষকরা বলছেন, ‘সবচেয়ে স্বর্গীয় এ সংবেদনের’ উৎপত্তির ইতিহাস প্রোথিত আছে মানব সভ্যতা ও তার বিবর্তনের গভীরে। প্রাচীন সংস্কৃতিতে এর ভূমিকা ও তাৎপর্য সম্পর্কে অনেক কিছুই হয়ত আজকের মানুষের জানার বাকি।
প্রেম চুম্বন, কাম চুম্বন
আগে বলা হত, মানুষের লেখা নথিপত্রের মধ্যে চুমুর প্রাচীনতম বিবরণটি লিপিবদ্ধ আছে ভারতে হিন্দুদের আদিগ্রন্থ বেদে। সেটা খ্রিস্টের জন্মের হাজার দেড়েক বছর আগের কথা। সে সময় মানুষ কীভাবে ঠোঁটে ঠোঁট মেলাত, তার বিবরণ পাওয়া যায় ঋক বেদের একটি অংশে।
কাম চুম্বনের বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে প্রাচীন ভারতের আরেক শাস্ত্র ‘কামসূত্রে’। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে মল্লনাগ বাৎসায়ন রচিত ওই গ্রন্থকে বলা যায় মানুষের ইন্দ্রিয়সুখের এক বিস্তারিত কলা শাস্ত্র। সে কারণে আধুনিক পণ্ডিতদের অনেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, রোমান্টিক চুমুর সূচনা সম্ভবত ভারতেই হয়েছিল।
তবে ড. ট্রোয়েলস প্যাঙ্ক আরবোল সিএনএনকে বলেছেন, অ্যাসিরিওলজিস্টদের (প্রাচীন নিকটপ্রাচ্য বিষয়ের বিশেষজ্ঞ) মধ্যে এ ধারণা প্রচলিত ছিল যে, ওই এলাকায় পাওয়া মৃত্তিকা ফলকগুলোতে যে সময়ের চুম্বনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে, তা ভারতে বর্ণিত চুমুর চেয়েও আগের। অবশ্য বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদের ক্ষুদ্র বলয়ের বাইরে খুব কম লোকই এসব প্রমাণের বিষয়ে জানত।
আরবোল এবং তার সহ গবেষক, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের রিসার্চ ফেলো ডা. সোফি লুন্ড রাসমুসেন তাদের গবেষণা নিবন্ধে লিখেছেন, খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের মেসোপটেমিয়ান মৃত্তিকা ফলকেও তারা খোদাই করা চুমুর গল্প পেয়েছেন।
একজন অ্যাসিরিওলজিস্ট হিসেবে আরবোলকে কিউনিফর্মে (বিশ্বের প্রাচীন লিপিগুলোর মধ্যে অন্যতম) লেখা বহু লিপি পড়তে হয়েছে। নলখাগড়ার অগ্রভাগ ত্রিকোণাকৃতিতে কেটে কাঁচা মাটির ফলকে ঠেসে ঠেসে সেসব কিউনিফর্মে লেখা হত। ওই কৌশল আবিষ্কার হয়েছিল ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বে।
আরবোল বলেন, প্রথম দিকে কিউনিফর্ম ব্যবহার করা হত হিসাব রাখার কাজে। তবে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দ বা তারও আগে মানুষ দেবতাদের নিয়ে লেখা গল্প কিউনিফর্মে লিপিবদ্ধ করা শুরু করে।
“এরকমই একটি পৌরাণিক কাহিনীতে আমরা বর্ণনা পাই, দেবতারা প্রথমে সহবাস করলেন এবং পরে একে অপরকে চুম্বন করলেন। এটা প্রেমময় চুম্বনের স্পষ্ট প্রমাণ।”
পরের কয়েকশ বছরে মেসোপটেমিয়াজুড়ে লেখার চল অনেক বিস্তৃতি পায়। আর তার ফলে মাটির ফলকে খোদাই করা গল্পগুলোতে উঠে আসতে থাকে দৈনন্দিন জীবনের কথা। সেখানে বিবাহিত যুগলের চুমু বিনিময়ের কথা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে কামনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অবিবাহিতদের চুম্বনের গল্প।
এসব গল্পের কোনো কোনোটায় চুমুর বিপদের কথা জানিয়ে সতর্কও করা হয়েছে। সে সময় বিশ্বাস করা হত, কুমারী থাকার প্রতিজ্ঞা করা কোনো যাজিকাকে যদি কেউ চুমু খায়, সে বাকশক্তি হারাবে।
আরবোল বলেন, সে সময় রাস্তায় চুমু খাওয়া নিষেধ ছিল। সে বিষয়ে সতর্কবাণী এসেছে কোনো কোনো লেখায়। তাতে এটা স্পষ্ট হয় যে তখন চুম্বন ছিল মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাসের অংশ। তবে প্রকাশ্যে না করে আড়ালে তার চর্চা করায় সম্মতি দিত তখনকার সমাজ।
কথা নয়, শুধু চুমু
আটলান্টার এমোরি ইউনিভার্সিটির প্রাইমেটোলজিস্ট ফ্রান্স বি এম ডি ওয়াল লিখেছেন, কেবল মানুষই একমাত্র প্রাণী নয়, যারা চুমু খায়। আমাদের আদিম আত্মীয়দের মধ্যে শিম্পাঞ্জিরও ওই অভ্যাস আছে। আর বোনোবো শিম্পাঞ্জিদের তো চুম্বন নিয়মিত যৌনতারই একটি অংশ; তাতে জিভের ব্যবহারও আছে।
আরবোল ও রাসমুসেন তাদের গবেষণা প্রবন্ধে লিখেছেন, হয়ত সম্ভাব্য সঙ্গীর সক্ষমতা যাচাই এবং প্রজননের জন্য কতটা মানানসই তা বোঝার একটি উপায় হিসেবে প্রাইমেটদের যৌন আচরণে চুম্বনের আবির্ভাব হয়েছিল। চুম্বনে লালা এবং প্রশ্বাসের মাধ্যমে দুজনের দেহে তথ্য আদান প্রদান এবং বোঝাপড়ার বিষয়টি ঘটত।
অবশ্য চুমুর গল্পের পুরোটাই উপভোগ্য নয়। এর মাধ্যমে সংক্রামক রোগের ভয়ংকর বিস্তার ঘটার ইতিহাসও আছে। ইউরোপ, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার দুই ডজনেরও বেশি গবেষক ২০২২ নালে এক গবেষণাপত্রে বলেন, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ইউরোপে হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাসের (এইচএসভি-১) দ্রুত বিস্তারের কারণ ছিল রোমান্টিক চুম্বন। ইউরোশিয়ান তৃণভূমিগুলো থেকে দফায় দফায় অভিবাসনের মধ্য দিয়ে ইউরোপের সমাজে প্রকাশ্যে প্রেম চুম্বনের মত নতুন সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটছিল সে সময়।
আরবোল ও রাসমুসেন অবশ্য মনে করেন, ইউরোপে চুম্বন সংস্কৃতি গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করেছিল সেই ব্রোঞ্জ যুগেই। আর সেজন্য কেবল অভিবাসনকে দায় দিতে রাজি নন তারা। মেসোপটেমিয়ায় চুম্বন ছিল সাধারণ বিষয়। সে কারণে ইউরোপের বাসিন্দারাও চুম্বনের সঙ্গে কমবেশি পরিচিত ছিলেন। দুই গবেষকের বিশ্বাস, ভারতেও চুমু বিষয়টা তখন পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল না।
চুমুর সেকাল-একাল
আরবোল এবং রাসমুসেন তাদের গবেষণাপত্রে লিখেছেন, সন্তানের গালে বাবা-মায়ের চুমুর যে সংস্কৃতি, তা পৃথিবীর সকল ভৌগোলিক অঞ্চলে সকল যুগেই ছিল বলে ধারণা করা যায়।
তবে প্রকাশ্যে প্রেম চুম্বন পৃথিবীর সব জায়গায় সাধারণ বিষয় নয়। এখনও অনেক সংস্কৃতিতে প্রকাশ্যে রোমান্টিক চুমু এড়িয়ে চলা হয়।
২০১৫ সালে একদল গবেষক বিশ্বজুড়ে ১৬৮টি আধুনিক সমাজের মধ্যে জরিপ চালান। দেখা যায়, মাত্র ৪৬ শতাংশ সমাজ প্রকাশ্যে প্রেম চুম্বন অনুমোদন করে।
আরবোল এবং রাসমুসেন লিখেছেন, যদিও মেসোপটেমিয়ার মত প্রাচীন সভ্যতায় প্রেম চুম্বনকে সমাজে অস্বাভাবিক কিছু মনে করা হত না, এই আধুনিক সময়ে এসেও অনেক সমাজে কে কাকে চুমু খেতে পারবে এবং কোথায় খেতে পারবে তা নিয়ে ট্যাবু রয়েছে।
ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গার্সিয়া বলেন, পশ্চিমা সমাজে এখন যেমন যত্রতত্র চুম্বনরত যুগলদের দেখা যায়, পরিস্থিতি বরাবরাই এমন ছিল না। প্রকাশ্য স্থানে ঘনিষ্ঠতার প্রদর্শনী সমাজ সব সময় মেনে নিত না। আরবোল এবং রাসমুসেনের গবেষণা সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
তবে আরবোল বলছেন, “এমনও হতে পারে যে, প্রাচীন সমাজে চুমুর সংস্কৃতি এখনকার পৃথিবীর তুলনায় অনেক বেশিই শক্তিশালী ছিল। তবে সেটা নিশ্চিত করে বলতে গেলে ভবিষ্যতে চুমু নিয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন।”