কেমন রাজা হবেন চার্লস?

ব্রিটিশ যুবরাজ হিসেবে চার্লস যুক্তরাজ্যের মানুষ এবং বিশ্ববাসীর খুব চেনা একজন। কিন্তু রাজা হিসেবে তিনি কেমন হবেন, কেউ এখনও জানে না।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Sept 2022, 07:57 PM
Updated : 9 Sept 2022, 07:57 PM

মায়ের মৃত্যুতে তাকে শোক ‍পালন করতে হচ্ছে, সেই সঙ্গে নিতে হচ্ছে নতুন দায়িত্বের প্রস্তুতি।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর অভিষেকের অপেক্ষায় থাকা রাজা তৃতীয় চার্লস প্রথমবার ব্রিটিশ নাগরিকদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে অঙ্গীকার করেছেন, আজীবন দেশ ও জাতির সেবা করে যাবেন তিনি।

কিন্তু রাজ দায়িত্বে কেমন হবেন এতদিনের প্রিন্স অব ওয়েলস? রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ৭০ বছরের ছায়া ঠেলে বেরিয়ে এসে নিজেকে তিনি কীভাবে মেলে ধরবেন? মায়ের দয়ালু ভাবমূর্তির বিপরীতে মানুষ হিসেবে তিনি নিজেকে কেমন রূপে চেনাবেন?

ব্রিটিশ রাজতন্ত্র এখন কেবল আলঙ্করিক রূপেই অস্তিত্বমান। তারপরও ব্রিটেনের নাগরিকদের মত পুরো বিশ্বই এসব প্রশ্নের উত্তর জানার অপেক্ষায়।

চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জ দীর্ঘ ৭০ বছর ছিলেন যুবরাজ। ব্রিটিশ রাজবংশের ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় ধরে আর কোনও যুবরাজ সিংহাসনের অপেক্ষা করেননি। তিনিই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সের রাজা হয়েছেন।

মা রানি হওয়ায় শৈশব থেকেই চার্লসকে থাকতে হয়েছে মানুষের নজরে নজরে। মানুষের চোখের সামনেই তিনি কিশোর-তরুণ-যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়েছেন। এখন তার বয়স প্রায় ৭৪। এই বয়সে যুক্তরাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ অবসর জীবনে থাকেন।

যুবরাজ চার্লস যুক্তরাজ্যের মানুষ এবং বিশ্ববাসীর কাছে খুব চেনা একজন। কিন্তু রাজা হিসেবে চার্লস কেমন হবেন তা এখনও কেউ জানে না।

নতুন এই ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে বিশ্বের প্রত্যাশা কী- তা বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করেছে সিএনএন।

অস্থির, উচ্চাকাঙ্ক্ষী

ব্রিটিশ রাজপরিবার নিয়ে কাজ করা সিএনএন এর সংবাদদাতা ম্যাক্স ফস্টার বহু বছর ধরে চার্লসকে নিয়ে নানা প্রতিবেদন করেছেন। তিনি চার্লসের সঙ্গে ঘুরেছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে। নতুন রাজা চার্লস কেমন হতে পারেন সে বিষয়ে তিনি কিছুটা ধারণা দিয়েছেন।

ফস্টার লিখেছেন, চার্লসের অনেক পূর্বসূরি প্রিন্স অফ ওয়েলস হিসেবে তাদের ভূমিকাকে ‘প্লেবয়ের মত’ জীবনযাপন এবং নিশ্চিত আয়ের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। চার্লস সেখানে পেশাদারিত্ব দিয়ে নিজের মত করে এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তিনি উত্তরাধিকার চেয়েছিলেন। তবে দায়িত্ব পালনের জন্য রাজা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাননি।

“আমার অভিজ্ঞতায় তিনি অধৈর্য এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ। যদি তার কোনো উদ্যোগ কাজ না করে বা কাঙ্ক্ষিত ফল না দেয়, তিনি খুবই হতাশ হয়ে পড়েন।”

সমাজ চিন্তা

চার্লস দাতব্য কাজে জড়িত। চার্লসের ‘দ্য প্রিন্স’স ফাউন্ডেশন’ পরিচালনা করেন কেনেথ ডানসমুইর। ঐহিত্যগত চারুশিল্প ও দক্ষতার উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেয় ওই ফাউন্ডেশন।

চার্লস সম্পর্কে ডানসমুইর বলেন, “নানা সামাজিক সমস্যা এবং পরিবেশ নিয়ে তিনি ভাবেন। তাতে তিনি এ ধরনের কাজের সঙ্গে দিন দিন আরও বেশি জড়িয়ে পড়েছেন। এসব করার সময়ও তার হাতে ছিল।”

আবেগের বাধ

চার্লসকে প্রায়ই নিজের কাজের প্রতি আবেগ সামাল দিতে লড়াই করতে হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে তিনি বক্তৃতা দেওয়ার সময় নিজের আশা এবং উৎকণ্ঠার কথা প্রকাশ করে ফেলেছেন। সেজন্য সমালোচনারও শিকার হতে হয়েছে। বলা হয়েছে, চার্লসের বক্তব্য হবু রাজার মত নয়, বরং ক্যাম্পেইনারের মত।

তার ওই আচরণের কারণেই তার বিরুদ্ধে কথা ওঠে যে তিনি রাজতন্ত্রের স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতাকে হুমকির মুখে ফেলেছেন, যা তার মা প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ব্যক্তিত্বের বিপরীত।

জলবায়ু যোদ্ধা

জলবায়ু পরিবর্তনের মত বিষয়গুলো নিয়ে চার্লস অনেক আগে থেকেই সক্রিয়। সেই ১৯৬৮ সাল থেকে তিনি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা বলে আসছেন, যা একসময় বিশ্বজুড়ে মূল আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে এবং এখন এটি রাজনৈতিক আলোচনারও বিষয়।

যেসব বিশ্বনেতা ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে জোরালো সমর্থন জানিয়েছিলেন, চার্লস তাদের অন্যতম।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে একটি চা-চক্রে তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নিয়ে কথা বলেছিলেন। তার আগেই ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।

২০২০ ‍সালে সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে জলবায়ু নিয়ে চালর্স জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। তিনি বলেছিলেন, “আমরা কী ইতিহাসে এমন মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে চাই, যারা বিশ্বকে যথাসময়ে খাদের কিনারা থেকে সরিয়ে আনতে এবং ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করতে কিছুই করেনি, যখন আমরা তা করতে পারতাম? আমি তেমন হতে চাই না।”

তখনও প্যারিস জলবায়ু চুক্তি হয়নি, ওই সময়ে এক সাক্ষাৎকারে চার্লস জোর দিয়ে বলেছিলেন, “আমরা এভাবে সবকিছু চলতে দিতে পারি না। প্রত্যেক মাসেই তাপমাত্রার নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। যদি আমরা খুব বেশিদিন এভাবে চলতে দিই, তবে দিন দিন সব কিছু আরও কঠিন হয়ে পড়বে।”

সমালোচনার মধ্যেও বিগত বছরগুলোতে চার্লসকে পরিবেশ আন্দোলনে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা গেছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে গ্লাসগোতে কপ ২৬ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সমাধানের পথ বের করতে তিনি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করার জন্য সরকারগুলোকে অনুরোধ করেছিলেন।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্যর ক্ষতির কারণে বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, “এ অবস্থা মোকাবেলায় যুদ্ধের সময়ের মতই জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।”

স্পষ্টভাষী

চার্লস একজন স্পষ্টভাষী মানুষ। তিনি জিন পরিবর্তন করা ফসল থেকে শুরু করে হোমিওপ্যাথি ওষুধ বা স্থাপত্যের মত সংবেদনশীল বিষয়গুলো নিয়ে স্পষ্টভাষায় নিজের বক্তব্য প্রকাশ করেছেন, যা তার মায়ের ব্যক্তিত্ব থেকে তাকে আলাদা মানুষ হিসেবে চিনিয়েছে।

প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তার ৭০ বছরের রাজত্বে কোনো বিষয়ে ব্যক্তিগত আবেগ প্রকাশ করেছেন এমন ঘটনা বিরল। তার নীতি ছিল কাউকে আক্রমণ করে কথা না বলা বা অসন্তষ্ট না করা। কোনো বিষয় নিয়ে রানি বড়জোর নিজের মতামত দিতেন।

রানি এলিজাবেথের কাউকে না খেপানোর ওই অপরিসীম ক্ষমতা অনেকের কাছে বোধগম্য হওয়ার চাইতেও বেশি কৌশলগত ছিল।

তবে চার্লস সবসময় মায়ের নেতৃত্বের ধরন অনুসরণ করার ইচ্ছাই জোরালভাবে প্রকাশ করে এসেছেন এবং রাজসিংহাসনে বসার পর অনেক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা বন্ধ করবেন বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন।

২০১৮ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চার্লস অবশ্য বলেছিলেন, ‘‘সফল হতে হলে আমাকেও পুরোপুরি ঠিক একই পথে চলতে হবে- এমন ধারণা করা অর্থহীন। কারণ দুইজন মানুষ... দুটো ভিন্ন পরিস্থিতি... সম্পূর্ণ আলাদা।”

ছেলের সাথে দূরত্ব

চার্লস তার পুরো জীবন সিংহাসনে আরোহণের প্রস্তুতি নিয়েছেন এবং সন্দেহাতীতভাব এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, তিনি লাজুক বা কাজে অনাগ্রহী নন।

চার্লস রাজা হওয়ার পর যুবরাজ হয়েছেন তার বড় ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম। তিনি এখন পর্যন্ত রাজমুকুট মাথায় নেওয়া নিয়ে কোনো তাড়াহুড়ো দেখাননি। বরং তিনি স্থিরভাবে তার রাজকীয় পোর্টফোলিও তৈরি করছেন এবং পরিবারকে সময় দিচ্ছেন।

বাবা-ছেলে খুব একটা ঘনিষ্ঠ নন। তারা দুইজন ব্যক্তিগত এবং কাজের ক্ষেত্রে খুব কাছাকাছি আসেন ২০২০ সালে, যখন প্রিন্স হ্যারি রাজদায়িত্ব পালন করা থেকে মুক্তি চান এবং সিনিয়র রয়্যাল গ্রুপ থেকে সরে যান।

নতুন রাজা এবং তার উত্তরাধিকারীর মধ্যে সম্পর্ক ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার চাবিকাঠি; যেমন নতুন রাজা এবং তার স্ত্রীর সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে রাজতন্ত্র কতটা গতিশীল হবে।

ক্যামিলা বৃত্তান্ত

সাংবাদিক ফস্টারের মতে, ক্যামিলা সবসময় চার্লসের পাশে আস্থা ও সমর্থনের স্তম্ভ হয়ে থেকেছেন।

“আমি দেখেছি, চার্লস যখন কোনো কাজে বাধার সম্মুখীন হন, তখন তিনি কতটা ভঙ্গুর এবং হতাশ হয়ে পড়তে পারেন। ক্যামিলা তখন হাস্যরস আর নিজের কারিশমা দিয়ে স্বামীর সব দুঃশ্চিন্তা দূর করে দেন। ক্যামিলা এক্ষেত্রে এক অনন্য প্রতিভা, যা ক্যামেরায় দেখা যায় না।”

২০১৫ সালে নিজেদের দশম বিবাহবার্ষিকীতে ক্যামিলা সম্পর্কে চার্লস বলেছিলেন, “এমন কাউকে পাওয়া সবসময়ই চমৎকার, যাকে পেয়ে আপনার মনে হবে সে আপনাকে বুঝতে পারছে এবং উৎসাহ দিতে চাইছে। এছাড়া আমি যদি কোনও বিষয় নিয়ে খুব বেশি সিরিয়াস হয়ে যাই, সে মজা করে আমাকে খোঁচাবে। এটাও এক দিকে ভালো।”

ক্যামিলা ‍দৃঢ়ভাবে পাশে আছেন, এ বিশ্বাস নিয়েই রাজ দায়িত্ব শুরু করতে যাচ্ছেন চার্লস। শুধু যুক্তরাজ্যের নন, তিনি হবেন অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ আরও ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান।

সব দেশেই যেমন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের পক্ষের লোক আছে, তেমনি অনেকেই রাজতন্ত্রের অবসান চান। রাজদণ্ড হাতে পাওয়া চার্লস এসব কতটা সামাল দিতে পারবেন, তার ওপর নির্ভর করছে ব্রিটিশ রাজপরিবারের ভবিষ্যৎ।