মানুষের চেয়ে বন্দুক বেশি যুক্তরাষ্ট্রে, বিশ্বে শীর্ষে

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০০ জন নাগরিকের বিপরীতে ১২০টি আগ্নেয়াস্ত্র; গুলিতে আত্মহত্যা, ‘ম্যাস শুটিং’য়ে শীর্ষে দেশটি।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 March 2023, 07:09 PM
Updated : 28 March 2023, 07:09 PM

যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের দৌরাত্ম্য আবার সামনে আনল টেনেসির স্কুলে গুলিতে ৭ জনের মৃত্যু।

মানুষের চেয়ে যদি কোনো দেশে বন্দুকের সংখ্যা বেশি থাকে, সেখানে এই ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা বেশিই থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে তাই ঘটছে।

সোমবার টেনেসি রাজ্যের ন্যাশভিল শহরে বন্দুক হামলার পর সিএনএন এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্নেয়াস্ত্রের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছে।

তাতে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলোর মধ্যে বন্দুকের সহিংসতার পরিসংখ্যানে সবচেয়ে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা স্মল আর্মস সার্ভের (এসএএস) হিসাবে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০০ জন নাগরিকের বিপরীতে ১২০টি করে আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানা রয়েছে।

বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, যেখানে জনসংখ্যার চেয়ে আগ্নেয়াস্ত্র বা বন্দুকের সংখ্যা বেশি। পরিসংখ্যানে এর পরের অবস্থানে থাকা অঞ্চলটি হচ্ছে ফকল্যান্ড আইল্যান্ড, যেখানে প্রতি ১০০ জনের বিপরীতে আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা ৬২ দশমিক ১০। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক।

তৃতীয় অবস্থানে থাকা দেশটি হল ইয়েমেন। যুদ্ধকবলিত দেশটিতে প্রতি ১০০ জনের বিপরীতে ৫৩টি আগ্নেয়াস্ত্র থাকার তথ্য দিচ্ছে এসএএস।

এই পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্রে কেন সবচেয়ে বেশি ‘গান ভায়োলেন্স’, বলা হয়েছে সিএনএনের প্রতিবেদনে।

Also Read: যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে গোলাগুলি বেড়েছে রেকর্ড সংখ্যায়

অবৈধ অস্ত্র, চোরাচালান ও অনিবন্ধিত অস্ত্রের হিসাব না পাওয়ায় এবং যুদ্ধকবলিত এলাকার হিসাব নিরূপণ অসাধ্য হওয়ায় সাধারণ নাগরিকদের কাছে ঠিক কত সংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র বা বন্দুক রয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব না হলেও এসএএসের গবেষকদের হিসাবে বিশ্বজুড়ে ৮৫ কোটি ৭০ লাখ বেসামরিক আগ্নেয়াস্ত্র বা বন্দুক রয়েছে। এরমধ্যে ৩৯ কোটি ৩০ লাখ বা ৪৪ শতাংশের মালিকানা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের হাতে।

২০২০ সালের একটি গ্যালাপ-জরিপের বরাতে সিএনএন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে যারা পরিবার নিয়ে থাকেন তাদের ৪৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ঘরে অন্তত একটি বন্দুক রাখেন এবং তাদের এক-তৃতীয়াংশের নিজস্ব মালিকানায় বন্দুক বা আগ্নেয়াস্ত্র আছে।

ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস-অস্টিনের সহযোগী অধ্যাপক জাচ্যারি এলকিনস বলেন, বিশ্বে মাত্র তিনটি দেশে সাংবিধানিকভাবে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার বৈধতা রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও গুয়েতেমালা। এরমধ্যে অন্য দুই দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এক-দশমাংশ।

তিনি বলেন, ওই দুই দেশে আগ্নেয়াস্ত্র বহনের বিতর্কটি যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম রাজনৈতিক আলোচনার বিষয়। ওই দেশগুলোতে সংবিধানে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কথা বলা আছে, যা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সুবিধা করে দিয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে মেক্সিকোর কথা বলেন এলকিনস, সেখানে পুরো দেশে মাত্র একটা দোকান আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করতে পারে, যা সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের উৎপাদন ও বিক্রি বাড়ছে।

ইউএস বুরো অব অ্যালকোহল, টোব্যাকো, ফায়ারআর্মস অ্যান্ড এক্সপ্লোসিভসের (এটিএফ) তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৯০ লাখ আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুত করা হয়, যা ২০০৮ সালের তুলনায় দ্বিগুণ।

সম্প্রতি এই আগ্নেয়াস্ত্র কেনার হিড়িক আরও বেড়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র কেনার সময় ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ বা অতীত ইতিহাস যাচাইয়ের বাধ্যবাধকতা আরোপ করার পর ২০২১ সালের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের তুলনায় আগ্নেয়াস্ত্র কেনার হার ৬০ শতাংশ বেড়েছে।

এফবিআইয়ের তথ্য থেকে জানা গেছে, শুধু ২০২১ সালের মার্চ মাসেই নতুন আগ্নেয়াস্ত্র কেনার শর্ত হিসেবে ২০ লাখ ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ করা হয়েছে।

সহিংসতা সবচেয়ে বেশি

সবচেয়ে বেশি বন্দুকের দেশের পরিসংখ্যানেও একই বাস্তবতা। বন্দুকে নিহতের মধ্যে আত্মহত্যা, হত্যা ও অসাবধানতাবশত গুলিতে মৃত্যুও রয়েছে।

ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের (আইএইচএমই) ২০১৯ সালের তথ্যানুযায়ী, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। এই মৃত্যুর হার পরের অবস্থানে থাকা কানাডার চেয়ে ৮ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে ২২ শতাংশ ও অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি।

আইএইচএমইর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র বা বন্দুক ব্যবহার করে হত্যার সংখ্যায় সবার উপরে রয়েছে দেশটির রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি, যেখানে মৃত্যুর হার গোটা ব্রাজিলের প্রায় সমান। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হত্যার পরিসংখ্যানে ব্রাজিল বিশ্বে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে।

বিশ্বজুড়ে বন্দুক দিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে। ওইসব অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে আছে এল সালভাদর, ভেনেজুয়েলা, গুয়েতেমালা, কলম্বিয়া ও হন্ডুরাস।

এসব দেশে এই গুলি করে মানুষ মারার উচ্চ হারের পেছনেও যুক্তরাষ্ট্রের অবদান রয়েছে, লিখেছে সিএনএন।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেক্সিকোর সরকারের কাছে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বছরে প্রায় দুই লাখ আগ্নেয়াস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকোর সীমান্ত পার হয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার হয়। ২০১৯ সালে মেক্সিকোতে জব্দ করা আগ্নেয়াস্ত্রের ৬৮ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাচার হওয়া।

গুলি করে আত্মহত্যায়ও শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র

সিএনএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিশ্বের ৪ শতাংশ মানুষের বাস যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৯ সালে বিশ্বে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে আত্মহত্যার ৪৪ শতাংশই সংঘটিত হয়েছিল। ওই বছর ২৩ হাজার আমেরিকান গুলি করে আত্মহত্যা করে।

একাধিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, আগ্নেয়াস্ত্র বা বন্দুকের মালিকানার সঙ্গে গুলি করে আত্মহত্যার সম্পর্ক রয়েছে।

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণার ফল বলছে, হ্যান্ডগানের মালিকানা থাকা ব্যক্তির ক্ষেত্রে গুলি করে আত্মহত্যা বা বন্দুকের গুলিতে হতাহত হওয়ার সম্ভাবনা বন্দুকের মালিকানা না থাকা ব্যক্তির তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি।

আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানা থাকা নারীর ক্ষেত্রে বন্দুক ব্যবহার করে আত্মহত্যা করার সম্ভাবনার হার আগ্নেয়াস্ত্রের মালিনাকা না থাকা নারীর তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি।

নির্বিচারে গুলি

ওয়াশিংটনভিত্তিক ‘দ্য গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ’র সংজ্ঞায় ‘ম্যাস শুটিং’ বা নির্বিচারে গুলি করে হত্যা বলতে এমন ঘটনাকে বোঝায়, যেখানে বন্দুকধারীর গুলিতে সে ছাড়াই অন্তত চারজন মানুষ নিহত বা আহত হয়, যেখানে হত্যার উদ্দেশে ভিকটিমকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়নি।

এই সংজ্ঞানুযায়ী ২০১৯ সালে ৪১৭টি ম্যাস শুটিং হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। ২০২২ সালে ২১৩টি ম্যাস শুটিং রেকর্ড করা হয়েছে।

উইলিয়াম প্যাটারসন ইউনিভার্সিটির সোশিওলজি অ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জ্যাসন আ সিলভা জানান, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ যেখানে গত ২০ বছর ধরে প্রতি বছর ‘ম্যাস শুটিং’ হয়ে আসছে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যগুলোর নিজস্ব ‘গান পলিসি’ বা ‘আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার’ আইনও গুলি করে মানুষ হত্যায় অন্যতম ভূমিকা রাখে বলে জানিয়েছে একটি ব্রিটিশ সাময়িকী।

গত বছর কলোরাডো, সাউথ ক্যারোলাইনা ও টেক্সাসে ম্যাস শুটিংয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপের আহ্বান জানান।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে একটি বিধি অনুমোদন করে যেখানে বলা হয়েছে, আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রির সময় বিক্রেতাকে অবশ্যই ক্রেতার ‘ফেডারেল ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু বিধিটি এখনও সেনেটে আটকে আছে। ১০০ আসনের সেনেটে অন্তত ৬০ সেনেটরের সমর্থন দরকার এই বিধি পাস করাতে।

গত বছর এপ্রিলে পিউ’র একটি জরিপ থেকে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের দুই রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কড়াকড়ি নিয়ে উদাসীনতা রয়েছে। ৮০ শতাংশ রিপাবলিকান ও ১৯ শতাংশ ডেমোক্রেট দলীয় সদস্য চান, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অধিকার অথবা শিথিলতা বজায় রাখা হোক।