এক বৃদ্ধ আফগান সেদিন চিৎকার করে বলেছিলেন, “আল্লাহকে ধন্যবাদ, তোমরা এসেছ।” যেন এই বিদেশিরা সাক্ষাৎ দেবদূত!
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনে তালেবানবিরোধী আফগান দলগুলোর মোর্চা ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’ সেদিন কাবুলের প্রান্তে পৌঁছায়। রণে ভঙ্গ দিয়ে তালেবান যোদ্ধারা সেখান থেকে সরে পড়ে।
আর এর মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক ইতিহাসের চরমতম ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্রের পাঁচ বছরের শাসনের অবসান ঘটে আফগানিস্তানে।
আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে নিউ ইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে নাইন ইলেভেনের সেই হামলা হয়েছিল তার মাত্র দুই মাস আগে।
মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্বে আফগানিস্তানের ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়নি, সেই তালেবান আবারও ফিরে আসতে পারে।
দুই দশক পর মার্কিন বাহিনী পুরোপুরি প্রত্যাহার হওয়ার আগেই, ঝড়ের বেগে, মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে অধিকাংশ এলাকার দখল নিয়ে ফের আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে গোঁড়া ওই ইসলামী দল।
তালেবান যোদ্ধারা রোববার আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে প্রবেশের পর ‘রক্তপাত এড়াতে’ সঙ্গীসাথীদের নিয়ে পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি। পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরাও সরে পড়েছেন।
২০ বছর পর হঠাৎ করেই তালেবান আবার বাজি মাত করে দিল কীভাবে? এ প্রশ্ন এখন অনেকের মনেই ঘুরছে।
বিভিন্ন সময় আফগানিস্তানে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বিবিসির সাংবাদিক জন সিম্পসন বলছেন, এর উত্তর খুঁজে পাওয়া ‘কঠিন নয়’।
তিনি লিখেছেন, তালেবানের শাসনাবসানের পর ক্ষমতায় আসা প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এবং আশরাফ গানি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও তাদের সরকার কখনোই যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। আফগানিস্তানে বরাবরই যেটা শক্তিশালী ছিল, সেটা হল দুর্নীতি।
ট্রাম্প ভেবেছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে চলা আফগান যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারলে কাঙ্ক্ষিত সেই কূটনৈতিক সাফল্য তার হাতে ধরা দেবে।
জন সিম্পসন লিখেছেন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দোহায় যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় যে ঐকমত্য হয়েছিল, তাতে তার চেনা আফগান রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকদের অনেকেই রীতিমত আতঙ্ক বোধ করেছিলেন।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। চলতি বছরের শুরুতে তিনি যখন স্পষ্ট করলেন যে পূর্বসূরীর আফগান নীতিই তিনি অনুসরণ করতে যাচ্ছেন, সে আতঙ্কের মাত্রা তখন দ্বিগুণ হয়ে ওঠেছিল।
সিম্পসন বলেন, “আমাকে সতর্ক করা হয়েছিল, দোহায় তালেবান নেতাদের যতই শান্তিকামী মনে হোক, যত নরম সুরেই তারা কথা বলুক না কেন, মাঠে তাদের যোদ্ধাদের মধ্যে সেসবের কোনো বালাই থাকবে না।”
বাস্তবে সেটাই প্রমাণ হল।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং পশ্চিমা দেশগুলো তাদের সেনা প্রত্যাহার শুরু করতেই পুরো আফগানিস্তানজুড়ে তালেবান যোদ্ধাদের ক্ষমতার ফেরার চেষ্টা শুরু হয়ে যায়।
একের পর এক শহরে বন্দিদের ফাঁসিতে ঝোলানোর খবরে ফিরে আসে ত্রাসের রাজত্ব। এরপর আসে কাবুলের পালা, সবার আগে বিমানবন্দরে পৌঁছানোর চেষ্টায় আফগান কর্মকর্তা আর সৈন্যদের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।
বিবিসির সাংবাদিক সিম্পসন বলছেন, পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং সরকারি চাকরিজীবীদের নিজ অবস্থানে থাকার আহ্বান জানিয়ে কারও উপর প্রতিশোধ না নেওয়ার যে আশ্বাস বাণী তালেবান দিচ্ছে, তা হয়ত তারা রাখতেও পারে।
কিন্তু কেমন হতে পারে এবারের তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান?
জন সিম্পসন লিখেছেন, “সে বিষয়ে অনুমান করার জন্য আমাদের হাতে কেবল ১৯৯৬ সাল থেকে পাঁচ বছরের তালেবান শাসনামলের অভিজ্ঞতাই আছে, যখন তারা পরাক্রমশালী আহমেদ শাহ মাসউদের নিয়ন্ত্রণাধীন মধ্যমপন্থি মুজাহিদীন সরকারকে বিতাড়িত করেছিল।”
তালেবান ক্ষমতায় থাকার সময়ও সাংবাদিকতার জন্য বহুদিন আফগানিস্তানে কাটাতে হয়েছিল জন সিম্পসনকে। তার ভাষায়, সেই অভিজ্ঞতা ছিল অত্যন্ত ভীতিপ্রদ।
শরিয়া আইনের নামে জনসম্মুক্ষে ফাঁসিতে ঝোলানো, দোররা বা চাবুক মারার মত নিষ্ঠুর শাস্তি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
পুরুষদের কারো হাঁটু দেখা গেলে, অথবা কেউ পশ্চিমা পোশাক পড়লেই হামলা চালাত রাস্তার মোড়ে পাহারায় থাকা তালেবান গ্যাং।
পুরুষের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিয়েই কেবল বাইরে যেতে পারতেন নারীরা, এবং অবশ্যই সর্বাঙ্গ ঢাকা বোরকা পরে।
তালেবান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোল্লা বালুচ একবার অনুযোগের সুরে সিম্পসনকে বলেছিলেন, চুরির ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত আসামির হাত-পা কেটে নিতে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সোসাইটির কাছে সার্জন চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সে অনুরোধ তারা রাখেনি। ফলে কাজটা তাকে নিজেই করতে হয়েছে। অবশ্য কাজটি তিনি যথেষ্ট উপভোগ করেন বলেই সিম্পসনের মনে হয়েছিল।
সেই সব দিনে টেলিভিশনের জন্য কাজ করা ছিল দুঃস্বপ্নের মত, কারণ তালেবান শাসনে জীবন্ত কোনো কিছুর ছবি তোলা ছিল ধর্মীয় বিবেচনায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
বইয়ের দোকানগুলোতে সে সময় নিয়মিত অভিযান চলত, দেখা হত কোথাও কোনো ছবি রয়েছে কি না। পাওয়া গেলে সেই দোকানিকে চাবুক পেটা করা হত। সম্ভব হলে বেশিরভাগ মানুষেই শহর ছেড়ে পালাত, কোনো দোকানও হয়ত খুলত না।
তেল আমদানির খরচ মেটানো তালেবান সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে রাতে মানুষের বাড়ির জানালা দিয়ে আসা বাতির আলোই ছিল ভরসা। বেওয়ারিশ কুকুরের দলের ঘেউ ঘেউ শব্দই ছিল সে সময়ের সবচেয়ে জোড়ালো আওয়াজ।
পরের বছরগুলোতে শহরের সড়কগুলো গাড়িতে ভরে গেছে, তালেবান আমলে যেসব রাস্তা খাঁ খাঁ করত। নতুন নতুন অনেক স্কুল চালু হয়েছে, বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। তালেবান শাসনে মেয়েদের শিক্ষা ছিল নিষিদ্ধ। যে সংগীতকে তালেবানরা নিষিদ্ধ করে রেখেছিল, সেই সংগীতের সুরও ভাসতে লাগল বাতাসে।
কাবুলের সবখানে এখন প্রচুর নতুন নতুন ভবন গড়ে উঠেছে। ২০০১ সালে তালেবান শাসনের অবসানের পর কাবুলের প্রান্তে যে জায়গা দিয়ে সিম্পসন ও তার সহকর্মীরা শহরে প্রবেশ করেছিলেন, শেষবার আফগান রাজধানীতিতে গিয়ে সেই জায়গাটা তিনি খুঁজেই পাননি।
তিনি লিখেছেন, আফগানিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ তালেবানের এই প্রত্যাবর্তনকে নিজেদের এবং দেশের জন্য একটি বিপর্যয় হিসেবেই দেখবে।
এখন মূল প্রশ্ন হল, তালেবান কি তাদের সহজাত চরিত্র অনুযায়ী এগোবে? আফগানিস্তানকে রাতারাতি অতীতে ফিরিয়ে নেবে, যেমনটা ২০ বছর আগে তারা নিয়েছিল? নাকি অভিজ্ঞতা থেকে তারা নতুন কিছু শিখতে পেরেছে?