কেন দ্রুত পতন হচ্ছে আফগান বাহিনীর?

আফগানিস্তানে আত্মসমর্পণ মনে হচ্ছে তালেবান বাহিনী যত দ্রুত ছুটতে পারে, তারচেয়েও বেশি গতিতে ঘটছে।

>>নিউ ইয়র্ক টাইমস
Published : 14 August 2021, 01:02 PM
Updated : 14 August 2021, 06:11 PM

গত কয়েকদিনে ১৫টিরও বেশি শহরে তালেবান যোদ্ধাদের অগ্রযাত্রার মুখে টিকতে পারেনি আফগান নিরাপত্তা বাহিনী । মে মাসে তালেবান সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পর শুক্রবার পর্যন্ত দেশটির গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রাদেশিক রাজধানী কান্দাহার ও হেরাত দখল করেছে, সঙ্গে আগের দখল করা শহরগুলো তো রয়েছেই।

তালেবানের এমন ক্ষিপ্রতায় গণ আত্মসমর্পণের ঘটনাও ঘটছে। সরকারি বাহিনীর ফেলে যাওয়া হেলিকপ্টার এবং কোটি কোটি ডলারের মার্কিন সমরাস্ত্রও তালেবান কব্জা করতে পারছে অনায়াসে।

অনেক শহরের উপকণ্ঠে কয়েক সপ্তাহ ধরে তীব্র লড়াইয়ের পর তালেবানই শেষ পর্যন্ত সরকারি বাহিনীর প্রতিরক্ষা বলয়ে ঢুকে পড়েছে এবং এরপর সামান্য বা কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই শহরে প্রবেশ করেছে।

গত দুই দশকে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য অস্ত্র, সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র কাড়ি কাড়ি (আট কোটি ৩০ লাখ ডলারের বেশি) অর্থ ঢাললেও এখন বিপর্যয় দেখতে হচ্ছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশল ছিল শক্তিশালী আফগান নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তোলা। যাতে তাদের হাতে দেশের নিরাপত্তার ভার হস্তান্তর করে সরে আসতে পারে। চেষ্টাটা শুরু হয়েছিল এক দশক আগে।

এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর মডেলেই একটি আফগান বাহিনী গড়ে তোলা হয়, যার লক্ষ্য ছিল আমেরিকার এই যুদ্ধটিকে টেনে নেওয়া। কিন্তু আফগানিস্তান ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার আগেই লক্ষ্যটা হারিয়ে যাচ্ছে।

আফগানিস্তানের পরিস্থিতি যতই অনিশ্চয়তায় পড়ছে, একটা বিষয় আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে- আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন করে একটি দৃঢ় ও স্বতন্ত্র লড়াকু বাহিনীতে পরিণত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, যার চড়া মাশুল দিতে হচ্ছে আর দেশটি তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে।

আফগান সামরিক বাহিনী কীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তা প্রথম ধরা পড়ে কয়েক মাস আগেই, এমনকি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা ঘোষণারও আগে।

এর শুরুটা হয় আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের তল্লাশি চৌকিগুলোতে। এসব জায়গায় ক্ষুধার্ত ও গুলি ফুরিয়ে যাওয়া সেনা ও পুলিশ সদস্যদের ঘিরে ফেলে তালেবান যোদ্ধারা এবং তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় আত্মসমর্পণ অস্ত্র ত্যাগ করলে তাদের নিরাপদে যেতে দেওয়া হবে।

ধীরে ধীরে এই প্রক্রিয়ায় তালেবান গোষ্ঠী ছোট এলাকা থেকে বড় এলাকা, এরপর গোটা জেলার নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে। যখনই কোনো সেনা অবস্থানের পতন হয়েছে, সাধারণ অভিযোগ ছিল একই- তালেবানের হামলার সময় সেখানে কোনো বিমান বাহিনীর সহায়তা দেওয়া হয়নি অথবা তাদের খাদ্য ও যুদ্ধ সরঞ্জামের মজুদ ফুরিয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু এরও আগে, আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর গঠনগত দুর্বলতাও দৃশ্যমান হয়েছিল। যে বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় তিন লাখ, সেখানে সম্প্রতি লড়াইগুলোতে ছয় ভাগের এক ভাগ সেনার দেখা মিলেছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা।

পশ্চিমা শক্তি আফগান বাহিনীকে যেভাবে একটি অত্যাধুনিক বাহিনীতে পরিণত করতে চেয়েছে, তার শুরু থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ে এরকম দুর্বলতা রয়েছে। তারা আফগান সেনাদের যেসব অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ও উপকরণ দিয়ে সাজাতে চেষ্টা করেছে যেগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও নেটোর দেশগুলো ছাড়া বাকিদের জন্য উপযোগী নয়।

সেনা ও পুলিশ সদস্যরা আফগান নেতৃত্বের ওপরও ক্ষুব্ধ ছিল। কারণ কর্মকর্তারা প্রায়ই পরিস্থিতির প্রকৃত অবস্থা জেনেও চোখবুজে থাকতেন। যেমন তারা জানতেন কাগজে-কলমে যে পরিমাণ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের কথা বলা হয়েছে বাস্তবে সেই সংখ্যা অনেক কম।

যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর তালেবান যখন তাদের হামলা জোরদার করছিল, তখন এই ঘটনা নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে এই বিশ্বাস জোরদার করেছিল যে নিরাপত্তা বাহিনীর হয়ে প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করে মারা যাওয়া নিরর্থক।

সাক্ষাৎকারের পর সাক্ষাৎকারে সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের অসহায়ত্ব ও একা ফেলে চলে যাওয়ার অনুভূতি বর্ণনা করেছেন।

গত সপ্তাহে গুরুত্বপূর্ণ আফগান শহর কান্দাহারে তালেবানকে ঠেকাতে আফগান বাহিনীর অক্ষমতা প্রকট হয়েছে।

কয়েক সপ্তাহ লড়াইয়ের পর একটি পুলিশ ইউনিটের দৈনিক রেশন হিসেবে এক বাক্স আলু সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে। কয়েকদিন তারা বিভিন্ন ধরনের আলু ছাড়া আর কিছুই পায়নি। ক্ষুধা ও অবসাদ তাদেরকে পরাজয়ের দিকে নিয়ে গেছে।

“এসব ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান ধরে রাখা যায় না!” সহায়তার অভাবে বিরক্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তা এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহরটি রক্ষায় লড়ছিলেন তিনি।

বৃহস্পতিবার নাগাদ আফগান বাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এবং শুক্রবার সকালে কান্দাহার তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৬০ হাজার সদস্যের মৃত্যু হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা আফগানিস্তানের গজনি শহরের ছবি, রাস্তায় সম্ভবত তালেবান সদস্যদের দেখা যাচ্ছে। ছবি: টুইটার

তালেবানের বিরুদ্ধে কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন লড়াইয়ে আফগান বাহিনীর পরাজয় বুধবার একটি চূড়ান্ত রূপ নেয় যখন একটি গোটা আফগান সেনা কোরের সদরদপ্তর তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। উত্তরাঞ্চলীয় শহর কুন্দুজের বিমানবন্দরের কাছে ছিল ওই সেনা সদরদপ্তর। তালেবান সেখানে অকেজো হেলিকপ্টার গানশিপ দখল করে। তারা কয়েকটি সাজোয়াঁ যানও হস্তগত করে।

ওই সেনাঘাঁটির পতনের সময় এর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্বাস তাওয়াকলি, যিনি ২১৭তম আফগান সেনা কোরের অধিনায়ক, পাশের প্রদেশে ছিলেন।

তিনি বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে, জেনে বা না জেনে, পার্লামেন্ট সদস্যদের কয়েকজন এবং রাজনীতিকরা আগুনে ঘি ঢেলেছেন যেটা শত্রুরা জ্বালিয়েছিল।”

জেনারেল আব্বাস বলেন, “কোন অঞ্চলেরই যুদ্ধের কারণে পতন হয় না, বরং পতন হয় মানসিক যুদ্ধের ফলে।”

এই মানসিক যুদ্ধ বিভিন্ন পর্যায়েই হচ্ছে।

আফগান পাইলটরা বলছেন, তাদের নেতারা বিমানের অবস্থার প্রতি যতটা মনোযোগ দেন, বৈমানিকদের প্রতি ততটা দেন না।

আফগান বাহিনীর এলিট কমান্ডো ইউনিটেরও যতটুকু বাকি আছে তারাও কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাচ্ছে না। তাদেরকেও একেকদিন একেক প্রদেশে পাঠানো হচ্ছে। ঘুমানোর সুযোগটুকুও মিলছে না।

সরকারি বাহিনীকে সহযোগিতা দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা জোরদার করতে সক্ষম আধাসামরিক বাহিনীগুলোর হালও ভালো নয়। তালেবানের সামনে তারাও টিকতে পারেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কর্মকর্তার ভাষ্য হচ্ছে, বিদেশি যোদ্ধাদের স্রোতে তালেবানের শক্তি বেড়েছে এবং দখল করা এলকাগুলো থেকেও তারা সদস্য সংগ্রহ করেছে। অন্য বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হচ্ছে তালেবান বাহিনী তাদের শক্তির একটি বড় অংশ সংগ্রহ করেছে পাকিস্তান থেকে।

অবশ্য এত কিছুর পরও আফগান বাহিনীর কিছু সেনা লড়ছে। হয়ত এই লড়াইয়ের পরিণতি হবে আফগান সরকার ও এর বাহিনীগুলোর সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ।