করমর্দন কি উঠেই যাবে?

মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়েই মানুষকে এখন হাজার বছর ধরে চলে আসা নানান জৈব-সামাজিক রীতি বাদ দেয়া এবং অন্যের সংস্পর্শ এড়ানোর চেষ্টায় হিমশিম খেতে হচ্ছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2020, 09:55 AM
Updated : 9 May 2020, 04:08 AM

এসবের মধ্যে হ্যান্ডশেক বা করমর্দনের উপরই মহামারী পরবর্তী বিশ্বে সবচেয়ে বড় খড়্গ নেমে আসতে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন।

বিবিসিতে লেখা এক নিবন্ধে এ করমর্দন বা হাত মেলানোর রীতির বেশ কিছু বিকল্পেরও সন্ধান দেওয়া হয়েছে।

হাত মিলিয়ে এতদিন ধরে কত কী-ই না হয়েছে। বন্ধুরা একে অপরকে সম্ভাষণ জানিয়েছেন, অপরিচিত জনদের মধ্যে হৃদ্যতা বেড়েছে, ব্যবসায়ীদের মধ্যে হয়েছে শত শত কোটি টাকার চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা।

তাহলে এবার? যে মহামারীর জন্য মানুষে মানুষে নৈকট্য কিংবা সংস্পর্শকেই দায়ী করা হচ্ছে, তার মোকাবেলা এবং পরবর্তী দুনিয়া কী ‘হ্যান্ডশেক’কে অচ্ছুৎ ঘোষণা করবে?

হ্যান্ডশেকের চল কীভাবে শুরু হয়েছে, তা নিয়ে আছে নানান মত। অনেকের ধারণা, এটি শুরু হয়েছে প্রাচীন গ্রিসে; তখন দুই ব্যক্তি নিজেদের কাছে কোনো অস্ত্র নেই বোঝাতে একে অপরের সঙ্গে হাত মেলাতেন।

কারও কারও হিসাবে হ্যান্ডশেকের চল শুরু হয় মধ্যযুগের ইউরোপে। নাইটরা তখন লুকানো অস্ত্রের সন্ধানে সন্দেহভাজনদের হাত ধরে ঝাঁকাতেন।

মাথা না ঝুঁকিয়ে সম্ভাষণ জানানো সম্ভব হওয়ায় সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডে শুরু হওয়া ধর্মীয় কোয়েকের আন্দোলন হাত মেলানোর ব্যাপারটিকে জনপ্রিয় করে তোলে।

“হ্যান্ডশেক হচ্ছে মানুষে মানুষে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার আক্ষরিক অঙ্গভঙ্গি; মানুষ কীভাবে গভীর সামাজিক ও স্পর্শকাতর প্রাণী হিসেবে বিকশিত হয়েছে তার প্রতীক,” বলেছেন টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ক্রিস্টিন লেগারে।

অনেক অনেক বছর ধরে চলে আসা হাত মেলানোর এ অভ্যাস সহজে থামানো যাবে না বলেই মনে করছেন তিনি।

“বিকল্প হিসেবে কনুই মেলানোর কথা আসায় আমরা বুঝতেই পারছি স্পর্শ আমাদের কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, আমরা এ শারিরীক সংযোগের বিষয়টি হারাতে চাই না,” বলেছেন লেগারে।

কেবল মানুষই নয়, একে অপরকে স্পর্শ করার চল অন্য প্রাণীদেরও আছে। রেসাস প্রজাতির বানরের বেড়ে ওঠায় স্পর্শ ও মমতা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন মনোবিজ্ঞানী হ্যারি হারলো গত শতকের ষাটের দশকেই তা দেখিয়েছেন।

প্রাণীকূলের মধ্যে মানুষের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় শিম্পাঞ্জিকে একে অপরের সঙ্গে নিয়মিতই থাবা মেলাতে, জড়িয়ে ধরতে ও চুমু খেতে দেখা যায়। একে অপরের শক্তিমত্তা ও উদ্দেশ্য পরখ করতে ঘাড়ে ঘাড়ে মিলিয়ে ‘নেকিং’- করে পুরুষ জিরাফও।

এটা ঠিক, স্পর্শ ছাড়া মনুষ্য সমাজের অনেক রীতিনীতিই কল্পনা করা কঠিন হবে; তবে এখন যেহেতু স্পর্শেই বিপদ, সেহেতু এর বিকল্পগুলোর দিকেও নিশ্চয়ই অনেকের চোখ থাকবে।

বিকল্প তো আছেই। এখনও অনেকের সংস্কৃতিতে মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে, নিজের দুই হাতের তালু চেপে ধরে অপরকে সম্ভাষণ জানানোর চল আছে। আছে ‍হিন্দু রীতির ‘নমস্কার’, যা করোনাভাইরাস মহামারীর প্রথম থেকেই সারা দুনিয়ায় তুলনামূলক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

ভ্রু উঁচিয়ে ‘আইব্রো ফ্ল্যাশ’ ও হাসিমুখের সামোয়ান চর্চা কিংবা বেশ কিছু মুসলিম দেশে নিজের বুকের ওপর হাত রেখে শ্রদ্ধা জানানোর নিয়মও অনেকের অজানা নয়।

আছে হাওয়াইয়ের ‘শাকা সাইন’; যাতে মাঝের তিন আঙ্গুল নিচের দিকে বাঁকিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল ও কনিষ্ঠা প্রশস্ত করে হাত ঝাঁকিয়ে একে অপরকে স্বাগত জানানো যায়।

বিবিসির নিবন্ধে বলা হয়েছে, কেবল এবারই প্রথম মানুষে মানুষে স্পর্শকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, তা নয়। গত শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত অনেক মনোবিজ্ঞানী শিশুদের প্রতি স্নেহ দেখানোকে ‘অহেতুক আবেগ’ বলে অভিহিত করতেন।

স্পর্শের মাধ্যমে স্নেহের প্রদর্শনে ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি ও মনোদৈহিক সমস্যার বিস্তার ঘটতে পারে বলেও উদ্বেগ ছিল তাদের।

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের আচরণ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ভ্যাল কুর্টিস তার ‘ডোন্ট লুক, ডোন্ট টাচ’ বইতে বলেছেন, একজন আরেকজনকে জীবাণু ভাগাভাগি করে নেয়ার মতো যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য বিবেচনা করছে- এমন সংকেত দিতেই সম্ভবত মানুষের হ্যান্ডশেক ও গালে আদরের মতো আচরণগুলো সম্ভাষণের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

জনস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ থেকে মানুষ নানান চর্চা যেমন আত্মীকরণ করেছে, তেমনি অনেকগুলো বাদ দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

১৯২০ সালের দিকে আমেরিকান জার্নাল অব নার্সিংয়ে প্রকাশিত এক নিবন্ধে হাতকে ব্যাকটেরিয়া স্থানান্তরের অনুঘটক অভিহিত করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে চীনাদের মতো নিজের দুই হাতের তালু চেপে ধরে ঝাঁকিয়ে বন্ধুদের সম্ভাষণ জানানোর রীতিতে অভ্যস্ত হতে পরামর্শ দিয়েছিল।

সর্বশেষ ২০১৫ সালেও লস এঞ্জেলসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউসিএলএ) একটি হাসপাতাল তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রকে ‘হ্যান্ডশেক মুক্ত এলাকা’ ঘোষণা দিয়েছিল। যদিও তাদের ওই নীতির আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ৬ মাস।

বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি অনেক মুসলিম নারীও ধর্মীয় কারণ দেখিয়ে হাতে মেলানোর রীতি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন।

তবে এতসব সাবধানবাণী ও আপত্তির পরও গত শতকে হ্যান্ডশেকই বিশ্বজুড়ে মানুষে মানুষে সম্ভাষণের সবচেয়ে জনপ্রিয় রীতিতে পরিণত হয়।

ভালো খাবার, পানীয় এমনকী যৌনতা মস্তিষ্কের যে অংশে উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে ভালো হ্যান্ডশেক সেই অংশকে আরও কর্মক্ষম করে তুলতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণাতেও বলা হয়েছে।

করমর্দনের সেই জনপ্রিয়তাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে ডিসেম্বরের শেষদিকে চীনের হুবেই থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনাভাইরাস।

বিভিন্ন দেশ ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় দেওয়া বিধিনিষেধগুলো আস্তে আস্তে শিথিল করলেও সামাজিক দূরত্বের নির্দেশনা বহাল রাখায় ‘হ্যান্ডশেকের’ ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চয়তায় ঢেকে আছে।

“সত্যিকার অর্থে, মনে হয় না আমাদের আর হ্যান্ডশেক করা উচিত হবে। হাত না মেলালে কেবল যে করোনাভাইরাসের রোগ ঠেকাতে ভালো হবে, তাই নয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ইনফ্লুয়েঞ্জা পরিস্থিতিরও নাটকীয় উন্নতি ঘটতে পারে,” এপ্রিলে এমনটাই বলেছিলেন হোয়াইট হাউসের করোনাভাইরাস টাস্ক ফোর্সের সদস্য ড. অ্যান্থনি ফাউচি।

অর্থনীতি সচলে লকডাউন শিথিল হলেও সামাজিক দূরত্বের নির্দেশনা আরও অনেকদিন বহাল থাকতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নতুন নির্দেশনাগুলোতেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধ এবং ফুসফুসের রোগ, স্থূলতা কিংবা ডায়বেটিসে আক্রান্তদের মতো তুলনামূলক বেশি ঝুকিপূর্ণদের এ নির্দেশনা হয়তো অনেকদিন ধরেই মেনে চলতে হবে।

কারা কারা স্পর্শ করার অনুমতি পাবে, কারা পাবে না, আইসোলেশনে থাকবে- এমন পরিস্থিতি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলোতে থাকা দুঃস্বপ্নের বাতাবরণ হাজির করতে পারে বলে মনে করছেন ডেল মেডিকেলের ক্লিনিকাল ইন্টিগ্রেশন অ্যান্ড অপারেশনসের অ্যাসোসিয়েট চেয়ার স্টুয়ার্ট উলফ।

“এটা মনের উপর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে,” বলেছেন তিনি।

তাছাড়া করমর্দন মনুষ্য সমাজের চর্চায় এমনভাবে গেঁথে আছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্টকেও বছরে প্রায় ৬৫ হাজার বার হাত মেলাতে হয়, বলছে বিবিসি।

“অভ্যাস সহজে মরে না। তবে অন্যভাবে দেখলে, অভ্যাস এবং সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তন ঘটে তখনই যখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এক্ষেত্রে স্থাস্থ্যের বিষয়টাও যুক্ত করা যায়। মনে করুন, চীনে পায়ের পাতা ছোট রাখতে লোহার জুতা পরানোর বিষয়টি। সেটিও তাদের প্রাচীন রীতিই ছিল,” বলেছেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক এলক ওয়েবার।

স্পর্শ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক রীতিতে সংক্রমণ মোকাবেলায় সাফল্য এসেছে বলেও দেখাচ্ছেন অনেকে। মাথা ঝুঁকিয়ে সম্ভাষণের চল থাকায় থাইল্যান্ডে কোভিড-১৯ এ মৃত্যু অনেক কম হয়েছে বলেও মনে করছেন তারা।

টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লেগারে আবার অন্য একদিকেও দৃষ্টি দিতে বলেছেন। তার মতে, মানুষ যখন তীব্র চাপের মুখে পড়ে, তখন সে স্পর্শের কাঙাল হয়ে ওঠে।

“মনে করে দেখুন, কারও খারাপ কিছু হলে কিংবা কেউ মারা গেলে তার শোকার্ত আত্মীয়কে সান্তনা দিতে মানুষজন কী কী করে। হয় জড়িয়ে ধরে, নাহলে পাশে বসে কাঁধে হাত রাখে।”

এসব কারণে স্পর্শ ছাড়া মানুষে মানুষে সংযোগের রীতি সহজে প্রচলিত হবে না বলেও ধারণা তার।

জনস্বাস্থ্য বিশেষ করে সংক্রামক রোগ নিয়ে কাজ করা ডেলিয়ানা গার্সিয়া নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করেছেন।

গার্সিয়া জানান, হ্যান্ডশেকের চর্চা ছেড়ে দিতে পারলেও ৮৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ মা’কে জড়িয়ে ধরার ব্যাপারে এখনও দ্বিধায় ভোগেন তিনি।

“যখন তিনি এগিয়ে আসেন, আমার উদ্বেগ বাড়ে- আমি না তাকে অসুস্থ করে ফেলি। তাই আমি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। নিজেকে আশ্বস্ত করতে তার স্পর্শ প্রয়োজন আমার, এরপরও আমি তার কাছে ঘেঁষি না। আমরা চুম্বকের দুই মেরুর মতো আলাদা আলাদা থাকি,” বলেছেন তিনি।

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়েবার বলছেন, যত কষ্টই হোক না কেন এখন থেকেই বিকল্পের সন্ধান করা উচিত।

“আমার মনে হয় না, মানুষজন মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাবে। টিকে থাকা কিংবা বেঁচে থাকার চেষ্টাও মানুষের এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম মৌলিক চরিত্র,” ভাষ্য তার।

তবে হ্যান্ডশেকের আশা এখনই ছেড়ে দিতে নারাজ টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আর্থার মার্কম্যান।

“হয়তো আমাদের বেশি বেশি হাত ধোয়া, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দিকে নজর বাড়াতে হবে; একে অপরের সংস্পর্শ এড়ানোর বদলে নিজেদের মুখে হাত না দেয়ার কৌশল রপ্ত করতে হবে,” বলেছেন তিনি।