করোনাভাইরাস: প্রথম সতর্ক করা চিকিৎসকও বাঁচলেন না

নতুন করোনাভাইরাসের আশঙ্কার দিক তুলে ধরে যে চিকিৎসক প্রথম সহকর্মীদের সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন, সেই লি ওয়েনল্যাংও মারা গেলেন প্রাণঘাতী এই ভাইরাস।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2020, 03:33 AM
Updated : 17 April 2020, 05:11 PM

বিবিসি জানায়, লি ওয়েনল্যাংয়ের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে গভীর রাতে চীনা সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক বিভ্রান্তি শেষে উহান সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাত ২টা ৫৮ মিনিটে তার মৃত্যু হয়েছে।     

এ হাসপাতালেরই চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছিলেন লি ওয়েনল্যাং, হাসপাতালে কাজ করার সময় রোগীদের মাধ্যমে তিনি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন। লি বলেছিলেন, সুস্থ হয়ে ওঠার পর তিনি আবারও এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামনের কাতারে থাকতে চান।

৩৪ বছর বয়সী লি গত ৩০ ডিসেম্বর লি এক বার্তায় তার সহকর্মীদের বলেছিলেন, নতুন এ করোনাভাইরাস নিয়ে সতর্ক হওয়া জরুরি। আর সেজন্য চীনা কর্তৃপক্ষ তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল মুচলেকা আদায় করে।  

চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রাণ সংহারী নতুন করোনাভাইরাসে সেখানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৩৬ জনে। চীনের বাইরে মারা গেছে আরও দুজন।

কেবল চীনের মূল ভূখণ্ডেই নভেল বা নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ১৬১। চীনের বাইরে আরও অন্তত ২৫টি দেশ ও অঞ্চলে আড়াইশর বেশি মানুষ এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে।

উহানের বীর

গত ডিসেম্বরের শেষে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে নিউমোনিয়ার মত উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন বেশ কয়েকজন রোগী। উহান সেন্ট্রাল হসপিটালে কাজ করা সময় এ ভাইরাসে সংক্রমণের সাতটি ঘটনা পান লি ওয়েনল্যাং। তার কাছে এই ভাইরাসটিকে দেখতে সার্সের মতোই মনে হয়, যেটা ২০০৩ সালে বিশ্বজুড়ে মহামারীর রূপ নিয়েছিল।

ভাইরাসটি নিয়ে সতর্ক করে সংক্রমণ এড়াতে গত ৩০ ডিসেম্বর সহকর্মী চিকিৎসকদের ‘প্রতিরক্ষামূলক পোশাক’ পরার পরামর্শ দিয়ে একটি চ্যাট গ্রুপে পোস্ট দিয়েছিলেন ডা. লি। তখন তিনি জানতেন না যে এ রোগটির কারণ সম্পূর্ণ নতুন এক করোনাভাইরাস, যাকে এখন বলা হচ্ছে নভেল করোনাভাইরাস বা ২০১৯-এনসিওভি।

চার দিন পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা তার কাছে ছুটে যান। একটি মুচলেকায় তার স্বাক্ষর নেন, যেখানে তার বিরুদ্ধে ‘সামাজিক শৃঙ্খলায় মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টিকারী মিথ্যা মন্তব্য’ করার অভিযোগ আনা হয়।

সেখানে বলা হয়, “আমরা আপনাকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিচ্ছি: আপনি যদি অধৈর্য হয়ে জেদ ধরে এমন অবৈধ কার্যকলাপ চালিয়ে যান, তাহলে আপনাকে বিচারের আওতায় আনা হবে- বুঝেছেন?”

এর নিচে ডা. লির হাতে লেখা: “হ্যাঁ, আমি বুঝেছি।”

শুধু তিনিই নন, ‘গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে আরও সাতজনের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে বলে তখন জানিয়েছিল পুলিশ।

জানুয়ারির শেষ দিকে চীনা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম উইবুতে ওই মুচলেকা প্রকাশ করে ঘটনাটি ব্যাখ্যা করেন ডা. লি। এর মধ্যেই তার কাছে ক্ষমা চায় স্থানীয় প্রশাসন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

জানুয়ারির প্রথম কয়েক সপ্তাহে উহানের কর্মকর্তারা বলে আসছিলেন, কেবল সংক্রমিত প্রাণীর সংস্পর্শে এলেই মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য তখনও কোনো নির্দেশনা জারি করা হয়নি।

পুলিশ যাওয়ার এক সপ্তাহ পর ডা. লি গ্লুকোমা আক্রান্ত এক নারীর চিকিৎসা করেন। তিনি তখন জানতেন না ওই নারী নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।

পরে অসুস্থ অবস্থায় লি উইবুতে এক পোস্টে জানান, ১০ জানুয়ারি তিনি কাশতে শুরু করেন, পরদিন তার জ্বর আসে; দুদিন পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার বাবা-মা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদেরও হাসপাতালে নেওয়া হয়।

ওই ঘটনার ১০ দিন পর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে ‘জরুরি অবস্থা’ হিসেবে ঘোষণা করে চীন।

ডা. লি জানিয়েছিলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কি না তা জানতে তাকে বেশ কয়েকবার পরীক্ষা করা হয়েছিল, তবে প্রতিবারই ফল আসে ‘নেগেটিভ’, মানে ভাইরাস পাওয়া যায়নি।

পরে ৩০ জানুয়ারি তিনি আরেক পোস্টে লেখেন, “আজ নিউক্লিক এসিড টেস্ট ‘পজেটিভ’ রেজাল্ট নিয়ে এসেছে; ধোঁয়াশা কেটে গেছে; শেষ পর্যন্ত রোগ নির্ণয় হয়েছে।”

চোখ উল্টে যাওয়া ও জিহ্বা বের করা একটি কুকুরের ইমোজি দিয়ে তিনি পোস্টটি শেষ করেন। অবাক হওয়ার কারণ নেই যে, এই পোস্টে হাজার হাজার মন্তব্য ও লাইক পড়েছিল।

দেশকে নিয়ে মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া কী হবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেও এক চীনা মন্তব্য করেছেন, “সংক্রামক রোগের লক্ষণ নিয়ে প্রাথমিকভাবে সতর্ক করতে ভবিষ্যতে চিকিৎসকরা আরও ভয় পাবেন।

“ডা. লি ওয়েনল্যাং একজন বীর। নিরাপদ জনস্বাস্থ্য পরিবেশের জন্য এরকম কয়েক লাখ লি ওয়েনল্যাং দরকার।”

 

মৃত্যু নিয়ে খবরে বিভ্রান্তি

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সবার আগে ডা. লির মৃত্যুর খবর দেয় চীনের গ্লোবাল টাইমস। ওই খবর উইবুতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। পিপলস ডেইলি এক টুইটে জানায়, ডা. লির মৃত্যুতে পুরো চীনা জাতি শোকাহত।

কিন্তু গ্লোবাল টাইমস পরে মৃত্যুর খবর প্রত্যাহার করে নিয়ে জানায়, ওই চিকিৎসক সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন। কৃত্রিমভাবে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা এবং হৃদযন্ত্র সচল রাখার ব্যবস্থা হয়েছে।  

ওই সময় হাসপাতালে থাকা চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের বরাত দিয়ে বিবিসি লিখেছে, ডা. লির মৃত্যুর খবর নিয়ে কর্মকর্তারা ‘হস্তক্ষেপ’ করেছিলেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমগুলোকে বলা হয়েছিল- লিখতে হবে ডাক্তাররা এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

কয়েক ঘণ্টা পর চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমগুলো আবারও লি ওয়েনল্যাংয়ের মৃত্যুর খবর দেয়, তবে এবার নতুন একটি সময় জানানো হয়।