করোনাভাইরাস নিয়ে সতর্ক করায় মুচলেকা দিতে হয় চিকিৎসককে

জানুয়ারির গোড়ার দিকেই নতুন করোনাভাইরাসের খবর পেয়েছিল চীনের উহানের কর্তৃপক্ষ। তাতে পাত্তা না দিয়ে উল্টো যেই চিকিৎসক ভাইরাসটি নিয়ে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন তার মুখ বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Feb 2020, 08:22 AM
Updated : 4 Feb 2020, 12:59 PM

মাসখানেকের ব্যবধানে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চার শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ও সংক্রমণ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাওয়ার পর বিষয়টি জানাজানি হলে এখন সেই চক্ষু চিকিৎসক ‘বীর’ হিসেবে প্রসংশিত হচ্ছেন।

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিকে স্থানীয় প্রশাসন যে কতটা অবহেলা করেছে, তা এই ঘটনায় ‘চমকপ্রদভাবে’ ফুটে উঠেছে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

উহান কেন্দ্রীয় হাসপাতালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ লি ওয়েনল্যাং যখন ভাইরাসটি নিয়ে সহকর্মীদের সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন, খবর পেয়ে পুলিশ এসে তখন তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছিল। একমাস পর হাসপাতালের বিছানা থেকে ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পোস্ট করে বাহবা কুড়াচ্ছেন তিনি।

নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্রে কাজ করা সময় গত ডিসেম্বরে সংক্রমণের সাতটি ঘটনা পান এই চিকিৎসক। তার কাছে এই ভাইরাসটিকে দেখতে সার্সের মতোই মনে হয়েছে, যেটা ২০০৩ সালে বিশ্বজুড়ে মহামারীর রূপ নিয়েছিল। উহানের হুনান সিফুড মার্কেট থেকে সংক্রমিত ধরে নিয়ে এসব রোগীকে হাসপাতালের কোয়ারেন্টিন করে রাখা হয়।

ভাইরাসটি নিয়ে সতর্ক করে সংক্রমণ এড়াতে ‘প্রতিরক্ষামূলক পোশাক’ পরার পরামর্শ দিয়ে একটি চ্যাট গ্রুপে সহকর্মী চিকিৎসকদের কাছে ৩০ ডিসেম্বর বার্তা দিয়েছিলেন ডা. লি। তখন তিনি যেটা জানতেন না তা হল- যে রোগটি ধরা পড়েছে সেটি সম্পূর্ণ নতুন একটি করোনাভাইরাস।

চারদিন পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা তার কাছে ছুটে যান। একটি মুচলেকায় তার স্বাক্ষর নেন, যেখানে তার বিরুদ্ধে ‘সামাজিক শৃঙ্খলায় মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টিকারী মিথ্যা মন্তব্য’ করার অভিযোগ আনা হয়।

“আমরা আপনাকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিচ্ছি: আপনি যদি অধৈর্য হয়ে জেদ ধরে এমন অবৈধ কার্যকলাপ চালিয়ে যান, তাহলে আপনাকে বিচারের আওতায় আনা হবে- বুঝেছেন?” এর নিচে ডা. লির হাতে লেখা: “হ্যাঁ, আমি বুঝেছি।”

শুধু তিনিই নন, ‘গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে আরও সাত জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে বলে তখন পুলিশ বলেছিল।

জানুয়ারির শেষের দিকে চীনা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ওয়েইবোতে ওই মুচলেকা প্রকাশ করে ঘটনাটি ব্যাখ্যা করেন ডা. লি। এর মধ্যেই তার কাছে ক্ষমা চায় স্থানীয় প্রশাসন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

জানুয়ারির প্রথম কয়েক সপ্তাহ ধরে উহানের কর্মকর্তারা বলে আসছিলেন, কেবল সংক্রমিত প্রাণীর সংস্পর্শে এলেই মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হবে। চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য তখনও কোনো নির্দেশনা জারি করা হয়নি।

কিন্তু পুলিশ তার কাছ থেকে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে ডা. লি গ্লুকোমা আক্রান্ত এক নারীর চিকিৎসা করেন। তিনি তখন জানতেন না ওই নারী নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন।

ওয়েইবো পোস্টে লি লিখেছেন, ১০ জানুয়ারি তিনি কাশতে শুরু করেন, পরের দিন তার জ্বর হয়; দুদিন পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার বাবা-মা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদেরও হাসপাতালে নেওয়া হয়।

এঘটনার ১০ দিন পর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করেছিল চীন।

ডা. লি বলেন, করোনাভাইরাসের জন্য তাকে বেশ কয়েকবার পরীক্ষা করা হয়েছিল, প্রতিবারই ফল নেতিবাচক এসেছিল অর্থাৎ ভাইরাস পাওয়া যায়নি।

পরে ৩০ জানুয়ারী তিনি আরেকটি পোস্টে লেখেন, “আজ নিউক্লিক অ্যাসিড টেস্ট ইতিবাচক ফল নিয়ে এসেছে; ধোঁয়াশা কেটে গেছে; শেষ পর্যন্ত রোগ নির্ণয় হয়েছে।”

চোখ উল্টে যাওয়া ও জিহ্বা বের করা একটি কুকুরের ইমোজি দিয়ে তিনি পোস্টটি শেষ করেন। অবাক হওয়ার কারণ নেই যে, এই পোস্টে হাজার হাজার মন্তব্য ও লাইক পড়েছিল।

দেশকে নিয়ে মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া কী হবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেও এক চীনা মন্তব্য করেছেন, “সংক্রামক রোগের লক্ষণ নিয়ে প্রাথমিকভাবে সতর্ক করতে ভবিষ্যতে চিকিৎসকরা আরও ভয় পাবেন।

“ডা. লি ওয়েনল্যাং একজন বীর। নিরাপদ জনস্বাস্থ্য পরিবেশের জন্য এরকম কয়েক লাখ লি ওয়েনল্যাং দরকার।”