মুম্বাইয়ের ‘নরক’ মাহুলে ধুঁকছে প্রাণ

ভারতের বাণিজ্য নগরী মুম্বাইয়ের বস্তিগুলো ভেঙ্গে দিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের নামে পাঠানো হচ্ছে মাহুলে। ভারি শিল্পাঞ্চল মাহুলের পরিবেশ এতটাই দূষিত যে সেখনকার বাসিন্দারা পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে।

নিউজডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2018, 12:01 PM
Updated : 29 Dec 2018, 12:02 PM

মুম্বাইয়ের ‘টক্সিক হেল’ নামে পরিচিত মাহুলে পাঁচ হাজারের বেশি পরিবারের ৩০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের বাস।

এইসব পরিবারগুলোর বেশিরভাগই মুম্বাইয়ে ভেঙ্গে দেওয়া বস্তির বাসিন্দা ছিলেন। অল্প কিছুদিনের জন্য এখানে বাস করতে হবে বলে প্রশাসন তাদের মাহুলের ‘অস্থায়ী শিবিরগুলোতে’ নিয়ে আসে বলে জানায় বিবিসি।

এমন একজন অনিতা দোল (৩৮), যিনি মুম্বাইয়ে তানসা পাইপলাইনে কাছের অবৈধভাবে গড়ে উঠা একটি বস্তিতে বসবাস করতেন। ওই বস্তি ভেঙ্গে দেওয়ার পর ২০১৭ সালের মে মাস থেকে তিনি মাহুলে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন।

তিনি বিবিসিকে বলেন, “আমি শ্বাসকষ্ট ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছি। দুষণের কারণে আমার দৃষ্টিশক্তিও কমে গেছে।”

প্রশাসন তাদের মুম্বাই উপকণ্ঠে অন্য কোথাও বসবাসের জায়গা করে দেবেন বলে আপাতত মাহুলে যেতে বলেছেন বলেও জানান অনিতা।

“মাহুলে এসে বুঝলাম এই জায়গা অল্প সময়ের জন্য বাসবাসের উপযুক্তও নয়।”

এক সময় জেলেদের গ্রাম ছিল মাহুল। এখানে এখন একাধিক তেল ও প্রেট্রোলিয়াম শোধনাগার, রাসায়নিক কারখানা এবং সার করখানা রয়েছে।

কিং এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল হাসপাতালের ২০১৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাহুলে বসবাস করা ৬৭ শতাংশ মানুষ শ্বাসকষ্টে ভুগছেন এবং শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে মাসে কয়েকবার তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন।

৮৪ শতাংশ মানুষ চোখে জ্বলা ও চুলকানিসহ দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন।

ভারতের পরিবেশ আদালত ‘ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল’ ২০১৫ সালের এক রায়ে ‘মারাত্মক বায়ু দূষণের কারণে’ মাহুলের বাসিন্দাদের ‘স্বাস্থ্য নিশ্চিত হুমকির মুখে’ বলেছিল। শ্বাসকষ্ট ছড়াও সেখানকার বাসিন্দারা চর্ম রোগ, যক্ষ্মা, হাঁপানি এবং উচ্চরক্তচাপ জনিত রোগে ভুগছেন।

অনিতা বলেন, তারা বাবা-মাও আগে তার সঙ্গে থাকতেন। কিন্তু মাহুলে এসে তারা প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ায় গ্রামে চলে গেছেন।

গত বছর মাহুলে আসা শ্যামদাস নামে অন্য একজন বলেন, তার দুই বছরের ছেলে গত পাঁচ মাস ধরে মারাত্মক চর্মরোগে ভুগছে।

“সে রাতভর কাঁদতে থাকে আর শরীর চুলকাতে থাকে। আমি অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, ওষুধ পাল্টেছি। কিন্তু কোনো উপকার হয়নি। এখন তার মুখেও ফুসকুড়ি উঠতে শুরু করেছে।”

তার এক প্রতিবেশীর ১০ বছরের ছেলের যক্ষ্মা হয়েছে এবং অনেকেই অল্প বয়সে হাঁপানিতে ভুগছে বলেও জানান তিনি।

দূষণ ছাড়াও এখানকার বাসিন্দারা পরিষ্কার পানি ও পয়োনিষ্কাশন সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। মাহুলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। আশেপাশে কোনো হাসপাতাল বা স্কুল নেই।

এছাড়া, মাহুলের সঙ্গে নগরীর অন্যান্য এলাকার চলাচল ব্যবস্থাও ভালো না হওয়ায় অনেকেই বিশেষ করে নারীরা চাকরি ছেড়ে ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। মাহুলে পুনর্বাসনের জন্য নিয়ে আসা পরিবারগুলো এককক্ষের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে বাস করতে দেওয়া হয়।

অ্যাপার্টমেন্ট প্রাঙ্গন অত্যন্ত নোংরা। সেখানে পয়োনিষ্কাশন পাইপ ভাঙ্গা, ড্রেনগুলো থেকে ময়লা উপচে পড়ছে। বিদ্যুতের তার ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঝুলে আছে। সেখানে বাতাস এত ভারি যে নিঃশ্বাস নেওয়াই দায়, চারিদিকে মশা ও ইঁদুরের উৎপাত।

জীবিকার তাগিদে প্রতি বছর হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ গ্রাম ছেড়ে মুম্বাই পাড়ি জমায়, যাদের ঠাঁই হয় বস্তিতে। প্রশাসন ওইসব বস্তি ভেঙ্গে দিয়ে দরিদ্র মানুষগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে ‘নরকে’।

যেসব দরিদ্র পরিবারকে মাহুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগই তানসা পাইপলাইনে কাছের বস্তিগুলোতে বসবাস করতেন।

মুম্বাইয়ের ভেতর দিয়ে যাওয়া ১৬০ কিলোমিটার লম্বা ওই পাইপগুলো দিয়ে তানসা হ্রদ থেকে পানি আনা হয়, যা নগরীটির বাসিন্দাদের পানির অন্যতম উৎস।

পাইপগুলো মাটির নিচে থাকার কথা থাকলেও সেগুলোর অর্ধেটাই মাটির উপরে। ওইসব পাইপের গা ঘেঁষে বা কোথাও কোথাও পাইপের উপরেই বস্তি গড়ে উঠেছিল।

‘যেহেতু মুম্বাইয়ের নাগরিকরা এই পানি ব্যবহার করে তাই তাদের নিরাপত্তা এবং কেউ যেন এই পাইপ ব্যবহার করে ‍পুরো মুম্বাইয়ে আক্রমণ করতে না পারে’ তার জন্য ২০০৬ সালে  হাই কোর্টে একটি পিটিশন দায়ের করে  পাইপের আশেপাশে গড়ে উঠা বস্তি সরিয়ে ফেলতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়ার  আবেদন করা হয়।

২০০৯ সালে দেওয়া রায়ে হাই কোর্ট পাইপলাইন থেকে সবচেয়ে কাছের বসতির মধ্যে অন্তত ১০ মিটার ফাঁক রাখার আদেশ দেয়।

ওই রায়ের পর প্রশাসন বস্তি ভেঙ্গে দিলে হাজার হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে, যাদের মাহুলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়।

এখন মাহুলের বাসিন্দারা নিজেদের প্রাণের দায়ে আবারও পুনর্বাসনের দাবিতে অনলাইনে পিটিশন দায়ের করেছেন।

এ বছর অগাস্টে আদালত, প্রশাসনকে জোর করে মাহুলে লোকজনকে পাঠানো বন্ধ করার নির্দেশ দেন এবং তাদের জন্য বিকল্প বাড়ির ব্যবস্থা করতে বলেন, নতুবা তাদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার নির্দেশ দেন।

অনলাইনেও ‘মুম্বাইসটক্সিকহেল’ হ্যাশট্যাগে আন্দোলন শুরু হয়েছে।