এই বিশ্ব সংস্থার সাবেক কয়েকজন কর্মী এবং ত্রাণকর্মীদের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, মানবাধিকার কর্মীরা যাতে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে যেতে না পারেন, সেই চেষ্টা করেছিলেন মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক।
তবে মিয়ানমারে জাতিসংঘ দপ্তর বিবিসির প্রতিবেদনে আসা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
রাখাইনে সাম্প্রতিক সেনা অভিযানের পর গত এক মাসে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। চলমান এই সঙ্কটে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ এখন আছে সামনের কাতারে।
জাতিসংঘ সংস্থাগুলো বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে জোর ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে। এ সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা কড়া ভাষায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ভূমিকার সমালোচনা করছেন; রাখাইনের সেনা অভিযানকে তারা বর্ণনা করছেন জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে।
কিন্তু বিবিসি বলছে, চার বছর আগে রোহিঙ্গা সঙ্কট যখন আজকের অবস্থায় পৌঁছেনি, মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রেনেটা লক-ডেসালিয়েনের (২০০৭-০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তিনি বাংলাদেশে একই দায়িত্বে ছিলেন) ভূমিকা তখন ছিল অন্যরকম।
>> রেনেটা লক-ডেসালিয়েন রোহিঙ্গাদের এলাকায় মানবাধিকার কর্মীদের যাতায়াত আটকাতে চেয়েছিলেন।
>> প্রকাশ্যে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আলোচনা বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন।
>> রাখাইনে জাতিগত নির্মূল অভিযানের ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার বিষয়ে যিনি সতর্ক করার চেষ্টা করেছেন, তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাখাইনের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা তখনই আঁচ করতে পেরেছিলেন মিয়ানমারে জাতিসংঘের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসা ক্যারোলাইন ভ্যান্ডেনাবিলে। ১৯৯৩-৯৪ সালে রুয়ান্ডায় গণহত্যার পরপরই সেখানে কাজ করার অভিজ্ঞতা তার হয়েছিল। ২০১৩ সালে মিয়ানমারে গিয়ে রাখাইনেও একই ধরনের উদ্বেগজনক লক্ষণ তিনি দেখতে পান।
ভ্যান্ডেনাবিলে বিবিসিকে বলেছেন, মিয়ানমারে দায়িত্বে যোগ দেওয়ার পরপরই একদল বিশেষজ্ঞের সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের এক বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন তিনি, যেখানে রাখাইন ও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ আসে।
“বার্মিজ একজন ওই বৈঠকে বলেন, রোহিঙ্গাদের সবাইকে কুকুরের মত মেরে ফেলা উচিৎ। মানুষের এরকম অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি হল একটা লক্ষণ। এর মানে হল, সমাজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে এসব স্বাভাবিক হিসেবেই গণ্য হতে পারে।”
২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের অফিসে প্রধান কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন ক্যারোলাইন ভ্যান্ডেনাবিলে। আর ২০১৪ সাল থেকে সেখানে আবাসিক সমন্বয়কের দায়িত্বে আছেন রেনেটা লক-ডেসালিয়েন।
সেই সময়ে মিয়ানমারের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিবিসি লিখেছে, ২০১২ সালে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সঙ্গে রাখাইনের বৌদ্ধদের সংঘাতে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়, এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় নেয় রাজ্যের রাজধানী সিটুয়ে।
তারপর থেকে কিছুদিন পরপরই রাখাইনে উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। গতবছর হঠাৎ করেই রোহিঙ্গাদের নতুন একটি বিদ্রোহী দলের আবির্ভাব ঘটেছে, যাদের গত ২৪ অগাস্ট রাতের পুলিশ পোস্টে হামলার জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টাও সাম্প্রতিক সময়ে কঠিন করে তুলেছে রাখাইনের বৌদ্ধরা। তারা ত্রাণকর্মীদের যেতে বাধা দিচ্ছে, কখনও কখনও ত্রাণের বহরে হামলাও করছে।
এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ ও সাহায্যকারী সংস্থাগুলোর জন্য মিয়ানমার সরকার ও বৌদ্ধদের সঙ্গে সমন্বয় করে রোহিঙ্গাদের এলাকায় জরুরি সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়ে উঠেছে যথেষ্ট জটিল।
সেই সঙ্গে এটাও তাদের ভাবতে হয়েছে যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা তা ভালোভাবে নেবে না।
ফলে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তখন দীর্ঘমেয়াদী কৌশল ঠিক করে সে অনুযায়ী অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাতে রাখাইনে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় এই আশায় যে, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটলে হয়ত রোহিঙ্গা মুসলমানদের সঙ্গে বৌদ্ধদের উত্তেজনাও থিতিয়ে আসবে।
জাতিসংঘের কর্মীদের ক্ষেত্রে এই ‘দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের’ অর্থ দাঁড়ায় অন্যরকম। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
সে সময় জাতিসংঘের অনেক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রোহিঙ্গা শব্দটিই এড়িয়ে যাওয়া হত, কারণ মিয়ানমার সরকার তাদের আলাদা নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি রাজি নয়। সরকারের ভাষায়, রোহিঙ্গারা হল ‘বাঙালি’ এবং তারা ‘অবৈধ অভিবাসী’।
এমনকি নিজেদের মধ্যে রূদ্ধদ্বার বৈঠকেও তারা রোহিঙ্গাদের সমস্যার বিষয়টি এড়িয়ে যেতেন বলে জাতিসংঘের এক অভ্যন্তরীণ তদন্তে উঠে এসেছে।
বিভিন্ন সাহায্যকারী সংস্থার একাধিক প্রতিনিধির বরাত দিয়ে বিবিসি দাবি করেছে, মিয়ানমারে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা সে সময় ছিল ‘একপ্রকার অসম্ভব’।
ভ্যান্ডেনাবিলে বিবিসিকে বলেন, এক পর্যায়ে তাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, রোহিঙ্গা সঙ্কট বা তাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের চেষ্টা নিয়ে বৈঠকে কোনো কথা বলা যাবে না।
“আপনি হয়ত কথা বলতে পারেন, কিন্তু তার ফল ভালো হবে না। হয়ত আপনাকে মিটিংয়ে রাখা হবে না, আপনার ভ্রমণ অনুমতির কাগজ আটকে যাবে। এমনকি এজন্য অনেক কর্মীকে কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, কাউকে কাউকে মিটিংয়ে হেনস্তা করা হয়েছে। এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে কোনো কথা না হয়।”
ভ্যান্ডেনাবিলে অভিযোগ করেছেন, ইউএন অফিস ফর কোঅর্ডিনেশন ফর হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসিসট্যান্সের (ইউএনওসিএইচএ) কর্মীদের অনেক আলোচনায় রাখা হত না ওই কারণেই। বেছে বেছে এমন সময় বৈঠকের তারিখ ফেলা হত যখন ইউএনওসিএইচএ-এর সমন্বয়ক শহরে থাকতেন না।
বিবিসি লিখেছে, মিয়ানমারে ইউএনওসিএইচএ-এর সমন্বয়ক এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে জাতিসংঘের একাধিক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে ভ্যান্ডেনাবিলের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।
ভ্যান্ডেনাবিলের অভিযোগ, রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের চেষ্টা নিয়ে একাধিকবার সতর্ক করতে যাওয়ার কারণে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘ঝামেলাবাজ’ হিসেবে, দায়িত্ব সরিয়ে দিয়ে তাকে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে।
এমনকি জাতিসংঘের যে কর্মকর্তারা সে সময় মিয়ানমার সফরে গেছেন, তাদের ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে কথা বলা বারণ ছিল।
“আমাকে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, রাখাইনে যাওয়া আমার উচিৎ হবে না, সুতরাং আমি যেন সেখানে না যাই। আমি এর কারণ জানতে চাইলাম… বিষয়টা ছিল আসলে এরকম, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো ধরনের বিরোধে জড়ানো যাবে না।”
নিষেধের পরও কুইনতানা রাখাইনে গিয়েছিলেন। এর ফলে তার মিশনের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন আবাসিক সমন্বয়ক ডেসালিয়েন। মিয়ানমারে তাদের আর কখনও দেখা হয়নি।
জাতিসংঘের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বিবিসি লিখেছে, “আমরা রাখাইনে দূতিয়ালি করছি রোহিঙ্গাদের জীবনের দামে। সরকার জানে, আমাদের ব্যবহার করে কীভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। আামরা কখনোই শিখব না। আর আমরা কখনও দাঁড়াতেও পারব না, কারণ আমরা সরকারকে চটাতে চাই না।”
রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে ২০১৫ সালে জাতিসংঘের করা একটি প্রতিবেদন ফাঁস হওয়ার পর তা হাতে পাওয়ার কথা জানিয়েছে বিবিসি।
‘স্লিপারি স্লোপ: হেলপিং ভিকটিমস অর সাপোর্টিং সিস্টেম অব অ্যাবিউস’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে মিয়ানমারে জাতিসংঘ দপ্তরের রোহিঙ্গা নীতির কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।
“জাতিসংঘের কান্ট্রি টিম অতি সরলীকৃত এক ধারণা থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো দেখছে। তারা মনে করছে, উন্নয়ন হলেই ওই এলাকার উত্তজেনা কমে আসবে। কিন্তু তারা এটা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছে যে পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের পরিচালিত পক্ষপাতদুষ্ট একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ করার অর্থ হল বৈষম্যকেই আরও পোক্ত করা।”
ওই খবর প্রকাশিত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর জাতিসংঘ ডেসালিয়েনকে মিয়ানমারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। কিন্তু তারপর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও তিনিই মিয়ানমারে জাতিসংঘের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন, কারণ তার বদলে জাতিসংঘ মনোনীত নতুন সমন্বয়ককে নিয়ে মিয়ানমার সরকার আপত্তি তুলেছে।
মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাবেক সেনা কর্মকর্তা সোয়ে মান বিবিসিকে বলেছেন, “ডেসালিয়েন পক্ষপাত করেন না। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কারও পক্ষপাত থাকলে আমরা তাকে মেনে নেব না, তার সমালোচনা করব।”
আর বিবিসির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে মিয়ানমারে জাতিসংঘ দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেন, “আমাদের আবাসিক সমন্বয়ক অভ্যন্তরীণ আলোচনায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন- এমন অভিযোগের বিষয়ে আমরা দৃঢ়ভাবে দ্বিমত প্রকাশ করছি। শান্তি, নিরাপত্তা, মানবাধিকার, উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর আলোচনার ওপর আমাদের আবাসিক সমন্বয়ক সব সময়ই জোর দিয়ে আসছেন।
টমাস কুইনতানার রাখাইন সফরের বিষয়ে ডেসালিয়েনের মুখপাত্রের ভাষ্য, তার ওই সফরে পূর্ণ সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে কান্ট্রি টিমের পক্ষ থেকে।
আবার এমন লোকও আছেন, যারা শ্রীলঙ্কায় জাতিসংঘের বিতর্কিত ভূমিকার সঙ্গে মিয়ানমারের ঘটনাপ্রবাহের মিল খুঁজে পাচ্ছেন।
২০০৭ সালে মিয়ানমার থেকে বহিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানে জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা ব্রিটিশ কূটনীতিক চার্লস পেট্রিয়ে বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ বিশ্ব সংস্থার ভূমিকা বিভ্রান্তিকর। আবার সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিক একসঙ্গে দেখার দায়িত্বও ডেসালিয়েনকে দেওয়া হয়নি।
“আমার মনে হয়, মিয়ানমার আর শ্রীলঙ্কায় ফোকাল পয়েন্ট না থাকার দুর্বলতাটাই আমাদের শেখার সবচেয়ে বড় জায়গা। এমন একজন সিনিয়র ফোকাল পয়েন্ট থাকতে হবে, যিনি একইসঙ্গে রাজনৈতিক, মানবাধিকার, মানবিক সহায়তা ও উন্নয়নের দিকগুলোতে সাড়া দিতে সক্ষম। মিয়ানমারে তা হয়নি।”
তাহলে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সঙ্কটকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেই কি এই মানবিক সঙ্কট এড়ানো যেত?
ভ্যান্ডেনাবিলে বলছেন, কী করলে আজকের পরিস্থিতি এড়ানো যেত তা বলা কঠিন। তবে তিনি রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে যে আগাম সংকেত দিয়েছিলেন, তাতে গুরুত্ব দেওয়া হলে হয়ত আগে থেকে বোঝা যেত- কী ঘটতে যাচ্ছে।