প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে গেল যুক্তরাষ্ট্র

নির্বাচনী প্রচারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরিয়ে নেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2017, 04:11 AM
Updated : 2 June 2017, 11:16 AM

বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে এক বক্তৃতায় তিনি এ ঘোষণা দেন বলে বিবিসির খবর।

যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ১৮৮টি দেশের ঐকমত্যে ২০১৫ সালে প্যারিসে ওই জলবায়ু চুক্তি হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি এমন পর্যায়ে বেঁধে রাখার উদ্যোগে নেওয়া হবে, যাতে তা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না হয়।

হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেন, এর মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন ‘ভবিষ্যৎকে প্রত্যাখ্যান’ করলো। ২০১৫ সালে যখন প্যারিস চুক্তি হয়, ওবামা ছিলেন সামনের কাতারে।

ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রযুক্তি উদ্যেক্তা ইয়ন মাস্ক যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

ডেমোক্রেট নেতারা ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করলেও একে স্বাগত জানিয়েছেন রিপাবলিকান দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা।

গত বছর নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকেই প্যারিস চুক্তির বিরোধিতা করে আসছেন ট্রাম্প।  তার ভাষ্য, এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও কয়লা শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ক্ষমতায় আসার পরপরই চুক্তি থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।

বৃহস্পতিবার সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, “আমেরিকা এবং এর নাগরিকদের রক্ষায় আমার উপর যে পবিত্র দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, তার অংশ হিসেবে আমি ঘোষণা দিচ্ছি- প্যারিসে স্বাক্ষরিত জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।”

ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তিকে আখ্যায়িত করেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবেই অন্যায্য একটি চুক্তি হিসেবে। এর বদলে নতুন একটি ‘ন্যায্য’ চুক্তির জন্য দর-কষাকষি চালানোর কথা বলেন তিনি, যা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও কর্মীদের ক্ষতির কারণ হবে না।

প্যারিস চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ৩ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ৬৫ লাখ চাকরি হাতছাড়া হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। এসব কারণে অর্থনৈতিকভাবে দেশটির প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ভারত লাভবান হচ্ছে বলেও মন্তব্য তার।

“আমরা চাই না অন্য নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে হাসুক, এখন থেকে তারা আর হাসতেও পারবে না,” বলেন ট্রাম্প।

নির্বাচনী প্রচারের মত এদিনও ‘আমেরিকাই প্রথম’ নীতিতে এগুচ্ছেন বলে ভক্ত-সমর্থকদের আশ্বস্ত করেন তিনি।

বলেন, “আমি নির্বাচিত হয়েছি পিটসবুর্গের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে, প্যারিসের নয়। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যেসব চুক্তি আমেরিকার স্বার্থের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, আমি সেসব চুক্তি থেকে হয় বেরিয়ে যাব অথবা নতুন করে দরকষাকষি শুরু করবো।“

বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়াঃ

ট্রাম্পের নতুন চুক্তির প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্র ফ্রান্স। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ এক টেলিভিশন বক্তৃতায় ট্রাম্পের ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগানের সূত্র ধরে আহ্বান জানিয়েছেন ‘মেইক আওয়ার প্ল্যানেট গ্রেট এগেইন’।

এক যৌথ বিবৃতিতে ফ্রান্স,জার্মানি ও ইতালির শীর্ষ নেতারা ট্রাম্পের ঘোষণার সমালোচনা করে বলেন, প্যারিস চুক্তি নিয়ে নতুন করে দরকষাকষির সুযোগ নেই।

“আমরা মনে করি ২০১৫-র ডিসেম্বরে প্যারিসে যে মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছিল তা অপরিবর্তনযোগ্য। আমরা দৃঢভাবে বিশ্বাস করি আমাদের গ্রহ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হওয়া প্যারিস চুক্তি নিয়ে আর কোনো দরকষাকষির সুযোগ নেই।“ 

কানাডার পরিবেশমন্ত্রী ক্যাথরিন ম্যাককেনা ট্রাম্পের ঘোষণায় তার দেশের ‘গভীর হতাশার’ কথা জানিয়েছেন। একই মত ব্যক্ত করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। ট্রাম্পকে টেলিফোনে তিনি বলেন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির সুরক্ষা নিশ্চিত করে’।

সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও আইসল্যান্ডের মত নরডিক দেশগুলোও ট্রাম্পের ঘোষণার সমালোচনা করেছে।

জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ট্রাম্পের ঘোষণা কার্বন নিঃসরণ কমাতে বৈশ্বিক প্রচেষ্টা ও বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরণের হতাশা বয়ে আনবে।

ট্রাম্পের ঘোষণার প্রভাবঃ

ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জাতিসংঘের করা গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডে অর্থায়নও বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।  

বিবিসি বলছে, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে যুক্তরাষ্ট্রের দায় ১৫ শতাংশ। প্যারিস চুক্তিতে যা কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।

এছাড়া, দেশটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় লড়ে যাওয়া দেশগুলোকে সহায়তার ক্ষেত্রে বড় ধরণের অবদান রেখে আসছিল। ট্রাম্পের নতুন ঘোষণায় এসব কর্মকাণ্ড বাধাপ্রাপ্ত হবে।

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার ঘোষণার পর জার্মানিতে মার্কিন দূতাবাসের সামনে পরিবেশবাদীদের বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হুমকির মুখে থাকা ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা তাদের জন্য পরিস্থিতি মোকাবেলা আরও কঠিন করে তুলবে।

ঘোষণার বাস্তবায়নঃ

ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিলেও কবে নাগাদ এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু হবে সে সম্পর্কে কিছু জানাননি তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি থেকে পুরোপুরি সরে আসতে অন্তত চার বছর সময় লাগবে বলে বিবিসিকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হোয়াইট হাউজের এক কর্মকর্তা।