ইরানে গ্রেপ্তার-নিপীড়নের ভয়াবহ বিবরণ বিক্ষোভকারীদের মুখে

জেল থেকে ছাড়া পাওয়া নারীরা বলেছেন, চুপ না থাকলে ‘ধর্ষণের হুমকিও’ তাদের দেওয়া হয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2022, 03:26 PM
Updated : 30 Sept 2022, 03:26 PM

“ওরা আমাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলেছিল। একজন অফিসার আমার কোমরে বুট চেপে ধরে, আমার পেটে লাথি মারে। ওরা আমার হাত বেঁধে ফেলে। তারপর বাহু ধরে টেনে ধাক্কা দিয়ে ভ্যানে তোলে।” 

সব দমন-পীড়ন উপেক্ষা করেই ইরানের চলমান আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিলেন ৫১ বছর বয়সী মরিয়ম। গত সপ্তাহে তিনি আটক হন তেহরানে। সে সময় ইরানের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তার সঙ্গে কী আচরণ করেছিল, সে কথাই তিনি বলছিলেন বিবিসিকে। 

গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২২ বছর বয়সী তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যুর পর থেকে ইরানজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ইরানের নারীদের দেখা যাচ্ছে এ আন্দোলনের নেতৃত্বে।

ইরানের কট্টর আইন যেভাবে বলেছে, সেভাবে হিজাব পরেননি মাশা আমিনি, মাথায় দেয়া কাপড়ের নিচ দিয়ে চুল দেখা যাচ্ছিল। এই অপরাধে তাকে আটক করেছিল ইরানের নীতি পুলিশ।

পুলিশ বলছে, ডিটেনশন সেন্টারে হঠাৎ হার্ট ফেইলিওর হয়ে আমিনি পড়ে যান। কিন্তু তার পরিবার পুলিশের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, নীতি পুলিশের কর্মকর্তারা তাকে পিটিয়েছিল। হাসপাতালে তিন দিন কোমায় থাকার পর আমিনির মৃত্যু হয়।

এরপর আন্দোলন শুরু হয় হিজাব আইনের বিলুপ্তি চেয়ে। এখন ইরান সরকারের পতনও চাইছেন বিক্ষোভকারীরা।

নির্মম পুলিশ

বিক্ষোভ দমাতে ইরানে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে। এরপরও পুলিশের হাতে প্রতিবাদকারীদের আটকের ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় আসছে একের পর এক।

”ভিডিওতে যা দেখতে পাচ্ছেন, পরিস্থিতি তার চেয়েও বাজে”, বললেন মরিয়ম।

মরিয়ম অবশ্য তার আসল নাম নয়। নিরাপত্তার খাতিরেই বিবিসির সঙ্গে কথা বলার সময় তার পরিচয় গোপন রাখতে হয়েছে।  

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাচ্ছে। হাতের কাছে যাদের পাচ্ছে, নির্বিচারে আটক করছে। এমন সব দৃশ্য আসছে সেইসব ভিডিওতে।

ইরান সরকার বলছে, ৪০ জন মারা গেছে এই বিক্ষোভে। যদিও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবে  মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুনেরও বেশি।

এখন পর্যন্ত কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেই সংখ্যা প্রকাশ করেনি ইরান সরকার। তবে তেহরানের উত্তরের প্রদেশ মাজানদারানের বিচার বিভগীয় কর্মকর্তারা বলছেন, সেখানে অন্তত সাড়ে চারশ মানুষ বন্দি আছেন।

আর মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, আটক বিক্ষোভকারীর সংখ্যা কয়েক হাজার।

বড় একটি শহরে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক তরুণ বিবিসিকে তার অভিজ্ঞতা বলেছেন। বিবিসির প্রতিবেদনে তার ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছে স্যাম।   

“আমি ধাক্কা মেরে একজন পুলিশ অফিসারকে সরিয়ে দিয়ে পালাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে দ্বিতীয় আরেকজন অফিসার উপস্থিত হয়, এরপর আরেকজন।

”আমি তখন মুখের ভেতর রক্তের স্বাদ পাচ্ছি। ইলেকট্রিক স্টান গানের শক আমার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে গেল। ওরা আমাকে মাটিতে ফেলে দিল। আমার হাত মুড়ে পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেললো। জুতোর ফিতা দিয়ে আমার পাও বেঁধে ফেললো।”

“ওদের একজন আমার বাঁ চোখে লাথি মারে। ওরা আমকে তুলে নিয়ে যেতে থাকে সেখানে, যেখানে আরও অনেককে বন্দি করে রেখেছে।”

ভয়হীন তরুণীরা

ইরানের ৩১টি প্রদেশে ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভ দমনে বদ্ধপরিকর প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি।

আশির দশকে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে হত্যার জন্য দেশটির অনেকে রাইসিকেও দায়ী করেন।

সে সময় গোপন ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা চারজন বিচারকের একজন ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি।

পুলিশের হাতে আটক হওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে স্যাম বলেন, গ্রেপ্তার পর তাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একটি বাসের মেঝেতে ফেলে রাখা হয়। সেখানে আরও অনেকে ছিল; এক জনের উপর আরেকজনকে। এভাবে ঘণ্টা দেড়েক কাটে।

”আমার মাথায় তখন রাজবন্দিদের হত্যায় রাইসির ভূমিকার কথা ঘুরছিল। এক সময় মনে হল, ওরা হয়ত আমাকেও হত্যা করবে।”

প্রেসিডেন্ট রাইসি অবশ্য জোর দিয়ে দাবি করেন, আশির দশকে যাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল, তারা ইরানের আইন অনুসারে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।

এবারের বিক্ষোভে গ্রেপ্তারদের যখন ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী বা আইআরজিসির কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছিল, তখনও বন্দিরা প্রতিবাদ করে যাচ্ছিলেন।

Also Read: হিজাব: ইরানি নারী বনাম নীতি পুলিশ

মরিয়ম বলেন, “ভ্যানে আমার সঙ্গে আরও মেয়ে ছিল। যদিও তারা বয়সে যথেষ্ট তরুণ। ওদের সাহস দেখে আমি নিজেকে সামলে নিলাম। ওরা আমাদের সহায়তা করল।

”ওরা চিৎকার করছিল, অফিসারদের তাচ্ছিল্য করছিল। এই প্রজন্ম আমাদের থেকে একদম আলাদা। ওরা ভয়হীন।”

বিবিসি জানিয়েছে, তাদের যাচাই করা ছবি ও ভিডিওতে তেহরানের উত্তরে ইভিন কারাগারের সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে আটক বিক্ষোভকারীদের স্বজনদের।

তারা কেউ আটকদের ছাড়িয়ে নিতে, কেউ জামিনের জন্য তথ্য নিতে কিংবা কাগজপত্র জমা দিতে অপেক্ষা করছিলেন। 

এদের মধ্যে একজন বিবিসিকে বলেন, কারা কর্তৃপক্ষ তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছে, যেন এই আটকের খবর প্রকাশ করা না হয়। কথা না শুনলে পরিণতি খুব খারাপ হবে।

যদিও বন্দিদের সবাইকে বড় জেলখানায় নেওয়া হয়নি, অনেককে থানা কিংবা ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর (আইআরজিসি) হেফাজতে রাখা হয়েছে।

Also Read: চুল কেটে আন্দোলনে সমর্থন ব্রিটিশ-ইরানি নারীর

মরিয়ম বলেন, ”আমাদের একটি ছোট পুলিশ স্টেশনে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তারা যদিও এত মানুষকে রাখার জন্য প্রস্তুত ছিল না।

”আমাকে নিয়ে ৬০ জন নারীকে রাখা হয় ছোট একটি ঘরে। আমারা একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, বসা ও নড়াচড়াও করা যাচ্ছিল না।

”ওরা বলছিল, আমরা বাথরুম ব্যবহার করতে পারব না। যদি আমাদের খিদে পায়, তাহলে নিজের মলত্যাগ করে সেটা খেতে পারি।”

ইরানি এই নারী বলেন, “প্রায় একদিন পর আমরা ওই ঘরের ভেতর চিৎকার ও প্রতিবাদ শুরু করলাম। ওরা হুমকি দিল, যদি আমরা চুপ না করি, তাহলে আমাদের ধর্ষণ করা হবে।”

’মনোবল রাখতে হবে দৃঢ়’

দক্ষিণের একটি শহরে আটক হওয়া আরেক নারী ফেরেশতেহ (ছদ্মনাম) বিবিসিকে বলেন, নারী পুলিশরা তাদের যৌন হয়রানির হুমকি দিয়েছিল।

”যে অফিসার জেলে আমাদের তালিকা করছিলেন, তিনি আমার নাম জানতে চাইলেন এবং আমাকে পতিতা বললেন।

“যখন আমি প্রতিবাদ করলাম, ওই নারী অফিসার হুমকি দিলেন, মুখে মুখে কথা বলতে থাকলে তিনি তার ভাইকে ডাকবেন আমার সঙ্গে যা করার তা করতে।”

বেহজাদকে রাখা হয়েছিল তেহরানের একটি বড় জেলে। তিনি বলেন, “ওরা একটি ছোট ঘরে ৮০ জন মানুষকে রেখেছিল। আমরা রাগে ফুঁসছিলাম, ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলাম।

”ওরা আমাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছিল। ওতে আমাদের ছবি, ভিডিও, বার্তা খুঁজে দেখেছে– আন্দোলনের কোনো ছবি আমরা কোথাও প্রকাশ করেছি কি না। যদি করে থাকি তাহলে সেসব তথ্য তারা লিখে রাখছে অভিযোগপত্রে।”

Also Read: রাজনৈতিক অস্থিরতায় কী হচ্ছে ইরানের অনলাইনে?

কীভাবে ছাড়া পেলেন, সেই ঘটনাও বিবিসিকে বলেছেন বেহজাদ। 

“পরদিন একজন বিচারক আসেন এবং আমাদের দেখেন। তিনি সব অভিযোগ খারিজ করে দেন এবং বেশিরভাগ টিনএজ তরুণকে মুক্ত করে দেন।

“কিন্তু যারা বয়সে বড় ছিল, তাদের ওই বিচারক ছোট ছোট প্রশ্ন করেন। এর ভিত্তিতে আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করা হচ্ছিল।”

বেহজাদের সঙ্গে থাকা ১০ শতাংশ বন্দিকে অভিযোগ খারিজ করে মুক্তি দেওয়া হয়। বাকিদেরও ছেড়ে দেওয়া হয়, অথবা মুক্তি দেওয়া হয়। 

দুই দিন আটক থাকা আরেক বিক্ষোভকারী বিবিসিকে বলেন, ”এইরকম নিষ্ঠুরতার পরও তরুণরা তাদের মনোবল দৃঢ় রেখেছিল।

”আমাকে রাখা হয়েছিল ২৫ বছরের কম বয়সীদের সঙ্গে। অনেকে ছিল রক্তাক্ত। তারপরও ওরা হাসছিল, কথা বলছিল, কৌতুক করছিল।

”ওদের মধ্যে একজন আমাদের হাসতে বলে। তারপর সে বলে, আমরাই বিজয়ী, কারণ আমরা ঠিক কাজটাই করছি।”