নগ্নতাকে যৌনতার সঙ্গে এক করে ফেলা উচিত না: কেরালা হাই কোর্ট

এ রায় দিয়ে ভারতে কেরালার নারী অধিকারকর্মী রেহানা ফাতিমার বিরুদ্ধে করা সব মামলা খারিজ করে দিয়েছে রাজ্যের উচ্চ আদালত।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 June 2023, 03:20 PM
Updated : 6 June 2023, 03:20 PM

‘নগ্নতা যৌনতার সঙ্গে আবদ্ধ নয়। কোনও নারীর ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত থাকলে তাকে যৌনতা হিসাবে দেখা ঠিক নয়’ বলে রায় দিয়ে ভারতে কেরালার নারী অধিকারকর্মী রেহানা ফাতিমার বিরুদ্ধে করা সব মামলা খারিজ করে দিয়েছে রাজ্য হাই কোর্ট।

এনডিটিভি জানায়, ২০২০ সালের জুন মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রেহানার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, রেহানা শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত করে শুয়ে আছেন এবং তার ছেলে ও মেয়ে তার শরীরে ছবি আঁকছেন।

ভিডিওটি পোস্ট করে রেহানা দাবি করেছিলেন, নারী দেহ মানেই যৌনতা ভেবে নেওয়ার মানসিকতাকে চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি তার উদ্দেশ্য ছিল সন্তানদের যৌন শিক্ষা দেওয়া।

ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ঘিরে নেটিজেনদের একাংশের মধ্যে তৈরি হয় তীব্র ক্ষোভ। সেইসঙ্গে কেরালায় একাধিক থানায় রেহানার বিরুদ্ধে যৌন অপরাধ থেকে শিশু সুরক্ষা (POSCO) আইনের ১৩, ১৪ এবং ১৫ ধারায় এবং  তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও কিশোর বিচারের ৭৫ ধারার অধীনে ‍মামলা করা হয়।

সোমবার ৩৩ বছরের রেহানাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিচারপতি কাউসের এডাপ্পাগাথ বলেন, সন্তানদের কোন বাস্তব বা সিমুলেটেড যৌন ক্রিয়াকলাপের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল এবং তাও আবার যৌন তৃপ্তির জন্য! ভিডিও দেখে এমনটা অনুমান করা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না।

তিনি শুধু তার শরীরকে তার সন্তানদের ছবি আঁকতে ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

‘‘কোনো নারীর নিজ দেহ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ‍অধিকার তার একেবারেই নিজস্ব এবং এটিই সমতা ও গোপনীয়তার বিষয়ে তার মৌলিক অধিকারের মূল কথা। এটি ভারতীয় সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ দ্বারা নিশ্চিত করা ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্যেও পড়ে।”

মামলা থেকে ‍অব্যাহতি পেতে রেহানা প্রথমে একটি ট্রায়াল কোর্টে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সেখানে তাকে অব্যাহতি না দিয়ে বরং মামলা চালিয়ে যেতে বলা হয়। ট্রায়াল কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তিনি পরে কেরালা হাই কোর্টের দ্বারস্ত হন।

হাই কোর্টে করা আপিল আবেদনে রেহানা বলেন, সকল প্রেক্ষাপটে একজন নারীর নগ্ন ঊর্ধ্বাঙ্গ সমাজে যৌনতা বলে বিবেচিত হয়। অথচ সেই সমাজেই এজন পুরষের নগ্ন ঊর্ধ্বঙ্গ যৌন আচরণ বলে বিবেচিত হয় না। নিজের দেহে পেইটিং করানোর মাধ্যমে তিনি সমাজের পূর্বনির্ধারিত এই ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেয়েছেন।

রেহানার এই যুক্তির সঙ্গে একমত পোষন করে বিচারপতি কাউসের বলেন, ‘‘শিশুদের পর্নোগ্রাফির জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল এমন কিছুই সেখানে দেখা যায়নি। ভিডিওটিতে যৌনতার কোনো ইঙ্গিত নেই। একজন ব্যক্তির নগ্ন শরীরের উপরিভাগে ছবি আঁকা, তা সে পুরুষ হোক বা নারী হোক, তাকে যৌনতামূলক কাজ বলা যাবে না।”

আদালতে প্রসিকিউটর দাবি করেছিলেন, রেহানা ভিডিওতে তার শরীরের উপরের অংশটি উন্মুক্ত করেছে। যা অশ্লীল এবং অশালীন। তার এই যুক্তি বাতিল করে আদালত থেকে বলা হয়, ‘‘নগ্নতা এবং অশ্লীলতা সবসময় সমার্থক নয়।

‘‘নগ্নতাকে অপরিহার্যভাবে অশ্লীল বলে শ্রেণীবদ্ধ করা বা এমনকি অশালীন বা অনৈতিক হিসাবে ভাবাও ভুল।”

বিচারক নিজের এই অবস্থানের পক্ষে উদাহরণ হিসেবে বলেন, অতীতে কেরালাতেই নিম্নবর্ণের নারীরা নিজেদের বক্ষ ঢেকে রাখার অধিকারের দাবিতে লড়াই করেছেন। এছাড়াও সারা দেশে প্রাচীন মন্দির ও বিভিন্ন পাবলিক স্পেসে অর্ধ-নগ্ন অবস্থায় দেব-দেবীর ম্যুরাল, মূর্তি এবং শিল্পকর্ম আছে এবং এগুলোকে ‘পবিত্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

তিনি আরো বলেন, ‘‘একজন পুরুষের নগ্ন ঊর্ধ্বাঙ্গ কখনোই অশ্লীল বা অশালীন বলে বিবেচিত হয় না। এটা যৌনতাও নয়। তবে কেনো একজন নারীর দেহও একইভাবে দেখা হবে না?

‘‘নারীদের নিজের দেহ এবং জীবন সম্পর্কে নিজেদের পছন্দমত চলতে গিয়ে নির্যাতিত, বৈষষ্যের শিকার, একঘরে হওয়া এবং বিচারের সম্মুখীন হতে হয়।”

কেরালার উচ্চ আদালতের এই রায়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেলেন রেহানা। এবারই প্রথম তাকে নিয়ে বিতর্ক, এমনটা নয়। কেরালার সবরিমালায় আইয়াপ্পার মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু সমস্ত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মন্দিরে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। সেবারও তাকে নিয়ে ব্যাপক হইচই হয় এবং আইন না মেনে মন্দিরে প্রবেশের জন্য খোয়াতে হয়েছিল সরকারি চাকরি।