Published : 02 May 2025, 09:25 PM
ইসরায়েলের অবরোধে গাজায় খাদ্যসংকট চরমে পৌঁছেছে। সেখানে এখন এক বেলার গরম খাবার পাওয়াও কঠিন। তবে দক্ষিণাঞ্চলের ক্ষুধার্ত মানুষদের জন্য দুপুরের খাবার গাধার পিঠে করে কিংবা গরুর গাড়িতে করে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
মাংস কিংবা সবজি নয়, কেবল ডাল, চাল আর টক টমেটোর সস দিয়ে তৈরি খাবার ‘কোশারি’ রান্না হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবিক সহায়তা সংস্থা ‘আমেরিকান নিয়ার ইস্ট রিফিউজি এইড’ (আনেরা) পরিচালিত দুটি কমিউনিটি কিচেনের একটিতে।
সেখান থেকেই খাবার যাচ্ছে বাস্তুচ্যুত মানুষদের কাছে। আনেরার গাজা শাখার প্রধান সামি মাতার বলেন, “এখানকার মানুষ আমাদের রান্নাঘরের খাবারের ওপর নির্ভরশীল।
“বাজারে সামান্য যা আছে, তা কেনার মত পয়সা নেই তাদের। আগে আমরা চাল-মাংসের খাবার রান্না করতাম। কিন্তু এখন অবরোধের কারণে মাংস তো দূরের কথা, টাটকা শাকসবজিও নেই।”
ইসরায়েল দুই মাস আগে গাজার সব বন্দর বন্ধ করে দিয়ে খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধসহ সব ধরনের পণ্য প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে।
ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ভেস্তে দিয়ে আবার পূর্ণ শক্তি নিয়ে সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। তাদের ভাষ্য, জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে চাপ দিতেই তাদের এই পদক্ষেপ।
এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) জানিয়েছে, তাদের খাবারের মজুদ পুরোপুরি শেষ।
খাদ্য সংকটে পড়া গাজার অবশিষ্ট কয়েকটি কমিউনিটি কিচেনই এখন শত-সহস্র মানুষের একমাত্র ভরসা। খান ইউনিসে আনেরার রান্নাঘর প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার মানুষকে খাবার দেয়। কিন্তু অবরোধ না উঠলে রসদ দ্রুতই ফুরিয়ে যাবে।
আনেরার গাজা শাখার প্রধান সামি মাতার বিবিসি’র স্থানীয় এক সাংবাদিককে বলেন, ইসরায়েলের দুই মাসের অবরোধের কারণে গাজায় সব সরবরাহ আসা বন্ধ হয়ে গেছে। আগে প্রতি সপ্তাহে ১০০-র বেশি ট্রাক আসত। এখন একটিও আসে না। কয়েক ডজন ফুড কিচেন কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে।
“আগামী কয়েকদিন খুবই সংকটের মধ্য দিয়ে যাবে। আমাদের হয়ত দু’সপ্তাহ চলার মতো মজুদ আছে, বা তার চেয়ে কমও হতে পারে,” বলেন তিনি। সাংবাদিককে আনেরার বিস্তীর্ণ, ফাঁকা গুদামঘর ঘুরিয়েও দেখান মাতার।
তিনি আরও বলেন, “কমিউনিটি কিচেনের জন্য চাল, ডাল, পাস্তা, তেল, লবণ কিনতে হিমশিম খাচ্ছি। রান্নার জন্য কাঠ কিনতে হয়। ১ কেজি কাঠের অনেক দাম। প্রতিদিনের রান্নায় ৭০০ কেজির বেশি কাঠ লাগে।”
ইসরায়েল অভিযোগ করে বলেছে, হামাস এই ত্রাণ চুরি করে যোদ্ধাদের দিচ্ছে কিংবা বিক্রি করছে। তবে জাতিসংঘসহ অন্যান্য ত্রাণ সংস্থাগুলো ত্রাণ সরবরাহের ওপর তাদের কঠোর নজরদারির কথা জানিয়ে ইসরায়েলের ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
মোটা ফাইলে নাম, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরসহ বাসিন্দাদের তালিকা দেখিয়ে মাতার বলেন, “আমাদের বিতরণ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য। আমরা কোনওরকম দলীয় হস্তক্ষেপ এড়ানোর চেষ্টা করি।”
এ সপ্তাহে ত্রাণকর্মীরা খাদ্য গুদামে লুটপাটের ৫ টি ঘটনার কথাও জানিয়েছেন। জাতিসংঘ কর্মকর্তারা বলছেন, গাজার মানুষরা মরিয়া হয়ে খাবার লুট করছে।
আনেরার কমিউনিটি কিচেনের প্রত্যেকটি প্যাকেটে চারজনের খাবার থাকে। যারা সেখানে কাজ করেন, তারাও এই খাবার নিজেদের পরিবারে নিয়ে যান।
বাকি খাবার ওঠানো হয় গাধার পিঠে। সেগুলো পাঠানো হয় অস্থায়ী ক্যাম্প 'আল-মাওয়াসি'তে। সেখানে বহু মানুষ দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষা করে থাকেন এক প্যাকেট খাবারের আশায়।
ক্রাচে ভর করে হাঁটা এক বৃদ্ধ কাঁপা হাতে কোশারির দুটি প্যাকেট ধরে বলেন, “আল্লাহর শুকরিয়া, এতেই হবে। আমরা বেঁচে আছি, কারণ মৃত্যু এখনও আমাদেরকে নিয়ে যায়নি। সকাল থেকে একটা রুটির খোঁজে ঘুরেছি,কিছুই পাইনি।”
উদ্বিগ্ন এক মা বলেন, “পরিস্থিতি মর্মান্তিক। অবস্থা আরও শোচণীয় হচ্ছে। কারণ, কোনও কাজ নেই। আয় নেই। সব জিনিসের অনেক দাম। কিছু কিনতে পারিনা। এই সময়ে এইটুক খাবারও দারুণ। আমাদের রান্না করার গ্যাস নেই, খাবার নেই। এক কাপ চা বানাতেও গাছের শুকনো পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালাতে হয়।”
গাজায় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হয়েছে দেড় বছরেরও বেশি সময় আগে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলে ঢুকে হামাসের হামলায় প্রায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত এবং ২৫০ জনের বেশি জিম্মি হয়।
এখনও অন্তত ৫৯ জন জিম্মি হামাসের হাতে বন্দি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় গাজায় নিহত হয়েছে ৫২ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ। তাদের অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। ৯০ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
জাতিসংঘ বলছে, গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ, পুনরায় হামলা এবং এর ফলে সম্প্রতি আরও ৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণে পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে করুণ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলকে গাজায় আরও খাদ্য ও ওষুধ ঢুকতে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন বলে জানিয়েছেন। গাজাবাসীর প্রতি তিনি সদয় হতে বলেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে। তবে এ বিষয়ে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কোনও আনুষ্ঠানিক সাড়া মেলেনি।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা বাড়তে থাকায় ইসরায়েলের ওপর গাজায় অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে না খাইয়ে রাখা যুদ্ধাপরাধ হতে পারে বলেও সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে ইসরায়েলকে।
তবে ইসরায়েল এই সব সতর্কবার্তার তোয়াক্কা করছে না। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি এ সপ্তাহে এক যৌথ বিবৃতিতে গাজা অবরোধকে 'অসহনীয়' বলে বর্ণনা করে তা অবসানের আহ্বান জানিয়েছিল।
এর জবাবে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, যুদ্ধবিরতির সময় গাজায় ২৫ হাজারের বেশি ট্রাকে করে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টন পণ্য প্রবেশ করেছে। মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, মাঠপর্যায়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে ইসরায়েল। সেখানে কোনও ত্রাণ সংকট নেই।
তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সীমান্তে ত্রাণ বোঝাই ট্রাকগুলো আটকে আছে। ওদিকে, গাজার ভেতরে মানবিক ত্রাণ কর্মীরা অবশিষ্ট রসদের হিসাব করে দিন কাটাচ্ছেন।
আল-মাওয়াসি শরণার্থী শিবিরে খাবার বিতরণ চলার সময় শিশুরা ঘিরে ধরে সামি মাতার ও আনেরার কর্মীদের। তাদের অনেকেই কঙ্কালসার, যা আগামীদিনগুলোতে বিশেষত, গাজার শিশুদের মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগারই অশনি সংকেত দেয়।
সামি মাতার বলেন, “আমাদের খাবার ফুরিয়ে গেলে কী করব জানি না। এই সহায়তা বন্ধ করতে হলে তা আমাদের জন্য ভয়াবহ মানসিক চাপের ব্যাপার হবে।”
মাতার আবেদন জানিয়ে বলেন, “আমাদের দিকে তাকান, আমাদের বিষন্ন চাহনি দেখুন। বুঝতে চেষ্টা করুন সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। অনুগ্রহ করে আবার সীমান্ত ক্রসিং খুলে দিন।”