Published : 23 Jun 2023, 04:19 PM
অং সান সু চিকে মুক্তি দিতে সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত এ নেত্রীর ছোট ছেলে কিম আরিস।
“মাকে জেলে নিঃশেষ হয়ে যেতে দিতে পারি না আমি,” লন্ডনে বিবিসি বার্মিজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি।
সু চিকে সহায়তায় আরও পদক্ষেপ নিতে বিশ্বের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন আরিস।
২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর একের পর এক অভিযোগের বিচার শেষে সু চিকে মোট ৩৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ওই অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারজুড়ে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, যা এরই মধ্যে হাজারো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
ব্রিটিশ নাগরিক আরিস বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাকে তার মা বা তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে কোনো তথ্যই দেয়নি। তথ্যের জন্য তিনি মিয়ানমারের দূতাবাস, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর এবং আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কেউই তাকে সাহায্য করেনি।
“এসবের আগে, আমি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে বা খুব বেশি জড়িয়ে যেতে চাইনি,” বলেছেন আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যমে প্রথম সাক্ষাৎকার দেওয়া আরিস।
১৯৮৯ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত সু চি যে প্রায় ১৫ বছর আটক ছিলেন, সেসময়েও আরিসকে কখনোই মুখ খুলতে দেখা যায়নি।
“এটা ভালো ছিল যে আমি রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছি। আমার মাও চাননি আমি রাজনীতিতে জড়াই। কিন্তু এখন তিনি সাজা ভোগ করছেন আর সামরিক বাহিনীও যৌক্তিক আচরণ করছে না। আমার মনে হয়, আমি যা চাই, তা বলতে পারি,” বলেছেন তিনি।
বিশ্বের গণতন্ত্রের অন্যতম আইকন সু চি শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন। প্রায় দেড় দশক কারাগারে কাটানোর পর ২০১০ সালে তার ছাড়া পাওয়ার ঘটনা মিয়ানমারের পাশপাশি বিশ্বের অন্যত্রও উদ্যাপিত হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) সু চি তার সরকারের আমলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা গণহত্যাসহ সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নিপীড়ন নির্যাতনে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলে তিনি বিশ্বজুড়েই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
অভ্যুত্থানের আগে তার মায়ের নামে যেসব সমালোচনা ছিল সেসব বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি না হওয়া আরিস বলেছেন, তিনি বর্তমান দুর্দশার দিকেই মনোযোগ রাখতে চান।
সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সু চিকে প্রথমে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল, গত বছর তাকে রাজধানী নেপিডোর একটি কারাগারের নির্জন কক্ষে স্থানান্তর করা হয়।
বিচার আর রায় বাদে প্রায় দুই বছর ধরে তার সম্বন্ধে আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। মাঝে তার অসুস্থতা নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, যদিও সেনাবাহিনী সেসব খবর ঠিক নয় বল জানায়।
আরিস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি মিয়ানমারের সংকট সমাধানেরও অনুরোধ করেন। বিদ্রোহ দমনে দেশটির জান্তা সরকার প্রাণঘাতী সব অস্ত্র এবং বিমান হামলা চালানোয় মৃত্যুর মিছিল ক্রমাগত লম্বা হচ্ছে বলেও ভাষ্য তার।
“সেনাবাহিনীর ওপর কার্যকর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ, এমনকী পারলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যারা লড়ছে তাদের সহায়তা দেওয়াসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই কিছু না কিছু করা শুরু করতে হবে,” বলেছেন তিনি।
অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা ও সেনাবাহিনী সংশ্লিষ্ট নানান প্রতিষ্ঠানকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও এবং আন্তর্জাতিকভাবে তাদেরকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলেও দেশটি এখনও অস্ত্র এবং তা বানানোর সরঞ্জাম কিনতে পারছে।
আরিস বলেন, তার মায়ের মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবশ্যই ‘আরও শক্ত লবিং শুরু’ করতে হবে।
১৯৮৮ সালের পর থেকেই আরিসরা দুই ভাই তার মা-র কাছ থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন্নই আছেন। অসুস্থ মায়ের সেবা করতে ওই বছরই যুক্তরাজ্য থেকে মিয়ানমার ফিরে যান সু চি।
দেশে ফেরার পর মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক জেনারেল অং সানের মেয়ে সু চি সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনের কাণ্ডারি হয়ে ওঠেন। আরও অনেককে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি), কিন্তু ১৯৮৯ সালেই তাকে গৃহবন্দি করা হয়।
ফিরে আসতে পারবেন না, এই ভয়ে দেশ না ছাড়া সু চি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেও তা নিতে নিজে যাননি। তার হয়ে তার ছেলে, সেসময় ১৪ বছর বয়সী আরিস তা গ্রহণ করেন।
সু চির স্বামী ১৯৯৯ সালে ক্যান্সারে ভুগে মারা যান, এর মধ্যে মিয়ানমারের নেত্রী তাকে আর দেখতেও যেতে পারেননি।
২০১০ সালে সু চি মুক্তি পাওয়ার পর আরিস তাকে দেখতে মিয়ানমার যান। ফেরার আগে উপহার হিসেবে মাকে ইয়াংগনের মার্কেট থেকে একটি কুকুরছানা কিনে দিয়েছিলেন বলেও বিবিসিকে জানান আরিস।
“খাঁচায় থাকা কুকুর ছানাগুলোর মধ্যে একমাত্র সেটিই জেগে ছিল, যে কারণে ও-ই আমার সঙ্গে ঘরে ফিরেছিল। এর পর থেকে ওই কুকুর ছানাটিই ছিল আমার মায়ের বিশ্বস্ত সঙ্গী,” বলেন আরিস।
২৫ বছরে মিয়ানমারে প্রথম অবাধ নির্বাচনে এনএলডি ব্যাপক ব্যবধানে জয়লাভ করলে ২০১৫ সালে সু চি দেশটির ‘ডি ফ্যাক্টো’ নেতায় পরিণত হন। তার ছয় বছর পর অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হলেও মিয়ানমারে এখনও তিনি বেশ জনপ্রিয়।
“যত দীর্ঘ সময়ই লাগুক, সামরিক বাহিনী এই যুদ্ধে কখনোই জিতবে না। তাই যত দ্রুত তারা আমার মা এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে, তত দ্রুত দেশটির অগ্রগতি শুরু হতে পারে,” বলেছেন আরিস।