ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে এখনও অনেক পথ বাকি।
Published : 24 May 2024, 01:21 AM
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রধান অংশীদারদের বিপক্ষে গিয়ে তিনটি ইউরোপীয় দেশ ফিলিস্তনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে; যা কার্যকর হওয়ার কথা ২৮ মে থেকে।
এতে যদিও খুব দ্রুত কিংবা সহজে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে না। এখনও অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি। পেরোতে হবে আরও অনেক প্রতিবন্ধকতা।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পথ পাড়ি দেওয়া কঠিন হলেও ফিলিস্তিনকে তিন ইউরোপীয় দেশের স্বীকৃতির কিছু প্রভাব পড়েছে এবং পড়বেও।
গাজায় যুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ফিলিস্তিনি হতাহতের ঘটনা নিয়ে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক চাপে আছে ইসরায়েল। তার ওপর বুধবার তিন ইউরোপীয় দেশ- স্পেন, আয়ারল্যান্ড এবং নরওয়ের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির সিদ্ধান্তের পর ইসরায়েল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও একঘরে হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের নানা সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেও ইসরায়েল গাজায় হামলা চালিয়ে যাওয়ায় এবং বিশেষত রাফা অভিযান থেকে পিছু না হটায় এরই মধ্যে নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছে।
ইসরায়েলে অস্ত্র চালান আটকে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে ওয়াশিংটন। বিভিন্ন সময় ইহুদি বসতিস্থাপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) দেশটির বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে। রাফায় অভিযান বন্ধের আদেশ চেয়ে আবেদন জমা পড়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন পর্যন্ত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ইসরায়েলের বিপক্ষে গিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ।
যার ফলে এখন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ অন্য ইউরোপীয় দেশুলোও ফিলিস্তিনের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের সমর্থনে এই তিন দেশের পথ অনুসরণ করার চাপে পড়বে বলেই অভিমত বিশ্লেষকদের।
একজন আরব কূটনীতিক বলেছেন, “এটি (ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত) অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ইসরায়েল সরকার কারও কথা না শোনায় ইউরোপীয়রা যে হতাশ এ তারই প্রতিফলন। এতে ইইউ দেশগুলোর ওপর একই পথ অনুসরণ করার জন্য চাপ বাড়বে।”
ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, সুইডেন, সাইপ্রাস এবং মাল্টা।
আয়ারল্যান্ড, স্পেন এবং নরওয়ের মতে, তারা একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে অন্যান্য দেশগুলোও এগিয়ে আসে।
তাদের যুক্তি, উভয় পক্ষই এক ধরনের রাজনৈতিক আবহকে লক্ষ্য ধরে নিয়ে এগুতে পারলেই কেবল বর্তমান সংকটের একটি টেকসই সমাধান হবে। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এই দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক চাপের মুখেও আছে।
তবে ফিলিস্তিনকে কখন স্বীকৃতি দেওয়া উচিত তা নিয়ে ইউরোপীয় কিছু দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক ইউরোপীয় দেশের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তি ও চলমান সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে দ্বি-রাষ্ট্র অপরিহার্য, যেখানে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন উভয়ই তাদের নিজস্ব সীমানা নিয়ে স্বাধীনভাবে পাশাপাশি অবস্থান করবে।
কিন্তু দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের বিরোধিতা করে আসছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। ২০২২ সালের শেষের দিকে নেতানিয়াহুর সরকারে কট্টর ডানপন্থি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী দলগুলো যোগ দেওয়ার পর তার এই বিরোধিতা আরও বেড়েছে।
তিন দশক আগে অসলো শান্তি চুক্তির আওতায় ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তবে তাদের কার্যকলাপ নিয়ে নেতানিয়াহু সরকার সন্দেহ প্রকাশ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এনেছে ইসরায়েল।
ওদিকে, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে আগে অনেক পশ্চিমা দেশই মনে করত একটি চূড়ান্ত শান্তি চুক্তি হওয়ার পরই সেটি উচিত। তবে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনসহ ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ তাদের মত পরিবর্তন করেছে। তারা এখন বিশ্বাস করে যে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে দ্রুত স্বীকৃতি দিলেই তা একটি রাজনৈতিক সমাধান বয়ে আনবে।
কিন্তু এ পথে ইউরোপীয় তিন দেশের সিদ্ধান্তকে ‘সন্ত্রাসবাদের পুরস্কার’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ‘গতবছরের ৭ অক্টোবরের হত্যাযজ্ঞের পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা করবে’ বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
নেতানিয়াহুর এমন মন্তব্য গাজা যুদ্ধকে ঘিরে এ অঞ্চলের আবহ কতটা তিক্ত হয়ে উঠেছে তারই বহিঃপ্রকাশ। সেইসঙ্গে ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ওপর ভিত্তি করে এ অঞ্চলে একটি রাজনৈতিক মীমাংসার সম্ভাবনা কতটা ক্ষীণ আর একটি শান্তিচুক্তি নিয়ে আলোচনা যে আপাতত সম্ভব নয় সেটিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
নরওয়ের রাজধানী অসলো, স্পেনের মাদ্রিদ এবং আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন থেকে নিজ দেশের রাষ্ট্রদূতদের এরই মধ্যে প্রত্যাহার করেছে ইসরায়েল। নরওয়ে, আইরিশ ও স্প্যানিশ রাষ্ট্রদূতদের তলব করেছে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদেরকে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার ভিডিও ফুটেজ দেখতে বলা হয়েছে।
ওয়াশিংটনের জনস হপকিন্স স্কুল ফর অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ এর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক লরা ব্লুমেনফেল্ড বলেছেন, তিনটি ইউরোপীয় দেশের সিদ্ধান্ত “কূটনৈতিকভাবে সাহসী। তবে আবেগের দিক থেকে নিষ্ফল।
“ইসরায়েলিদের জন্য এ সিদ্ধান্ত উদ্বেগ (প্যারানয়া) বাড়াবে এবং এতে নেতানিয়াহুর এই যুক্তিই আরও দৃঢ় হবে যে ইসরায়েলিরা একাই দাঁড়াতে পারে। আর ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি তাদের জাতীয় স্বপ্নের বাস্তবায়ন কোন পথে তা নির্ধারণ না করে বরং মিথ্যা প্রত্যাশাই কেবল বাড়াবে।”
জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ইয়োনাতাম ফ্রিম্যান মনে করেন, ইসরায়েলের কারও কথা না শোনার যে প্রবণতা আছে, বৈরি বিশ্বের মুখে তা আরও বাড়তে পারে । “আমরা কেবল আমাদের ওপরই নির্ভর করতে পারি” –গাজা যুদ্ধের প্রথম থেকেই বলে আসা একথায় আরও অটল অবস্থান নিতে পারে ইসরায়েল।
এখন পর্যন্ত ১৩৯টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। গত ১০ মে তে ফিলিস্তিনের জাতিসংঘে যোগদান নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটিতে ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৪২টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে।
ফিলিস্তিন বর্তমানে জাতিসংঘের অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে থাকলেও ভোট দেওয়ার ক্ষমতা নেই। আরব লীগ এবং অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়।
ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বলেছিলেন, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ফ্রান্সের সমস্যা নেই। এমাসেও ফ্রান্স জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভোটের সময় ফিলিস্তিনের সদস্যপদ সমর্থন করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়টি নিয়ে তলে তলে ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। তবে তারা অনেক বেশি সতর্ক রয়েছে এবং এই নীতি বাস্তবে কি বয়ে আনবে তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা পেতে চাচ্ছে।
সুতরাং পর্দার আড়ালে মূল বিতর্ক যা নিয়ে চলছে তা হল, যারা এখনও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি তাদের কখন সেটি দেওয়া উচিত। যখন ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে আনুষ্ঠনিক শান্তি আলোচনা শুরু হবে, ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক যখন চালু হবে তখন, নাকি ইসরায়েল কিছু পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে কিংবা ফিলিস্তিন কিছু পদক্ষেপ নিলে তখন।
অর্থাৎ, কূটনৈতিক দিক থেকে ফায়দা লাভের বড় কোনও একটি মুহূর্তেই তারা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চায়।
একজন পশ্চিমা কর্মকতার মতে, 'এটি একটি ট্রাম্প কার্ড, যা পশ্চিমা দেশগুলো খেলতে চায়। আমরাও এটি ছুড়ে ফেলতে চাই না।'
তবে সমস্যা হচ্ছে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অনেকটাই প্রতীকী বিষয়। তাছাড়া, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র নিয়ে কিছু কঠিন প্রশ্নও রয়ে গেছে- যেগুলোতে মতৈক্য হয়নি, এমনকী দশকের পর দশক ধরে এর কোনও সন্তোষজনক জবাবও মেলেনি।
যেমন: স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সীমানা কীভাবে নির্ধারিত হবে? রাজধানী কোথায় হবে? সেটি করতে গেলে উভয়পক্ষকে প্রথমেই কি করতে হবে? এসব প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত।
বর্তমান সময়ে ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ মনে করে যে, স্বাধীন একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হওয়া উচিত। সমর্থকরা এমন পদক্ষেপে উল্লাস করবে। আর বিরোধিরা এর নিন্দা করবে। মাঠ পর্যায়ে ফিলিস্তিনিদের এই কঠিন বাস্তবতা পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।