অনেক প্রথমের জন্ম দেওয়া কমলা হ্যারিস এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হয়ে আরেক ইতিহাস গড়ার সম্ভাবনা জাগিয়েছেন।
Published : 05 Nov 2024, 01:57 PM
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি; কিন্তু প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে এবারই ভোটের লড়াইয়ে নামতে হবে, ছয় মাস আগেও তা জানতেন না কমলা হ্যারিস।
২০২৪ সালের নির্বাচনের জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেই ফের প্রার্থী করেছিল ডেমোক্রেটিক পার্টি। কিন্তু তার বয়স নিয়ে বিতর্কে প্রার্থী বদলের রব ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দলটিতে। চাপের মুখে বাইডেন সরে দাঁড়ালে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন কমলা হ্যারিস।
একজন আইনজীবী থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া কমলা হ্যারিস অনেক প্রথমের জন্ম দিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ভারতীয়-আমেরিকান সেনেটর। ক্যালিফোর্নিয়ার প্রথম নারী ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি এবং প্রথম দক্ষিণ এশীয় নারী অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট; একইসঙ্গে তিনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং এশীয় আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্টও।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একজন প্রার্থী হিসাবে কমলা হ্যারিস এখন নতুন ইতিহাসের দুয়ারে।
অভিবাসীর মেয়ে
ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে ১৯৬৪ সালের ২০ অক্টোবর কমলা হ্যারিসের জন্ম। তার মা ভারতীয় বংশোদ্ভূত, বাবা জ্যামাইকান আমেরিকান।
ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে সৌভাগ্য, সৌন্দর্য ও শক্তির দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক আর সংস্কৃত শব্দ ‘কমল’ বা পদ্মফুলের সমার্থক শব্দে মেয়ের নাম ‘কমলা’ রেখেছিলেন তার মা শ্যামলা গোপালন।
শ্যামলা এন্ডোক্রাইনোলজি নিয়ে গবেষণার জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করেন তিনি। সেইসঙ্গে জড়িয়ে পড়েন নাগরিক অধিকার আন্দোলনে।
পরে বিয়ে করেন ডনাল্ড হ্যারিসকে। জামাইকা (তখনও ব্রিটিশ উপনিবেশ) থেকে ষাটের দশকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে থিতু হয়েছিলেন হ্যারিস। শ্যামলার মত তিনিও যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গিয়েছিলেন।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে হ্যারিস ছিলেন অর্থনীতির ছাত্র। তিনিও স্ত্রীর সঙ্গে নাগরিক অধিকার আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন।
তাদের দুই মেয়ে কমলা ও মায়া বেড়ে উঠেছেন মিশ্র সংস্কৃতিতে। গির্জার কোরাসে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি তারা নিয়মিত মন্দিরেও যেতেন।
কমলার যখন সাত বছর বয়স, তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। দুই মেয়েকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান শ্যামলা। মায়ের কাজের জন্য কমলা হ্যারিসের শিক্ষাজীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে কানাডার কিবেক শহরে।
কিবেকে একটি হাসপাতালে গবেষণা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন শ্যামলা। কিবেকের পর হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন হ্যারিস। ডক্টরেট করেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হেস্টিংস কলেজ অব দ্য ল থেকে।
হ্যারিস জানিয়েছেন, তাকে এবং তার ছোট বোন মায়াকে ওকল্যান্ডের কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মাঝেই বড় করে তুলেছিলেন তার মা। আত্মজীবনী ‘দ্য ট্রুথস উই হোল্ড’-এ হ্যারিস লিখেছেন, “আমার মা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি দুজন কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েকে লালন পালন করছেন।
“তিনি জানতেন, তার নতুন দেশ মায়া ও আমাকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই দেখবে এবং আমরা যাতে আত্মবিশ্বাসী, গর্বিত কৃষ্ণাঙ্গ নারী হয়ে উঠি, তা নিশ্চিত করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।”
আইন পেশা থেকে রাজনীতি
হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় কমলা হ্যারিসের। নিয়মিত বিতর্কে অংশ নিয়ে বাগ্মী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল আইনজীবী হওয়ার।
সে স্বপ্ন তিনি পূরণ করেছেন। দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন আইনজীবী হিসেবে। তিনি বরাবর সরব হয়েছেন মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে। তার কর্মজীবন অনেকটাই সফল।
১৯৯০ সালে হ্যারিস ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যালামেডা কাউন্টির ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির দায়িত্ব পান। এরপর ২০১০ সালে ক্যালিফর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হন। প্রথম দক্ষিণ পূর্ব এশীয় বংশোদ্ভূত হিসেবে তিনি এই দায়িত্বে সম্মানিত হন।
সাত বছর সান ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি এবং তারপরে ছয় বছর ক্যালিফর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল থাকার পর ২০১৬ সালে প্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ নারী সেনেটর হিসেবে ক্যালিফর্নিয়া থেকে নির্বাচিত হন হ্যারিস।
২০২০ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে মনোনয়ন দৌড়ে শামিল হয়েছিলেন কমলা হ্যারিস। তবে প্রাথমিক পর্যায়েই দৌড় থেকে বেরিয়ে যান তিনি।
শুরুর দিকে তার প্রচার সভাগুলোতে বিপুল জনসমাগম হলেও হ্যারিস তার মতাদর্শ ও নীতিমালা স্পষ্ট করতে পারেননি। ফলে অল্প সময়েই তার প্রচার গতি হারায়। তাকে স্পটলাইটে ফিরিয়ে আনেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
ওই বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসাবে মনোনীত হওয়ার পরই জো বাইডেন তার রানিং মেট হিসাবে কমলা হ্যারিসকে বেছে নেন। তার ভাষায়, হ্যারিস এক জন নির্ভীক যোদ্ধা।
হ্যারিসকে রানিং মেট করার পর বাইডেন বলেছিলেন, “আমরা দুজনে মিলে এবার ট্রাম্পকে কড়া টক্কর দেব।”
বাইডেনের সহযোদ্ধা হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর হ্যারিস টুইট করেন, “এই মনোনয়নের জন্য আমি গর্বিত। বাইডেন যাতে প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, তার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।”
সে সময় নির্বাচনি প্রচারের সময় হ্যারিসকে পেছনের আসনে দেখা গেলেও বাইডেনের সাফল্যে একজন নারী এবং কৃষ্ণাঙ্গ হিসাবে তার বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়।
প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট
২০২০ সালের নির্বাচনে হ্যারিস প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম এশিয়ান-মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাস গড়েন।
২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন হ্যারিস। আর এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট জেন্টেলম্যান হন তার স্বামী আইনজীবী ডাগ এমহফ।
ওই বছর নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চিকিৎসার জন্য কাজ থেকে বিরতি নিতে হয়েছিল। তখন কিছু সময়ের জন্য ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় ছিলেন হ্যারিস।
মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস মার্কিন সেনেটেরও প্রেসিডেন্ট। বিল পাসের ক্ষেত্রে ভোট টাই হয়ে গেলে তিনি ভোট দিতে পারেন। সেই ক্ষমতা বহুবার ব্যবহার করে নজির গড়েছেন হ্যারিস। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগও নিয়েছেন।
হঠাৎ ভোটের লড়াইয়ে
গত জুন মাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে মুখোমুখি বিতর্কে রীতিমত নাস্তানাবুদ হন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তখন তার বয়স আর মস্তিস্কের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা নিয়ে কথা ওঠে। নির্বাচনি দৌড় থেকে সরে যাওয়ার জন্য বাইডেনের ওপর চাপ শুরু হয়।
বাইডেন শুরুতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু মার্কিন সেনেটের ডেমোক্র্যাটিক নেতা চাক শুমার ও প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিসহ শীর্ষ অনেক ডেমোক্র্যাট নেতাই প্রেসিডেন্ট তাকে ভোট থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানান। এরপরই বাইডেন নির্বাচনি দৌড় থেকে সরে দাঁড়িয়ে তার জায়গায় সমর্থন দেন কমলা হ্যারিসকে।
হ্যারিস নির্বাচনি দৌড়ে শামিল হওয়ার পর গতি পায় প্রচার। শক্ত প্রতিপক্ষ ডনাল্ড ট্রাম্পের বিপরীতে হ্যারিসকে সমর্থন দিতে এক কাতারে দাঁড়ান সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারসহ বিভিন্ন অঙ্গনের তারকারা।
প্রচারে নেমে প্রথম সমাবেশেই ডনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ‘আক্রমণাত্মক’ ভূমিকায় দেখা যায় হ্যারিসকে। নভেম্বরের নির্বাচনকে বর্ণনা করেন ‘সাবেক এক কৌঁসুলি এবং দোষী সাব্যস্ত অপরাধীর মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়ার’ লড়াই হিসেবে।