রাশিয়ার অনুপস্থিতিতে আইএসএসের নিয়ন্ত্রণ কঠিন হলেও, অসম্ভব নয়। কিন্তু ‘আয়ু ফুরানো’ স্পেসস্টেশনের বদলে নাসার নজর এখন অন্যদিকে।
Published : 29 Jul 2022, 04:29 PM
রাশিয়া ২০২৮ সাল নাগাদ ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস)’ ছাড়ার ঘোষণা দিলেও ‘অকুল পাথারে’ পড়ছে না নাসা।
বরং, আইএসএসের বাকি তিন অংশীদারকে নিয়ে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটি ‘ভবিষ্যতের তুরুপের তাস’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে বেশ ক’বছর ধরেই, ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে প্রাথমিক কাজ।
বাস্তবতা বলছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আইএসএস নিয়ে রাশিয়ার ‘হম্বিতম্বি’ কার্যত রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা ছাড়া আর কিছু নয়; ভূরাজনৈতিক রেষারেষির পাল্টা জবাব দিতে ‘আয়ু ফুরিয়ে যাওয়া’ মহাকাশ স্টেশনটি ব্যবহার করছে রসকসমস।
কীভাবে কাজ চলে
আইএসএসের প্রথম মডিউলটি মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। আশির দশকের শীতল যুদ্ধের বৈরিতা ভুলে মহাকাশ জয়ে জোট বেঁধেছিল দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র।
নাসা আর রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমসের পাশাপাশি প্রকল্পে যোগ দিয়েছিল জাপানের ‘জাক্সা’, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) এবং কানাডিয়ান স্পেসএজেন্সি (সিএসএ)।
মহাকাশ স্টেশনটির বিভিন্ন অংশ সংস্থাভেদে আলাদা করে চিহ্নিত করার সুযোগ থাকলেও, এর নকশা ও গঠন কাঠামো এতটাই জটিল যে, একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ যে সংস্থার হাতেই থাকুক না কেন, এর প্রত্যেকটি একে অপরের ওপর নির্ভরশীল।
ইউক্রেইনে যুদ্ধের উত্তেজনায় রসকসমসের সাবেক প্রধান দিমিত্রি রোগোজিন আইএসএসের রাশিয়ার অংশ আলাদা করে যুক্তরাষ্ট্রে আছড়ে ফেলার হুমকি দিলেও কার্যত তা সম্ভব নয়। আইএসএসের নির্মাণকাজ শেষ হতে সময় লেগেছিল এক দশকেরও বেশি। মস্কো থেকে ‘সুইচ টিপে’ এক মুহূর্তে রাশিয়ার মডিউল আইএসএস থেকে আলাদা করে ফেলার কোনো সুযোগ নেই।
মহাকাশ স্টেশনটিতে রাশিয়ার নভোচারী ও প্রযুক্তির অনুপস্থিতিতে বিপত্তি বাধবে একে মহাকাশে রাখা নিয়ে। আইএসএসকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০০ কিলোমিটার উচ্চতায় ধরে রেখেছে রাশিয়ার প্রোপালশন সিস্টেম; যা মস্কোর মিশন কন্ট্রোল থেকে নিয়ন্ত্রণ করে রসকসম।
শুরু থেকেই স্পেস স্টেশনটিকে এই উচ্চতায় সঠিক দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখার দায়িত্ব ছিল রসকসমসের ওপর। অন্যদিকে, পুরো মহাকাশ স্টেশনে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা আর লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম চালু রাখার দায়িত্ব নাসার।
রাশিয়ার অনুপস্থিতিতে স্পেস স্টেশনটি সঠিক উচ্চতায় ধরে রাখার বিষয়টি আলাদা চ্যালেঞ্জ হলেও, নাসা এর সম্ভাব্য সমাধান পরীক্ষা করে দেখছে বেশ কিছু দিন ধরেই।
জুন মাসেই নরথ্রপ গ্রুমম্যানের তৈরি ‘সিগনাস’ মহাকাশযানের মাধ্যমে আইএসএসকে ‘ধাক্কা দিয়ে’ সঠিক উচ্চতায় নেওয়ার পরীক্ষায় নাসা সফল হয়েছে বলে জানিয়েছে স্পেস ডটকম।
অর্থাৎ, রসকসমসের প্রোপালশন সিস্টেম না থাকলেও বিকল্প আছে নাসার হাতে। তবে ‘সিগনাস’ রাশিয়ার প্রোপালশন সিস্টেমের মত শক্তিশালী নয় বলে জানিয়েছেন জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির গবেষক জন লগসডন।
সিগনাসের ধাক্কায় উচ্চতা ধরে রাখা সম্ভব হলেও আইএসএসকে সঠিক দিকে ঘোরানোর বিষয়টির কোনো কার্যকর সমাধান এখনও পায়নি নাসা।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এক্ষেত্রে ‘সিগনাস’, স্পেসএক্সের ড্রাগন অথবা ওরিয়ন স্পেসক্র্যাফটের যে কোনো একটি ব্যবহার করে এর সমাধান করার চেষ্টা করতে পারে নাসা।
নাসা কী করছে
১৯৯৮ সালে শুরু করে আইএসএসের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল ২০১১ সালে। প্রাথমিক অবস্থায় ২০১৫ সাল পর্যন্ত মহাকাশ স্টেশনটি চালু রাখার পরিকল্পনা করেছিল নাসা।
তারপর সে সময়সীমা বেড়েছে একাধিকবার। প্রথমে ২০২০ সাল পর্যন্ত আইএসএসের সময়সীমা বাড়িয়েছিল নাসা। এরপর সেটি বেড়ে পৌঁছায় ২০২৪ পর্যন্ত।
সর্বশেষ, এ বছরেই ২০৩০ সাল পর্যন্ত আইএসএস চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্কিন সংস্থাটি। অব্যাহত সমর্থনের সবুজ সংকেত আর তহবিলের প্রতিশ্রুতি মিলেছে হোয়াইট হাউজ থেকে।
গত তিন দশকের মধ্যে আইএসএস মহাকাশের একমাত্র আন্তর্জাতিক স্পেশ স্টেশনের ভূমিকা পালন করে এলেও এর আয়ু যে সীমিত, সে প্রসঙ্গে প্রথম থেকেই অবহিত ছিল নাসা। মাঝের কয়েক বছরে তহবিল সঙ্কট আর নানা প্রতিবন্ধকতায় নাসার স্পেস মিশনগুলোর পরিধি কমে এসেছিল, বন্ধ হয়ে গিয়েছে স্পেস শাটল প্রকল্প।
ওই সময়টুকু হয়ত ভবিষ্যতের হিসেব মেলাতেই খরচ করেছে নাসা। আর সংস্থাটির পরিকল্পনাগুলো কার্যকর হলে, মহাকাশে আইএসএসের বিকল্প হিসেবে জায়গা করে নেবে একাধিক বাণিজ্যিক স্পেস স্টেশন।
সর্বশেষ, ২০২১ সালের ৩ ডিসেম্বর মহাকাশে বাণিজ্যিক স্পেস স্টেশনের নকশা তৈরির লক্ষ্যে তিনটি কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছে নাসা। চুক্তির অংশ হিসেবে স্পেসস্টেশনের নকশার জন্য ওয়াশিংটনভিত্তিক ‘ব্লু অরিজিন’, হিউস্টনভিত্তিক ‘ন্যানোর্যাক্স’ এবং ডালাসের নরথ্রপ গ্রুমম্যানকে মোট ৪১ কোটি ৫৬ লাখ ডলার তহবিল দেবে সংস্থাটি।
এই স্পেসস্টেশনগুলোকে নাসা একই সঙ্গে দুই কাজে ব্যবহার করতে চায়। প্রথমত, আইএসএস পরবর্তী সময়ে বাণিজ্যিক স্পেসস্টেশনগুলো থেকেই মহাকাশে অনুসন্ধান, গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের কাজ চালু রাখতে চায় তারা।
দ্বিতীয়ত, মহাকাশে বাণিজ্যিক পর্যটনের সুযোগ দিতে চায় সংস্থাটি। এতে বাড়তি আয়ের খাত তৈরি হবে নাসা এবং নকশাকারী কোম্পানি উভয়ের জন্য।
তবে, এই বাণিজ্যিক স্পেস স্টেশনগুলোর দৃশ্যপটে আসতে আরও বেশ কয়েক বছর সময় লাগবে। মাঝের সময়টায় আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছে নাসা। আর সে কাজে নাসার সঙ্গে আছে রাশিয়া বাদে আইএসএসের বাকি তিন অংশীদার।
তুরুপের তাস ‘গেটওয়ে’
চাঁদের বুকে মার্কিন নভোচারীদের ফেরাতে উঠে-পড়ে লেগেছে নাসা। ‘আর্টেমিস’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যেই আবার চাঁদে নভোচারী পাঠাতে চায় সংস্থাটি।
আর আইএসএস নিয়ে রাশিয়ার ‘হম্বিতম্বি’ এবং আইএসএস পরবর্তী অনিশ্চয়তার উত্তর লুকিয়ে আছে আর্টেমিস প্রকল্পেই।
এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে নতুন লুনার স্পেস স্টেশন ‘গেটওয়ে’ নির্মাণ করছে নাসা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্ভবত মহাকাশে এটিই হতে যাচ্ছে নাসার ‘তুরুপের তাস’।
‘গেটওয়ে’ নাসা একা নির্মাণ করছে না, প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে জাক্সা, ইএসএ এবং সিএসএ। আরও অংশ নিচ্ছে ম্যাক্সার টেকনোলজিস এবং স্পেসএক্সের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো; নেই কেবল রাশিয়ার রসকসমস।
২০২৪ সালের নভেম্বর মাস নাগাদ ‘গেটওয়ে’র প্রথম দুটি মডিউল স্পেসএক্সের ফ্যালকন হেভি রকেটের মাধ্যমে চাঁদের কক্ষপথে পাঠানোর চুক্তি করে রেখেছে নাসা। প্রথম দুটি মডিউলে থাকবে ম্যাক্সার টেকনোলজিসের তৈরি বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা আর প্রোপালশন সিস্টেম এবং ‘হ্যাবিটেশন অ্যান্ড লজিস্টিক্স আউটপোস্ট (হেলো)’। পুরো লুনার স্পেসস্টেশন নিয়ন্ত্রণ করা হবে ‘হেলো’ থেকেই।
পরবর্তী সকল চন্দ্রাভিযান ‘গেটওয়ে’ থেকেই পরিচালনার পরিকল্পনা করে রেখেছে নাসা। চাঁদ ছাড়াও মহাকাশে নাসার অন্যান্য মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা রয়েছে লুনার স্পেস স্টেশনটির।
রাশিয়ার কী পরিকল্পনা
২৭ জুলাই বর্তমান রসকসমস প্রধান ইউরি বোরিসভের বরাত দিয়ে খবরে এসেছিল, ২০২৪ সালের পর আইএসএসের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশিয়া।
তার একদিনের মাথায় রসকসমসের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, অংশীদারদের সঙ্গে বিদ্যমান সমঝোতা ভঙ্গ করার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই, ২০২৮ সাল পর্যন্ত আইএসএসের সঙ্গে থাকবে তাদের সংস্থা।
আগের এক বক্তব্যে বোরিসভ বলেছিলেন, রাশিয়া ২০২৪ সালের মধ্যে মহাকাশে নিজস্ব স্পেস স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু করবে বলে আশা করছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। কিন্তু মঙ্গলবারেই উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে রসকসমস। তার বক্তব্যের বরাতে ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, রাশিয়া নিজস্ব স্পেস স্টেশনের প্রথম অংশগুলো মহাকাশে পাঠাবে ২০২৮ সালে বা তার পরে।
অর্থাৎ, রাশিয়া নিজস্ব মহাকাশ স্টেশন বানানোর কথা বললেও সম্ভবত রসকসমসের আগেই নিজস্ব লুনার স্পেস স্টেশনের নির্মাণ কাজ শেষ করবে নাসা। আর রাশিয়া সম্ভবত নিজস্ব স্টেশনের প্রথম মডিউল মহাকাশে পাঠানোর সম্ভাব্য সময় মাথায় রেখেই ২০২৮ সাল নাগাদ আইএসএস ছাড়ার কথা বলছে।