২০ বছর আগে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় ফেইসবুকের প্রাথমিক সংস্করণ উন্মোচন করেছিলেন মার্ক জাকারবার্গ ও তার কয়েকজন বন্ধু।
Published : 05 Feb 2024, 05:55 PM
২০ বছর আগে ছাত্রজীবনে ফেইসবুকের প্রাথমিক সংস্করণ উন্মোচন করেছিলেন মার্ক জাকারবার্গ ও তার কয়েক বন্ধু। এর পর থেকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটির নকশা বেশ কয়েকবার বদলেছে।
তবে, এর মধ্যেও একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়েছে বর্তমানে মেটা নামে রিব্র্যান্ড করা কোম্পানিটি, তা হল অনলাইনে মানুষের সংযোগ ঘটানো। এ ছাড়া, বিজ্ঞাপনী খাত থেকেও পাহাড়সম অর্থ আয়ের লক্ষ্যস্থির করেছিল ফেইসবুক।
এই ২০ বছরে ‘যে চার উপায়ে গোটা বিশ্বকে বদলে দিয়েছে ফেইসবুক’, তা উঠে এসেছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
সামাজিক যোগাযোগ খাতে এনেছে ‘বড় পরিবর্তন’
ফেইসবুকের আগেও মাইস্পেস-এর মতো অন্যান্য সামাজিক নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব ছিল অনলাইন জগতে। তবে, ২০০৪ সালে উন্মোচনের পর থেকেই দ্রুততার সঙ্গে এগিয়েছে জাকারবার্গের ফেইসবুক।
উন্মোচনের এক বছরের মধ্যেই ১০ লাখ ব্যবহারকারীর মাইলফলক স্পর্শের পাশাপাশি চার বছরেই মাইস্পেসকে টপকে গিয়েছিল ফেইসবুক, যেখানে মূল উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছে মানুষের ছবি ‘ট্যাগ’ করার মতো নতুন উদ্ভাবন।
রাতে ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার পর তোলা বিভিন্ন ছবি ট্যাগ করাও কিশোরবয়সীদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল এক সময়। এমনকি ফেইসবুকের অ্যাকটিভিটি ফিডে ক্রমাগত বিভিন্ন নতুন পরিবর্তনও বড় আগ্রহের বিষয় ছিল প্রথম দিকের ব্যবহারকারীদের কাছে।
২০১২ সাল নাগাদ একশ কোটি মাসিক ব্যবহারকারীর মাইলফল অতিক্রম করে ফেইসবুক। তবে, ২০২১ সালের শেষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটির উর্ধ্বমূখী গ্রাফ কিছুটা ধাক্কা খায়, যখন প্রথমবার এর দৈনিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমে আসতে দেখা গিয়েছিল। তবে, এর পর থেকে নিজেদের অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রেখেছে কোম্পানিটি।
এদিকে, তুলনামূলক কম সক্রিয় দেশগুলোতে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করেও নিজেদের বিস্তৃতি বাড়িয়েছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জায়ান্ট, যার ফলে ব্যবহারকারী সংখ্যাও দ্রুতগতিতে বেড়েছে।
২০২৩ সালের শেষ দিকে ফেইসবুক জানিয়েছে, তাদের দৈনিক ব্যবহারকারী সংখ্যা ২১১ কোটি।
তবে, কম বয়সীদের কাছে ফেইসবুকের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লেও এখনও বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমের খেতাব এখনও দখলে রেখেছে কোম্পানিটি। এ ছাড়া, অনলাইনে সামাজিক জীবন তুলে ধরার নতুন যুগের সূচনাও এ ফেইসবুকের হাত ধরেই।
কেউ কেউ ফেইসবুক ও এর প্রতিদ্বন্দ্বী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে দেখে সংযোগ তৈরির জায়গা হিসেবে। আর একটি অংশ একে আখ্যা দিয়েছে ‘ধ্বংসযজ্ঞ চালানো আসক্তিমূলক ব্যবস্থা’ বলে।
ব্যক্তি ডেটার বাণিজ্যে ব্যক্তি জীবন থেকে কেড়েছে প্রাইভেসি
অন্যদের কাছ থেকে লাইক বা ডিসলাইক পাওয়া যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তার প্রমাণ দেখিয়েছে ফেইসবুক।
সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞাপনী খাতেও ‘জায়ান্ট’-এর তকমা পেয়েছে ফেইসবুকের মালিক কোম্পানি মেটা, যে খাতে বৈশ্বিক আয়ের সিংহভাগই যায় সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগলের কাছে।
বৃহস্পতিবার মেটা জানিয়েছে, ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে কোম্পানির আয় চার হাজার কোটি ডলারের বেশি, যার সিংহভাগই এসেছে বিজ্ঞাপনী সেবা থেকে, যেখান থেকে এক হাজার চারশ কোটি ডলারের আর্থিক লভ্যাংশ এসেছে বলে ঘোষণা দিয়েছে কোম্পানিটি।
তবে, ডেটা সংগ্রহের ক্ষতিকারক দিকও দেখা গেছে ফেইসবুকে।
ব্যক্তিগত ডেটা ঠিকমতো না সামলানোর অভিযোগে একাধিকবার জরিমানা গুনেছে মেটা।
এর মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা ছিল ২০১৪ সালের ‘কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা’ স্ক্যান্ডাল, যেখানে বড় ডেটা ফাঁসের অভিযোগ তোলা এ মামলা নিষ্পত্তি করতে সাড়ে ৭২ কোটি ডলার অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছিল ফেইসবুক।
এদিকে, সাইট থেকে ব্যক্তিগত ডেটা বের করার অভিযোগে ২০২২ সালেও ইউরোপে সাড়ে ২৮ কোটি ডলারের বেশি জরিমানা গুনেছে কোম্পানিটি।
এ ছাড়া, ইউরোপীয় ব্যবহারকারীদের ডেটা ইউরোপের বাইরে স্থানান্তর করার অভিযোগে গত বছর ফেইসবুককে রেকর্ড ১২০ কোটি ডলার জরিমানার আদেশ দিয়েছে ‘আইরিশ ডেটা প্রোটেকশন কমিশন (আইডিপিসি)’। বর্তমানে এ জরিমানার বিরুদ্ধে আপিল করছে ফেইসবুক।
অনলাইন জগৎকে করে তুলেছে ‘রাজনৈতিক’
গ্রাহককে টার্গেট করে বিজ্ঞাপন দেখানোর সুবিধা চালুর পর থেকে গোটা বিশ্বেই নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে ফেইসবুক।
জার্মানভিত্তিক ডেটা গবেষণা কোম্পানি স্টাটিস্টা’র তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে ফেইসবুকে বিজ্ঞাপন দেখাতে চার কোটি ডলারের বেশি খরচ করেছে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের দল।
পাশাপাশি, রাজনীতির মূল শেকড়ে বড় পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রেও হাত রয়েছে ফেইসবুকের, যেখানে তারা ভিন্নমতের দলকে অনলাইনে একত্র হওয়ার, নিজস্ব প্রচারণা চালানোর ও বৈশ্বিক স্তরে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিকল্পনার সুযোগ দিয়েছে।
এদিকে, ‘আরব স্প্রিং’ নামের প্রতিবাদ কর্মসূচী সমন্বয় করা ও রণক্ষেত্রে কী হচ্ছে, সে খবর গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কৃতিত্বও পেয়েছে ফেইসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো।
তবে, ফেইসবুকে রাজনৈতিক প্রচারণা চালানোর ভয়াবহ ফলাফল নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়েছে প্ল্যাটফর্মটি। এর মধ্যে রয়েছে মানবাধিকারের ওপর এর প্রভাবের বিষয়টিও।
২০১৮ সালে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ফেইসবুক স্বীকার করেছিল, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর ‘সহিংসতা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে’ লোকজন যে তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছে, কোম্পানি সেটি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।
মেটার আধিপত্য শুরু
ফেইসবুকের অভাবনীয় সাফল্যের পরপরই কোম্পানির সিইও মার্ক জাকারবার্গ এমন একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেটওয়ার্ক ও প্রযুক্তি সৃষ্টি করেছেন, যা ব্যবহারকারী ও সক্ষমতার বিচারে তাদেরকে নিরঙ্কুশভাবে শীর্ষে রেখেছে।
হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম ও অকুলাসের মতো বেশ কিছু উদীয়মান কোম্পানি কিনে সেগুলোকে ফেইসবুকের ছায়াতলে নিয়ে আসার পর ২০২১ সালে নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘মেটা’ রাখে কোম্পানিটি।
বর্তমানে মেটার অন্তত একটি পণ্য দৈনিক ব্যবহার করেন, এমন ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিনশ কোটিরও বেশি।
আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে কিনতে না পারলে বাজারে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে প্রায়শই সেইসব কোম্পানির বিভিন্ন ফিচার চুরি করার অভিযোগ এসেছে মেটার বিরুদ্ধে।
উদাহরণ হিসেবে, ফেইসবুক ও ইনস্টাগ্রামের ‘স্টোরিস’ ফিচারের মিল খুঁজে পাওয়া যায় স্ন্যাপচ্যাটের মূল ফিচারের সঙ্গে। এ ছাড়া, টিকটকের চ্যালেঞ্জের জবাব হিসেবে ইনস্টাগ্রামে ‘রিলস’ ফিচার ও এক্স-এর (তৎকালীন টুইটারের) প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে থ্রেডস অ্যাপও চালু করেছে কোম্পানিটি।
সম্প্রতি প্রতিযোগিতার চাপ বেড়ে যাওয়া ও কঠোর নিয়ন্ত্রক পরিবেশের কারণে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিভিন্ন নতুন্ন কৌশল অবলম্বন।
২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের নিয়ন্ত্রকদের বাধার মুখে পড়ে এক প্রকার লোকসানেই ‘জিফ’ নির্মাতা কোম্পানি ‘জিফি’ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল মেটা। এই পরিষেবার মালিকানার সুযোগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বাজারে মেটা একচেটিয়া রাজত্ব করতে পারে, এমন ঝুঁকিকে এর কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিবিসি।