শিশুর সামাজিক মাধ্যমে মা-বাবার আইনী কর্তৃত্ব, শেষরক্ষা হবে?

“ডিজিটাল শিষ্টাচার স্কুলেই শেখাতে হবে। মা-বাবার ঘাড়ে নজরদারির বোঝা না বাড়িয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোকে আরও দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।”

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 April 2023, 12:40 PM
Updated : 17 April 2023, 12:40 PM

নতুন আইন তৈরি হিড়িক শুরু হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোয় - শিশু বয়সীদের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে মা-বাবা বা অভিভাবকদের অনুমতি বাধ্যতামূলক করাই এইসব আইনের প্রাথমিক লক্ষ্য।

অদূর ভবিষ্যতে কোনো শিশু বা কিশোরবয়সীর ফেইসবুক বা ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট খুলতে হলে প্ল্যাটফর্মে তাদের মা-বাবা বা অভিভাবকের সম্মতির প্রমাণ যোগ করতে হবে। আইনের আওতায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাবা মায়েরা সন্তানের কনটেন্ট নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণও করতে পারবেন।

এরইমধ্যে কিছু মার্কিন অঙ্গরাজ্য এমন আইন পাশ করে ফেলেছে, আর অনেক অঙ্গরাজ্যে এর প্রক্রিয়া চলছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই নতুন আইনের কারণ হিসেবে উঠে এসেছে শিশুদের জন্য নিরাপদ অনলাইন তৈরির বিষয়টি।

কিন্তু বিষয়টি কি এত সরলভাবে দেখার অবকাশ আছে? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে সংবাদসংস্থা সিএনএন।

সম্প্রতি আরকানস ও ইউটাহ অঙ্গরাজ্যের গভর্নর দুজন নিজ নিজ অঙ্গরাজ্যের জন্য এ সংক্রান্ত দুটো বিলে স্বাক্ষর করেছেন। কনেক্টিকাট ও ওহাইও অঙ্গরাজ্যেও এই ধরনের আইন তৈরির কাজ এগোচ্ছে। গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ফেডারেল আইন তৈরি না করে, অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে এই ধরনের আইনের বিধান নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন এ নিয়ে।

আপাত স্বস্তি?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে সন্তান বিপথগামী হতে পারে, যে অভিভাবকরা এমন দুশ্চিন্তায় থাকেন, নতুন আইনের ফলে তারা সন্তানদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন– এমনটা ভেবে প্রাথমিকভাবে তাদের কেউ কেউ হয়তো স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তরুণ ব্যবহারকারী, অধিকারকর্মী, আইনজীবি ও বিশেষজ্ঞরা এই নতুন আইনের ফলে নানারকম সম্ভাব্য ঝুঁকির কথা বলছেন।

জাতিসংঘ সনদ অনুসারে বয়স ১৮ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রত্যেকেই আইনত শিশু। ফলে এই আইনের বাধ্যবাধকতা ১৮ বছর বয়সের কম সবার জন্যই প্রযোজ্য হয়ে উঠবে।

কী বলছে সামাজিক মাধ্যমগুলো?

পর্নোগ্রাফি, সাইবার-বুলিয়িং ও অনিরাপদ ওয়েবসাইটের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মের আসক্তি-সৃষ্টিকারী অ্যালগরিদম নিয়ে দায়বদ্ধতার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছে ফেইসবুকের মূল কোম্পানি মেটা। এই বিলের ব্যাপারে তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, সচেতন মা-বাবা এবং আইন প্রণেতাদের মত তারাও একটা ইতিবাচক, নিরাপদ ও সবার জন্য উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চায়। কিন্তু এই আইনের সঙ্গে কীভাবে তারা সমন্বয় করেবে সে ব্যাপারে কেউ কিছু বলেনি।

টিকটকের মুখপাত্রও শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে মা-বাবাদের সংশ্লিষ্টতা বাড়ানোর কথাই বলেছেন। আর স্ন্যাপচ্যাটের মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুখ খুলতে রাজি হননি।

নতুন আইনের আঘাত লাগবে মানবাধিকারে?

বিশেষজ্ঞরা এমন আইনের আবির্ভাবকে প্রাইভেসির উপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ হিসাবে দেখছেন। ডিজিটাল অধিকার নিয়ে কাজ করা অলাভজনক সংগঠন ইলেকট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশনের ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজি বিষয়ক সহযোগী পরিচালক জেসন ক্যালেই। তিনি বলছেন, “এখন রাষ্ট্র ঠিক করে দিচ্ছে কীভাবে শিশুদের লালন-পালন করতে হবে। এতে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।”

তার মতে “সামাজিক মাধ্যমে কিছু প্রকাশের জন্য সরকারের কাছে তাদের শনাক্তকরণ তথ্য দিতে বাধ্য করা হলে, তা যে কোনো বয়সের নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।”

“বিগ টেকের রাজনীতিতে শিশুদের গুটি হিসাবে ব্যবহার করা একেবারেই উচিত নয়।”

নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ ল’র ফেলো এবং ‘সারভেলেইন্স টেকনোলজি ওভারসাইট প্রজেক্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক আলবার্ট ফক্স চ্যান মনে করেন, নতুন আইনটি ত্রুটিপূর্ণ। এর ফলে অনলাইনে একজন ব্যবহারকারীর ব্যাক্তিগত পরিচয় গোপন রাখার সুযোগটি থাকবে না। ফলে তথ্য অনুসন্ধান ও মত প্রকাশের জন্য অনলাইন ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমতে পারে।

“এই আইনের দ্বারা এলজিবিটিকিউ-প্লাস সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত হবে। সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি বিদ্বেষী মা-বাবারা এই আইনের সহায়তায় তাদের সন্তানদেরকে ওইসব ডিজিটাল গোষ্ঠী থেকে সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারবে।”

আইন করলেও সমাধান হচ্ছে না

এবিআই রিসার্চের অ্যানালিস্ট মাইকেল ইনোয়ি বলেন, সদ্য স্বাক্ষরিত নতুন এই আইনগুলো একে তো অপ্রতিরোধ্য তার উপর অস্পষ্ট। সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলো কিভাবে সেগুলোর প্রয়োগ করবে সে বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা নেই। 

“বাড়িতে অভিভাবক যদি সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার না করেন, তবে সন্তান তাদের পরিচয় জালিয়াতি করে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। এছাড়া শিশু ব্যবহারকারীরা ভিপিএন ব্যবহার করে সহজেই আইপি এড্রেস পরিবর্তন করেও অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে।” কারণ, ভিপিএন ব্যবহার করে নিজের অবস্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে ওই আইন এড়ানো সম্ভব।

ইউটাহ, আরকানস বা অন্য অঙ্গরাজ্যে এই আইন তৈরির প্রক্রিয়া শিশুকিশোরদের নিরাপত্তার মূল সমস্যা থেকে অনেক দূরে। ইনোয়ি মনে করেন, এটি একসময় ভুল প্রমাণিত হবে।

যাদের জন্য আইন, তারা কী বলছেন?

ইউটাহ ভ্যালি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ও টিকটক ইনফ্লুয়েন্সার ১৮ বছরের লুসি ইভেই এই আইনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। 

“এইসব নতুন আইনের মাধ্যমে আদতে সরকারের ভয় দেখিয়ে, বাবা-মায়ের ভয় দেখিয়ে, কিশোর কিশোরীদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে এমন একটা সময়ে যেটা নিজেকে চিনে নেওয়ার বয়স, আত্মপ্রকাশের বয়স।”

সমাধান তাহলে কোথায়?

‘রেইজিং কিডস ইন ডিজিটাল এজ’ বইয়ের লেখক ও প্রখ্যাত বক্তা ডেভোরা হেইটনার মনে করেন, শিশুদের সামনে আছে উচ্চশিক্ষা, সুদীর্ঘ কর্মজীবন, যা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ডিজিটাল দুনিয়ার সঙ্গে। তাই তাদের ডিজিটাল দুনিয়ার নিয়মকানুন ও নিরাপত্ত্বা যত্নের সঙ্গে শেখাতে হবে, তাদের উপর কোন খবরদারি চাপিয়ে দিয়ে নয়।

তিনি বলেন, “অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, খণ্ডকালীন কাজ করছে, কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স নিচ্ছে, এমন একজন, স্রেফ বয়স ১৮ হয়নি বলে স্বাধীনভাবে ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে না, তার নিজের পছন্দমত কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে না?”

হেইটনার মনে করেন, ডিজিটাল শিষ্টাচার স্কুলেই শেখাতে হবে। পর্নোগ্রাফি, সাইবার-বুলিয়িং ও অনিরাপদ ওয়েবসাইটের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমের আসক্তি-সৃষ্টিকারী অ্যালগরিদমের ব্যাপারেও শিশুদের সচেতন করতে হবে।

“মা-বাবার ঘাড়ে নজরদারির বোঝা না বাড়িয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোকে আরও দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।”

আরকানসাস রাজ্যে আসছে সেপ্টেম্বর থেকে এবং ইউটাহতে আগামি বছরের মার্চ থেকে এই নতুন আইনগুলো কার্যকর হবে। কিন্তু, ফক্স চ্যান মনে করেন, এই ধরনের আইন প্রয়োগের আগে অন্তত কয়েক বছর ধরে শুনানি ও পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।

“আশাকরি এর আগেই কংগ্রেস দেশবাসীকে প্রকৃত নিরাপত্ত্বা দিতে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করবে।” - ফক্স চ্যান বলেন।