এখন পর্যন্ত কোনো দেশই চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণ করতে পারেনি। ২০১৯ সালে বিস্ফোরিত হয় ভারতের চাঁদে অবতরণের সর্বশেষ প্রচেষ্টা ‘চন্দ্রযান ২’।
Published : 11 Aug 2023, 02:40 PM
চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করা প্রথম দেশ হওয়ার লক্ষ্যে ৪৭ বছরের দীর্ঘ বিরতির পর নিজেদের প্রথম মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করেছে রাশিয়া। অনুমান বলছে, ওই এলাকায় ‘বরফ পানির’ খোঁজ মিলতে পারে।
শুক্রবারের উৎক্ষেপণটি ১৯৭৬ সালের পর থেকে রাশিয়ার প্রথম চন্দ্রাভিযান। আর তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ভারতের সঙ্গে। গত মাসেই ‘চন্দ্রযান ৩’ নামের নিজস্ব মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করেছে দেশটি।
এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গেও আরও বিস্তৃত পরিসরে প্রতিদ্বন্দ্বিতার লক্ষ্যস্থির করেছে রাশিয়া। এরইমধ্যে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে কয়েকটি অগ্রগামী প্রকল্প পরিকল্পনা করেছে দেশ দুটি।
রাশিয়ার পূর্বাংশে অবস্থিত ‘ভস্তচনি কসমোড্রোম’ স্পেসপোর্ট থেকে ‘সয়ুজ ২.১ভি’ নামের রকেটে বহন করা ‘লুনা ২৫’ চন্দ্রযানটি উৎক্ষেপিত হয়েছে শুক্রবার বাংলাদেশ সময় ভোর পাঁচটা ১১ মিনিটে। আর এর ওপরের স্তরটি পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে তার ঘণ্টাখানেক পর চাঁদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে বলে জানিয়েছে রাশিয়ার মহাকাশ সংস্থা ‘রসকসমস’।
শুক্রবার সংস্থাটির প্রধান ইউরি বরিসভ স্থানীয় সংবাদ সংস্থা ‘ইন্টারফ্যাক্সকে বলেন, চন্দ্রযানটি চাঁদে অবতরণ করতে পারে ২১ অগাস্ট। এর আগে রসকসমস অবতরণের তারিখ নির্ধারণ করেছিল ২৩ অগাস্ট।
“আমরা এখন ২১ তারিখের অপেক্ষায়। আমি আশা করি, অবতরণটি নির্ভুল ও সফল হবে।” --ইন্টারফ্যাক্সের তথ্য অনুসারে, ভস্তচনি কসমোড্রোমের কর্মীদের বলেছেন বরিসভ।
চন্দ্রযানটি আকারে ছোট একটি গাড়ির সমান। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এক বছর কার্যক্রম চালানোর কথা বিবেচনায় রেখে তৈরি এটি। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ওই এলাকার ‘ছায়াযুক্ত গর্তে’ বরফ পানির উপাদান শনাক্ত করেছে নাসা’সহ বিভিন্ন মহাকাশ সংস্থা।
এই মিশন রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্রেমলিন বলছে, ইউক্রেইন যুদ্ধের পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার অজুহাতে অনেক দেশই মস্কোর মহাকাশ খাতকে টার্গেট করেছে। তবে, সেটা রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করতে পারেনি।
এই অভিযানের মাধ্যমে মহাকাশে নিজেদের স্বতন্ত্র উপস্থিতির বিষয়টিও পরীক্ষা করবে বেশ কয়েক দশক যাবত চাঁদে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা করা রাশিয়া।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে সামরিক আগ্রাসন চালানোর পর মহাকাশ খাতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ‘প্রায় সব সম্পর্কই শেষ করে দিয়েছে’ দেশটি। এর ব্যতিক্রম কেবল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন, যেখানে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার পরিকল্পনা ছিল, এই অভিযানে তারা নিজেদের ‘পাইলট-ডি’ নামের ন্যাভিগেশন ক্যামেরাটি পরীক্ষা করবে। তবে, ইউক্রেইনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন শুরুর পর সংস্থাটি সেই প্রকল্প থেকে সরে আসে।
“চাঁদের প্রতি রাশিয়ার আকাঙ্ক্ষা অনেক বিষয়ের সঙ্গেই মিশে আছে। আমি মনে করি, বৈশ্বিক মঞ্চে জাতীয় শক্তির বহিঃপ্রকাশ এটি।” --রয়টার্সকে বলেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফোর্ডহাম ইউনিভার্সিটি’র ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আসিফ সিদ্দিকি।
১৯৬৯ সালে চাঁদে পাড়ি জমানো প্রথম ব্যক্তি হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন মার্কিন নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং। তবে, বিশ্বের প্রথম মহাকাশযান হিসেবে চন্দ্রপৃষ্ঠে পৌঁছায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘লুনা-২’। এ ছাড়া, ১৯৬৬ সালে প্রথম মহাকাশযান হিসেব চাঁদে প্রথম সফল অবতরণ করেছিল ‘লুনা ৯’।
পরবর্তীতে মঙ্গলগ্রহে অনুসন্ধান চালানোর দিকে মনযোগ দেয় মস্কো। তবে, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর থেকে পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে কোনো বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালায়নি রাশিয়া।
চাঁদের পানি?
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চাঁদে পাড়ি জমানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো পরাশক্তিরা। গত বছর ‘হাকুতো-আর’ নামে নিজস্ব চন্দ্রাভিযানের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এক জাপানি কোম্পানি। আর ২০১৯ সালে ইসরায়েল নিজস্ব চন্দ্রযান ‘বিয়ারশিট’ উৎক্ষেপণ করলেও সেটি বিস্ফোরিত হয়।
এখন পর্যন্ত কোনো দেশই চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণ করতে পারেনি। ২০১৯ সালে বিস্ফোরিত হয় ভারতের চাঁদে অবতরণের সর্বশেষ প্রচেষ্টা ‘চন্দ্রযান ২’।
চাঁদের দক্ষিণ মেরুর ভূখণ্ড অসমতল হওয়ায় সেখানে অবতরণ করা জটিল। তবে, সেখানে বরফ পানির সন্ধান পাওয়া গেলে তা ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে। এর থেকে বিভিন্ন জ্বালানী এমনকি অক্সিজেন সংগ্রহের সম্ভাবনা আছে। আর খাওয়ার পানি তো বটেই।
“বৈজ্ঞানিক বিবেচনায়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এমন জায়গায় অবতরণ করা, যেখানে অন্য কেউ আসেনি।” --বলেন লুনা ২৫ মহাকাশযানের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রাংশ পরিকল্পনাকারী দলের প্রধান মাক্সিম লিতভাক।
“লুনার ২৫ মিশনের অবতরণের জায়গাটিতে বরফের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আর এটি দেখা গেছে কক্ষপথ সংশ্লিষ্ট ডেটায়।” --বলেন তিনি। তিনি আরও যোগ করেন, বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অন্তত এক বছর চাঁদে অবস্থান করবে লুনা ২৫।
রসকসমস বলেছে, চাঁদে যেতে সময় লাগবে পাঁচ দিন। সম্ভাব্য তিনটি ‘ল্যান্ডিং সাইটে’ অবতরণ করার আগে নভোযানটি চাঁদের কক্ষপথে আরও পাঁচ থেকে সাতদিন সময় কাটাবে। ফলে, ভারতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী নভোযান ও এটি চন্দ্রপৃষ্ঠে একই সময় অথবা কিছু সময় আগে পরে অবতরণ করতে পারে।
ভারতের ‘চন্দ্রযান ৩’ নভোযানটি বিভিন্ন পরীক্ষা চালাবে দুই সপ্তাহ।
চাঁদে থাকা নুড়ি পাথরের নমুনা সংগ্রহের জন্য একটি হাতল ব্যবহার করবে ৩১ কেজি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বহন করা এক দশমিক আট টন ওজনের ‘লুনা ২৫’ নভোযানটি। হাতলটির খননের সক্ষমতা ছয় ইঞ্চি পর্যন্ত। আর এর মাধ্যমে চাঁদের মাটিতে বরফ পানি আছে কি না, সেটির পরীক্ষা চালানো হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রয়টার্স।