‘চ্যালেঞ্জটা নারীকেই নিতে হবে’

বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় পুরুষের পাশাপাশি নারী প্রকৌশলীদের অবদান এখন আর চমক জাগানিয়া কোনো বিষয় নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী প্রকৌশলীরা ছাড়িয়ে গেছেন পুরুষকেও।

আইরিন সুলতানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2018, 10:33 AM
Updated : 8 March 2018, 10:52 AM

তবে নারী কিংবা পুরুষ- এমন লৈঙ্গিক পরিচয় নয়, একজন ‘প্রকৌশলী’ হিসেবেই সবাইকে মাপতে চান প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে এক আলাপচারিতায় প্রকৌশলীদের সংগঠন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) সভাপতি আবদুস সবুর নারী সহকর্মীদের অবদানের কথা জানিয়েছেন।      

বিপরীত চিত্রও রয়েছে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ আশাব্যাঞ্জক নয় বলে এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন। এক্ষেত্রে তারা সামাজিক বাধাকে মূল কারণ হিসেবে দেখলেও নারীকেই ‘চ্যালেঞ্জটা’ নিতে হবে বলে মনে করেন।

প্রকৌশলী আবদুস সবুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফার ডটকমকে বলেন, “সময়ের বিবর্তনে জেন্ডার কোনো ইস্যু না। মহিলা হোক বা পুরুষ- আমরা আসলে তাকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেই দেখতে চাই। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা সেভাবেই কাজ করে। মহিলারা ফিল্ডে দাপটের সাথে কাজ করে। আমি মনে করি আমাদের দেশের ইঞ্জিনিয়াররা সার্ক দেশগুলোর মধ্যে অনেক এগিয়ে আছে।”

তিনি বলেন, “পদ্মা ব্রিজের মত বিশাল প্রজেক্টে নারী ইঞ্জিনিয়ার রয়েছে। বিটিআরসিতে অনেক ইঞ্জিনিয়ার রয়েছে। আজকে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনেও নারী ইঞ্জিনিয়াররা কাজ করেছে। গ্রাম পর্যায়ে সড়ক-কালভার্ট নির্মাণে মাইলের পর মাইল হেঁটে- সে নারী না, বরং একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছে। কেমিক্যালে অনেক মেয়ে কাজ করছে। ভেহিকেল ডিজাইনেও আমাদের মেয়েরা আন্তর্জাতিকমানে কাজ করছে। এরা সবাই আমাদের আইডল।”

অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তিখাতে সক্রিয় নারী পেশাজীবীর সংখ্যা কত, তার হালনাগাদ কোনো পরিসংখ্যান নেই।

তিন বছর আগে বেসিসের একটি জরিপে তাদের সদস্যদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা মাত্র তিন শতাংশ বলে জানানো হয়েছিল।

তবে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসানের মতে, সেটি দুই শতাংশের বেশি হবে না।

কমপিউটার সায়েন্স ও আইটি নিয়ে পড়াশোনা করেও পেশা হিসেবে নারীরা ‘কোর আইটি’ পেশা বেছে নেন না জানিয়ে মুনির হাসান বলেন, “নারী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই দেখা গেছে পুরুষ পরিচালিত। বিভিন্ন ফ্যাসিলিটি পাওয়ার জন্য বউয়ের নামে কাগজপত্র করে রাখে।

“২০১৫ সালে বিডিওএসএন থেকে আমরা একটি সার্ভে করেছিলাম। ১২০০ ছেলেমেয়ে, যারা কমপিউটার সায়েন্স পড়ে, তাদের জন্য একটাই প্রশ্ন ছিল- তুমি কি প্রোগ্রামার হতে চাও, নাকি চাও না? খারাপ দিক হল যে কয়জন মেয়েকে আমরা প্রশ্ন করেছিলাম, তাদের মধ্যে লেস দেন এক শতাংশ বলেছিল তারা প্রোগ্রামার হতে চায়।”

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজির (বিডব্লিআইটি) প্রেসিডেন্ট এবং সফটওয়ার কোম্পানি দোহাটেক নিউ মিডিয়ার চেয়ারম্যান লুনা শামসুদ্দোহা বলেন, “সায়েন্স, টেকনলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং- মেয়েরা একটু কম পড়ে। বাংলাদেশেও মেয়েরা সায়েন্সটা কম পড়ে। আর সামাজিক একটা সমস্যা আছে। সায়েন্স পড়তে গেলে একটু খরচ বেশি। কমপিউটার লাগে। আর্টস পড়তে গেলে লাগে না।”

নিজের সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে নারীদের কাছ থেকে কম আবেদনপত্র পাওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে লুনা বলেন, “আইটিতে রাতদিনের একটা ব্যাপার আছে। সেখানে মেয়েদের জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বাধা হয়ে যায়।”

নারী দিবসে তথ্যপ্রযুক্তিতে নারী পেশাজীবীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আমরা সব সময় ভাবি যে ব্যর্থ হলে কী হবে? উদ্যোক্তা যারা আছেন, পরে যেতে যেতে উঠে আবার দৌঁড়ানো শিখতে হবে। চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে। মেয়েদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে নিজে থেকে।”

এক হাজার নারী সদস্যের উইমেন ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (ডব্লিউআইই), আইট্রিপলই, বাংলাদেশ শাখা ২০১৭ সালে অর্জন করেছে `আইট্রিপলই উইমেন ইন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাফিনিটি গ্রুপ অফ দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড’।

এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক্স কৌশল (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক সেলিয়া শাহনাজ জানান, যোগ্যতা ও কারিগরি দক্ষতায় পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে যেন কম পারদর্শীতা না থাকে- এটা ধরে রাখতে হবে।

“আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগে আমি প্রথম নারী পিএইচডি অর্জনকারী। আমি প্রথম নারী প্রফেসর এই বিভাগের। আমার মনে হয় আমার শিক্ষক বা সহকর্মীরা, উনারা ছাত্রী দেখেছেন, ইয়ং লেকচারার দেখেছেন। কিন্তু উনারা প্রথম নারী পিএইচডি অর্জনকারী দেখেননি, প্রথম নারী প্রফেসর দেখেননি। ভুল বোঝার কিছু নেই, এটা একটা চর্চার বিষয়। ধীরে ধীরে আমরা যদি আমাদের দক্ষতার ছাপ রেখে যাই, তবে আমরা অবশ্যই তাদের সমীহ আদায় করব।”

তিনি বলেন, “এটা কেবল মাইন্ড সেটের ব্যাপার। পরিবর্তনের জন্য সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। আমাদের উইমেন ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, আইট্রিপলই বাংলাদেশ সেকশন প্রোগামে পুরুষ শিক্ষার্থী ও সদস্যরা স্বাগত। আমাদের কাজের মধ্যে পুরুষদেরও ইনভাইট করতে হবে। যেন তারা আমাদের সমস্যা বুঝতে পারে। তাহলে এর সমাধানে তারা আমাদের সহযোগী হবে, অন্তরায় নয়।”

নারীদের উদ্দেশ্যে সেলিয়া বলেন, “ম্যাসেজ অফ পজিটিভিটি হচ্ছে মানসিক দৃঢ়তা। আমরা যদি এই কথা বলতে থাকি হোয়াট আর দ্য প্রবলেমস উই আর ফেসিং তাহলে হোয়াট আর দ্য সল্যুশনস উই নিড- তা আমরা কখনই পাব না। তাই আমাদের দ্রুত সল্যুশনের দিকে চলে যেতে হবে এবং সবার আগে টেকনিক্যাল দক্ষতা জরুরি।”