‘ই-সিগারেট’ বা ‘ভেপ’ নতুন এক বিপদের নাম। এগুলো নতুন ধরনের এমন আবর্জনার পাহাড় তৈরি করছে, যেগুলো রিসাইকল করা জটিল।
Published : 03 Jul 2023, 11:22 PM
গোটা বিশ্বে মাত্রাছাড়ানো আবর্জনা পুনর্ব্যবহারের লক্ষ্যে নতুন এক এআই সিস্টেম তৈরি করেছে যুক্তরাজ্যের এক স্টার্টআপ কোম্পানি।
বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালেই কেবল প্রায় সোয়া দুইশ কোটি টন ‘সলিড ওয়েস্ট’ উৎপাদিত হয়েছে। আর, ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ৭৩ শতাংশ বেড়ে গিয়ে পৌঁছাবে তিনশ ৩৮ কোটি টনে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্লাস্টিক। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ও ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, ৫০-এর দশক থেকে বড় পরিসরে উৎপাদন শুরু হওয়া এই প্লাস্টিক থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আটশ ৩০ কোটি টনেরও বেশি বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে।
এইসব পরিসংখ্যান যুক্তরাজ্যের স্টার্টআপ কোম্পানি ‘গ্রেপ্যারট’-এর মিকেলা ড্রাকম্যানকে আর অবাক করে না। কারণ, বর্জ্যের পেছনেই অনেক সময় কাটিয়েছেন তিনি। তার কোম্পানি এমন এক এআই সিস্টেম বানিয়েছে, যা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও এর পুনর্ব্যবহার সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় বিশ্লেষণ করতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
“কেবল একটি রিসাইকেল প্ল্যান্টে একদিনে যে পরিমান বর্জ্য আসে তা আক্ষরিক অর্থেই পর্বতসম। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হল এর কোনো থামাথামি নেই।” --বলেন তিনি।
“বর্জ্যের কোনো ছুটি নেই, আসছে তো আসছেই।”
ইউরোপের প্রায় ৫০টি ‘ওয়েস্ট রিসাইক্লিং’ সাইটের কনভেয়র বেল্টের ওপর ক্যামেরা বসিয়ে ‘রিয়েলটাইমে’ এর মধ্য দিয়ে কী কী যায়, তা এআই সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে গ্রেপ্যারট।
গত এক বছরে অনেকদূর এগিয়েছে এআই প্রযুক্তি। এর ছবি বিশ্লেষণের সক্ষমতাও বেশ ভালো। তবে ড্রাকম্যান বলেন, আবর্জনা শনাক্ত করার জন্য একটি সিস্টেমকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটি কঠিন ছিল।
“কোকের বোতলের মতো কোনো পণ্য একবার ‘বিন’-এ গেলে তা চূর্ণবিচূর্ণ হবে, এর গায়ে নানা নোংরা জিনিস লাগবে। এই অবস্থায় এই জিনিস এআইকে চেনানো একটি সীমাহীন জটিল বিষয়।”
গ্রেপ্যারটের সিস্টেম সব মিলিয়ে এখন প্রতি বছর তিন হাজার দুইশ কোটি বর্জ্য আইটেম ট্র্যাক করতে পারে। এর পাশাপাশি, বর্জ্যের এক বিশাল ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করেছে কোম্পানিটি। এই তথ্য ব্যবহার করতে পারেন বর্জ্য নিয়ে কাজ করা কর্মীরা।
“কোন জিনিসটির সঙ্গে কী ঘটছে, কোন জিনিসগুলোয় সমস্যা আছে - এমনসব তথ্য এখন এআইকে আরও ভালভাবে বোঝার সুযোগ দিচ্ছে। পাশাপাশি, বিভিন্ন প্যাকেজিং নকশার ওপরও প্রভাব ফেলছে এটি।” --বলেন ড্রাকম্যান৷
“আমরা জলবায়ু পরিবর্তন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আলাদা বিষয় হিসেবেই দেখি। তবে, এদের মধ্যে পারষ্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, আমরা বিভিন্ন রিসোর্স ব্যবহার করি, কিন্তু কারণ সেগুলো পুনর্ব্যবহারের সুযোগ নেই না।”
তিনি আশা করেন বিভিন্ন বড় ব্র্যান্ড ও অন্যান্য উৎপাদক গ্রেপ্যারটের ডেটা ব্যবহার করে পরবর্তীতে আরও এমন পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য বানাবে।
‘ফুটপ্রিন্ট’ নামে এক কোম্পানি চালান যুক্তরাষ্ট্রের ট্রয় সোপ। প্যাকেজিং ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য তিনি এর প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সুপারমার্কেটের পাশাপাশি রেজর ব্র্যান্ড ‘জিলেটে’র সঙ্গে কাজ করেছে কোম্পানিটি। জিলেটের রেজর ট্রে তৈরিতে প্লাস্টিকের বদলে উদ্ভিদভিত্তিক ফাইবার ব্যবহারের চেষ্টা করছেন তিনি।
ফুটপ্রিন্টের ওয়েবসাইটে দেওয়া এক ব্লগপোস্টে সোপ দাবি করেন, ‘রিসাইক্লিংয়ের নামে গ্রাহকদের আসলে কল্পকাহিনি গেলানো হচ্ছে।
এর উদাহরণ হিসেবে তিনি একটি প্লাস্টিকের পাত্র দেখিয়ে বলেন, একে দাবি করা হয়েছে ‘রেডি টু রিসাইকল’ হিসেবে। তিনি জিজ্ঞেস করছেন - বলুন তো, এই কথার মানেটা কী?
“তাদের ফেলে দেওয়া এইসব ‘সিঙ্গল-ইউজ’ প্লাস্টিক ভাগাড় ছাড়া অন্য কোথাও গিয়ে পড়বে, এমন সম্ভাবনা কম।” --লেখেন সোপ।
“এই প্লাস্টিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হল প্রথমে এর ওপর নির্ভরতা বন্ধ করা।”
ড্রাকম্যান বলছেন, তথাকথিত ‘গ্রিনওয়াশিং’ বড় এক সমস্যা।
“আমরা ইকোবান্ধব বা গ্রিন প্যাকেজিং নিয়ে অনেক দাবিই দেখি। তবে এগুলোতে অনেক সময়ই মনগড়া কথা থাকে, যা ভোক্তাদের বিভ্রান্ত করে।”
ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল আসলে কী হারে পুনর্ব্যবহার হচ্ছে, তা খুচরা বিক্রেতাদের জানাতে যুক্তরাজ্যের কোম্পানি ‘পলিট্যাগ’ সেগুলোতে একটি ‘আল্ট্রাভায়োলেন্ট (ইউভি)’ ট্যাগ দেয়, যা খালি চোখে দেখা যায় না।
বোতলগুলো রিসাইকল প্ল্যান্টে পৌঁছানোর পর মেশিন ট্যাগগুলোকে স্ক্যান করে। পরবর্তীতে সেইসব বোতলের নাম্বার রিয়েল টাইমে একটি ক্লাউড ভিত্তিক অ্যাপে আপলোড হয়, যা কোম্পানির গ্রাহকরা দেখতে পান।
“তারা দেখতে পারেন, ঠিক কতগুলো বোতল রিসাইকল হয়েছে। এর আগে কোনও ব্র্যান্ডই এমন সুবিধা আনতে পারেনি।”--বলেন পলিট্যাগের প্রকল্প ব্যবস্থাপক রোজা নক্স-ব্র্যাডলি।
এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি ‘কো-অপ’ ও ‘ওকাডো’র সঙ্গে কাজ করেছে কোম্পানিটি।
আবর্জনা থেকে রেহাই পেতে বিশ্ববান্ধব উপায় খুঁজে বের করা এখনও জটিল। তবে, সচরাচর প্রতি বছর এমন কাজে হাত লাগানো নতুন অনেক ট্রেন্ডই দেখা যায়।
এর সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, ‘ই-সিগারেট’ বা ‘ভেপ’। এগুলো নতুন করে এমন ‘আবর্জনার পাহাড়’ তৈরি করছে, যেগুলো রিসাইকল করা জটিল।
“এটা শুরু থেকেই সমস্যা। আর এখন এটি বিশাল হয়ে উঠছে।” --বলেন যুক্তরাজ্যের বর্জ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অফ ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর নীতি ও প্রযুক্তি প্রধান রে পারমেনটার।
তিনি আরও যোগ করেন, ‘সমস্যার গোড়ায় হচ্ছে ডিসপোজেবল বা সিঙ্গেল-ইউজ ভেপ’। পাশাপাশি, একে ‘চক্রাকার অর্থনীতি জন্য অভিশাপ’ বলেও আখ্যা দেন তিনি।
ডিসপোজেবল বা একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া ভেপে থাকে প্লাস্টিক, ধাতু, লিথিয়াম ব্যাটারি, এলইডি লাইট এমনকি মাইক্রোপ্রসেসর।
গত বছর বৈদ্যুতিক পণ্য পুনর্ব্যবহার বিষয়ক প্রচারণা সংস্থা ‘ম্যাটিরিয়াল ফোকাস’-এর গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল যুক্তরাজ্যেই প্রতি সপ্তাহে ১৩ লাখ ভেপ ফেলে দেওয়া হয়। এর মানে, প্রতি বছর প্রায় ১০ টন লিথিয়াম ভাগাড়ে যায়, যা এক হাজার দুইশ গাড়ির ব্যাটারিতে বিদ্যুৎ দিতে পারত।
“আমরা যে উপায়ে গভীর খনি থেকে লিথিয়ামের মতো স্পর্শকাতর কাঁচামাল সংগ্রহ করছি, সেইসব জায়গায় যাওয়াও এত সহজ নয়। তাই সংগ্রহের পর একে আমাদের সেরা উপায়ে ব্যবহার করা উচিৎ।” --বলেন পারমেনটার।
“আমাদের চিন্তাধারা বদলে ফেলার উদাহরণও হতে পারে এই ভেপ।” --বলেন ড্রাকম্যান।
"অর্থনীতির দিক থেকে এর কোনো মানে হয় না। কোনো মানেই হয় না। রিসাইকলের উপায় খোঁজার বদলে আমাদের বরং জিজ্ঞেস করা উচিৎ, আমরা কেন সিঙ্গেলইউজ ভেপের ব্যবহার শুরু করলাম?”
তিনি আরও যোগ করেন, শিল্প ও নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি ভোক্তাদেরও পণ্য রিসাইক্লিংয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। আর তারা সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন আনতে পারে তা হলো এসবের ব্যবহার ‘কমিয়ে দেওয়া’।