এই সাকিব আল হাসান এক সময় ছিলেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের শুভেচ্ছা দূত।
Published : 24 Sep 2024, 03:47 PM
শেয়ার কারসাজির অভিযোগ ওঠার তিন বছর পর জরিমানার মুখে পড়লেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান।
অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় মঙ্গলবার তাকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিএসইসি জানিয়েছে, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার দরে কারসাজির ঘটনায় সাকিবকে এই জারিমানা গুনতে হবে।
একই ঘটনায় আরেক বিতর্কিত সরকারি কর্মচারী আবুল খায়ের ওরফে হিরুকে ২৫ লাখ টাকা, ইশাল কমিউনিকেশন লিমিটেডকে ৭৫ লাখ টাকা, মোনার্ক মার্ট লিমিটেডকে এক লাখ টাকা, আবুল কালাম মাতবরকে ১০ লাখ টাকা, লাভা ইলেক্ট্রোড ইন্ডাস্ট্রিজকে এক লাখ টাকা এবং জাহেদ কামালকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি।
২০২২ সালে বিএসইসির এক তদন্ত প্রতিবেদনে শেয়ার কারসাজির অভিযোগে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নাম ওঠে, যাকে বাজার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে ২০১৭ সালে শুভেচ্ছা দূত করেছিল বিএসইসি।
বছর দুই আগে ওয়ান ব্যাংক, বিডিকম, সোনালী পেপারস, ফরচুন শুজসহ কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণ খতিয়ে দেখতে উদ্যোগ নিয়েছিল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
প্রাইমারি রেগুলেটর হিসেবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জও (ডিএসই) তদন্ত দল গঠন করে অভিযোগটি খতিয়ে দেখে। দুটি প্রতিবেদনেই সাকিব এবং তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘মোনার্ক হোল্ডিংস’ এর নাম আসে।
সাকিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ব্যক্তিগতভাবে এবং মালিকানায় থাকা কোম্পানির বিও হিসাবের মাধ্যমে শেয়ার দরে কারসাজি করেছেন।
ওই ঘটনায় সাকিবের কাছে ব্যাখ্যাও চেয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সে সময় বিএসইসির মুখপাত্রের দায়িত্বে থাকা রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, কারসাজিতে জড়িত প্রমাণিত হলে কেউ শাস্তি এড়াতে পারে না।
দেশসেরা ক্রিকেটার সাকিব নানা ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার পর নামেন পুঁজিবাজারে, যৌথ অংশীদারত্বে খোলেন ব্রোকারেজ হাউজ মোনার্ক হোল্ডিংস।
কারসাজির অভিযোগ ওঠার পর মোনার্ক হোল্ডিংস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলেও তিনি বলেছিলেন, তিনি খেলা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে মন্তব্য করবেন না।
২০১৭ সালে ‘বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ’ পালনের এক অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা দূত হিসেবে সাকিবের সঙ্গে চুক্তির ঘোষণা দিয়েছিলেন বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন। ওই অনুষ্ঠানে সাকিবও বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনিই এখন কারসাজির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলেন।
জরিমানার সিদ্ধান্তের পর সাকিব আল হাসানের প্রতিক্রিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।
ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারেও কারসাজি
২০২১ সালের শেষের দিকে তালিকাভুক্ত ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারদরের অস্বাভাবিক বাড়ার কারণ দেখতে ডিএসই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল।
ব্যাংকটির শেয়ারদর ২০২৩ সালের ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ৫৯ দশমিক ৫২ শতাংশ বেড়ে ২০ টাকা ১০ পয়সা হয়, যা অস্বাভাবিক মনে হয় বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে।
সে সময় ব্যাংকটির প্রধান ক্রেতাদের তালিকা করে ডিএসইর তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, ১৫ ব্যক্তি ও কোম্পানি ওয়ান ব্যাংকের সর্বোচ্চ সংখ্যক শেয়ার কেনাবেচা করেছেন, যার ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে শেয়ারটির দর বেড়ে গেছে।
এরমধ্যে শুধু সাকিব আল হাসান কেনাবেচা করেছেন ৮৫ লাখ ২১ হাজার শেয়ার, যার মধ্যে ৭৫ লাখের বেশি শেয়ার কেনা হয়েছে।
শেয়ারটি কেনাবেচায় জড়িত ছিলেন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মচারী সমবায় অধিদপ্তরের (বিসিএস ক্যাডার ৩১ ব্যাচ) ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. আবুল খায়ের হিরু, তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, হিরুর বাবা আবুল কালাম মাতবর ও বোন কনিকা আফরোজ।
বলা হয়, এ চক্রের নেতা হিরুর মাধ্যমে ১৩টি বিও হিসাবে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার ‘সিরিজ ট্রেডিং’ করে কৃত্রিমভাবে দর বাড়ানো হয়েছে। শেয়ার কেনাবেচায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় আবুল কালাম মাতবরের বিও হিসাব।
এ দলকে ডিএসইর প্রতিবেদনে ‘আবুল কালাম মাতবর অ্যান্ড হিজ অ্যাসোসিয়েটস’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই সময়ে এক দিনে ওয়ান ব্যাংকের লেনদেন হওয়া শেয়ারের প্রায় ৮৫ শতাংই কিনেছিল ওই চক্র। সরাসরি বাজার থেকে শেয়ার কেনাবেচার পাশাপাশি ‘ব্লক’ মার্কেট থেকেও একইভাবে কেনা হয়।
আবার চক্রটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যেও শেয়ার কেনাবেচা করেছেন বলে ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এভাবে শেয়ারদর বাড়িয়ে চক্রটি ১৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বেশি ‘ক্যাপিটাল গেইন’ অর্থাৎ মুনাফা করেছে শুধু ১৫ দিনেই। দর বাড়ার কারণে তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে আরও ১৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা মুনাফা করার সুযোগ রয়েছে।
এ কারসাজিকে ‘সিরিজ ট্রেড’ হিসেবে বর্ণনা করে বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের লেনদেন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর ১৭ অনুচ্ছেদ এর লঙ্ঘন।
ওই অনুচ্ছেদে বলা আছে, সরাসরি বা পরোক্ষাভাবে কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো শেয়ার এমনভাবে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না, যাতে তার দর বৃদ্ধি বা সুবিধা কেউ নিতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “এটি প্রমাণ হয়েছে যে আবুল কালাম মাতবর অ্যান্ড হিজ অ্যাসোসিয়েটেস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুইভাবেই ১৩টি বিও হিসাব ব্যবহার করে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার সিরিজ ট্রেডিং ও দর বৃদ্ধি করেছে।”
বিধি লঙ্ঘনের জন্য ‘আবুল কালাম মাতবর অ্যান্ড হিজ এসোসিয়েটস’কে গত ২০২২ সালের অগাস্ট মাসে ৩ কোটি টাকা জরিমানা করে বিএসইসি।