এখন কত আয়োজন, উন্মাদনা বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে। নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার বহর, কাঁচের প্রাচীরে ঘেরা ট্রফিটি বিশ্বজয়ী না হলে ছুঁতেও মানা। সোনায় মোড়ানো ট্রফিটির মূল্য ছুঁয়েছে ২০ লাখ ডলার। এমনকি বিশ্ব ভ্রমণের সময় রেপ্লিকা ট্রফিও পায় রাজকীয় মর্যাদা! অথচ ১৯৩০ সালে জুলে রিমের হাত ব্যাগে ‘লুকিয়ে’ মন্তেভিদিওর পথে রওনা দেওয়া সেই ট্রফি ঘিরে এসবের কিছুই ছিল না; বরং উন্মাদনার চেয়ে আশঙ্কা, শিহরণের চেয়ে অনিশ্চয়তা, দোটানা ছিল ঢের বেশি।
প্রায় একশ বছর আগে ট্রফিটির যাত্রা শুরুর ক্ষণটি কল্পনা করা কঠিন কিছু নয়:
কোনো এক শীতের রাতে ফ্রান্স থেকে সাত সমুদ্র-তের নদী পেরুতে উরুগুয়ের উদ্দেশে জাহাজে চেপেছেন জুলে রিমে। ভদ্রলোক পেশায় একজন আইনজীবী। সাথে অল্প কিছু সঙ্গী-সাথী, স্বপ্নবাজ, ফুটবলপাগল। হাত ব্যাগে সংগোপনে রাখা একটা ট্রফি। শিহরণ-দুর্ভাবনার হাজারো বাঁক পেরিয়ে সেটি নিয়ে মন্তেভিদিওর বন্দরে নোঙর ফেললেন কাক ডাকা ভোরে। ফুটবল বিশ্বকাপের ক্যানভাসেও প্রথম পড়ল সত্যিকারের তুলির আচঁড়টি।
এক-দুই করে ২২তম বিশ্বকাপ দোরগোড়ায়। দিন পেরুলেই বৈশ্বিক ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর গড়াবে কাতারের রাজধানী দোহায়। লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ, দক্ষিণ আফ্রিকার নানা অলি-গলি, মেঠোপথ-রাজপথ ঘুরে, ফুটবলের রোমাঞ্চের রেণু ছড়িয়ে অবশেষে তার প্রথমবারের মতো মরুদ্যানে আসা। এবং যথারীতি কিছুটা বিতর্ক সঙ্গী করে!
বৈশ্বিক ফুটবলে কাতার ‘চুনোপুটি’ বৈকি। বিশ্বকাপে কখনও তারা কোয়ালিফাই করতে পারেনি, এবার আয়োজক হয়ে সরাসরি খেলছে। এশিয়ার ফুটবলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির সেরা সাফল্য ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের স্বাদ আস্বাদন করা।
এছাড়া ২০২১ সালের আরব কাপে তৃতীয়, গত বছরই দাওয়াত পেয়ে খেলতে গিয়ে কনকাকাফ গোল্ডকাপে তৃতীয় এবং গলফ কাপে তিনবার (১৯৯২, ২০০৪ ও ২০১৪) চ্যাম্পিয়ন হওয়া-এতটুকুই বলার মতো গল্প। এর বাইরের গল্প তেল বিক্রির পেট্রো-ডলারের ঝনঝনানি।
বাংলা ভাষায় বহু চর্চিত কারক-বিভক্তির উদাহরণ ‘টাকায় কিনা হয়’। টাকা নামের এই মৌলিকের সঙ্গে রুচি আর আকাঙ্খার যৌগ মিললে তো কথাই নেই। তাই এক শহরে আটটি ঢাউস স্টেডিয়াম দেশটির নানা ঐতিহ্যের রঙ-রূপ গায়ে জড়িয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায় যেন চোখের পলকে। অবকাঠামো নিয়ে একবিন্দু দুঃশ্চিন্তা না থাকায় পটে যায় বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থা ফিফা। গরম আবহাওয়া নিয়ে শীতপ্রধান ইউরোপের চোটপাট, সিটকানো নাক ঠাণ্ডা করে দেওয়া হয় পুরো স্টেডিয়াম এয়ার-কন্ডিশনার দিয়ে মুড়িয়ে। আরও কত কী, ইয়ত্তা নেই!
এই উপেক্ষা, নাক সিটকানোর গল্পও অবশ্য বেশ পুরনো। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপের প্রথম আসরে উরুগুয়েতে খেলতে যায়নি ইউরোপের অধিকাংশ দল। নিজেদের সংবিধানের শতবর্ষী উদযাপনে খরচে কার্পণ্য ছিল না দেশটির, কিন্তু মন গলেনি ইউরোপের দলগুলোর। সমুদ্রযাত্রার বিড়ম্বনার প্রসঙ্গ ছিল ছুঁতো, আসলে কালো, মুলাটোদের জনপদে পা রাখতে প্রবল আপত্তি ছিল তাদের; অনেক গাই-গুঁই করে ইউরোপ আটলান্টিক পাড়ি দিতে ‘কন্তে ভারদে’ নামের জাহাজে চেপে বসেছিল কেবল ফ্রান্স, রোমানিয়া, বেলজিয়াম ও যুগোস্লাভিয়া। আর এবার কাতারে নোঙর ফেলবে ইউরোপেরই ১৩টি দল।
পাল্টা জবাবে ১৯৩৪ সাল দ্বিতীয় বিশ্বকাপে ইতালির মাটি মাড়ায়নি উরুগুয়ে। যদিও সেসময় উরুগুয়ের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিল না, কিন্তু উপেক্ষার উত্তর দিতে ইতালিতে যায়নি তারা-এটাই সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত সত্য।
এই আধুনিক যুগেও বিশ্বকাপে ঘটে যাওয়া এমন অনেক নির্মম সত্য শতচেষ্টাতেও আড়াল করা যায়নি। ২০১০ বিশ্বকাপ হয়েছিল ‘রংধনু’র দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায়। বঞ্চিত, নিপীড়িত এবং আজন্ম পিছিয়ে থাকা কালোর জন্য লড়াই করে জয়ী হওয়া নেলসন ম্যান্ডেলার দেশে বিশ্বকাপ, যে দেশটির উর্বরা ভূমি সাদা-কালোর দ্বন্দ্বে পুড়ে ছারখার হয়েছে বছরের পর বছর, দশকের পর দশক, সেই ‘মাদিবা’র দেশে বিশ্বকাপ, চারদিকে ভিন্ন আমেজ, উৎসবের সাজসাজ রব।
অথচ এমন কাণ্ডও হয়েছে, দলগুলোকে বহনকারী বাসগুলো যখন আসত, রাস্তা থেকে সরিয়ে দুরে ঠেলে দেওয়া হতো কোমলমতি কালো শিশুদের! যেন নিজেদের দারিদ্রতা প্রকাশ না পায়-এমন ভুতূড়ে, হাস্যকর যুক্তিতে! তবে সেসব কলুসতার মাঝেও ফুটবল ছিল সদর্পে দাঁড়িয়ে। ওই আসরেই দুনিয়া মাতানো কলম্বিয়ান শিল্পী শাকিরার ‘ওয়াকা ওয়াকা’ গানের ছন্দে-তালে মেতেছিল বিশ্ব।
মুসোলিনির নিজেকে জাহির করার মরিয়া চেষ্টা, অস্ট্রিয়াকে ঘাড় ধরে জার্মানির হয়ে খেলতে বাধ্য করতে হিটলারের উঠে পড়ে লাগার মতো আরও অনেক ছোপ ছোপ কালো দাগ লেগে আছে বিশ্বকাপের গায়ে। সবশেষ রাশিয়ার বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়েও ছিল প্রশ্ন। এবারের কাতারের আয়োজক হওয়া নিয়েও কী কম লঙ্কাকাণ্ড!
আয়োজক স্বত্ব পাওয়া নিয়ে ‘রাজনৈতিক তদবির’, ‘অনৈতিক আর্থিক লেনদেন’, অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য দেশটির কঠোর আইন, সমকামীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব, মানবাধিকারের লংঘন- এমন হাজারো অভিযোগ প্রায়ই খবর আসছে গণমাধ্যমে।
কদিন আগে খোদ ফিফার সাবেক সভাপতি জেপ ব্লাটারও বলেছেন, কাতার বিশ্বকাপ ভুল ছিল! অথচ তার আমলেই কাতারের আয়োজক স্বত্ব পাওয়া।
এর আগে খবর এসেছে, বিশ্বকাপ সামনে রেখে দোহায় চলছে উচ্ছেদ অভিযান। কাতারের ট্যাক্সি চালক আলিও জানালেন, কাজ শেষ করেই তাদের ফিরে যেতে হচ্ছে আলো ঝলমলে দোহা শহরের ‘গ্রামের’ দিকে। ‘বিনা নোটিশে’ ঘরছাড়া করা হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকদের, বিশেষ করে যারা আফ্রিকা ও এশিয়ার। যাদের শ্রমে-ঘামে এবং প্রাণের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে বিশ্বকাপের ইমারত! এখন এই তারাই দোহায় অনাহূত, অচ্ছ্যুৎ, প্রয়োজনহীন।
কেউ কেউ নাকি ঘর ছাড়া হয়েছেন এক কাপড়ে, সহায়-সম্বলহীনভাবে। কাতারে আসা ফুটবলার, ফুটবলপ্রেমীদের ছাদের ছায়ায় রাখতে যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন দিনের পর দিন, তাদের অনেকে উচ্ছেদের রাত কাটিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে!
জাহাজে ওঠার সময় জুলে রিমে কি ভেবেছিলেন তার স্বপ্নের বিশ্বকাপের গায়ে পড়বে এসবের আঁচড়? ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি ফিফা প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর ৮৩ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বিশ্বকাপের এই স্বপ্নদ্রষ্টা। দাদুর স্বপ্ন কতটুকু সফল হয়েছে, তা নিয়ে বলতে গিয়ে ২০০৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে নাতি ইভেস রিমের কণ্ঠে ঝরেছিল আক্ষেপ, “ফুটবলে এখন যেমন অর্থের আধিপত্য, এটা দেখলে তিনি হতাশ হতেন। এটা (ফুটবল এমন হবে) তার চাওয়া ছিল না।”
কিছু ভুল ছিল জুলে রিমের এবং জীবদ্দশায় তাকে তা চুকাতেও হয়েছে। ১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির সামনে নতজানু ছিলেন ফ্রান্সের এই ঝানু আইনজীবি। ওই কারণে ১৯৫৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও বিচারকরা তাকে খারিজ করে দেন বলে মনে করেন অনেক।
জুলে রিমে কেবল মনেই করতেন না বরং বিশ্বাস করতেন, ফুটবলই পারে বিশ্বকে একসুঁতোয় গেঁথে রাখতে, শান্তির পতাকাতলে আনতে। সেই বার্তা দিয়ে মাঠে গড়াবে কাতার বিশ্বকাপ। কিন্তু বিশ্বকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি, জুলে রিমের সে বিশ্বাস তারা কতটুকু রাখতে পারল, হয়ত ইশান কোণে বসে তা দেখবেন তিনিও। হয়ত নোট ঠুকবেন, আইনজীবির জেরা করার দৃষ্টি দিয়ে!