মারাদোনার চেয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন মেসি?

লুসাইলের আঙিনায় জয়ের ফুল ফোটাতে পারলে আরও একটি পাতায় কিংবদন্তি মারাদোনাকে পেছনে ফেলবেন লিওনেল মেসি।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরদোহা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2022, 05:51 AM
Updated : 17 Dec 2022, 05:51 AM

ইতিহাস সবসময় বিজয়ী বীরদের মনে রাখে। পরাজিতের জন্য রক্তক্ষরণ হয় বটে, কিন্তু তাদের কোথাও ঠাঁই মেলে না। লিওনেল মেসি আবারও সেই কঠিন পরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে। জয়ীর বেশে লুসাইল স্টেডিয়ামের আঙিনা ছাড়লেই কেবল আর্জেন্টিনার ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাবেন না, আরেকটি পাতায় কিংবদন্তি দিয়েগো মারাদোনাকেও ছাপিয়ে যাবেন ফুটবলের এই মহাজাদুকর।

ভিন্ন সময়ের দুই শিল্পী দুজন। মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন নিজেদের সুরে, ছন্দে। তর্কে-বিতর্কের টেবিলে অবশ্য মারাদোনার প্রবল উপস্থিতি, সেখানে মেসি প্রায় নেই বললেই চলে। এবারের বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডস ম্যাচে প্রতিপক্ষ দলের কোচ লুইস ফন খাল ও খেলোয়াড় ভঠ ভেহর্স্টের সঙ্গে একটু রূঢ় আচরণ, ‘বোকা’ বলাটুকু তাই মেসিকে ‘স্বর্গ থেকে মর্তে’ নামিয়ে নিয়ে আসে!

অথচ মারাদোনাকে নিয়ে বিতর্কের ইয়ত্তা নেই; তবু তিনি সাধারণের অনুভবে, ইতিহাসের বুকে চির অমলিন রয়ে যান। মেসি তা যেন হয়ে উঠতে পারেন না, মলিন থেকে যান। বিশ্বকাপ জয়ই যেন মলিনতা কাটার একমাত্র পথ তার সামনে! অথচ পরিসংখ্যান, রেকর্ডের কত পাতাতেই না মারাদোনাকে পেছনে ফেলেছেন মেসি!

১৯৭৭ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার হয়ে ৯১ ম্যাচ খেলে ৩৪ গোল করেন মারাদোনা। সেই কবে এই দুই পাতায় তাকে ছাপিয়ে গেছেন মেসি। আকাশি নীল-সাদা জার্সিতে ৩৫ বছর বয়সী এই মহাতারকার খেলা হয়ে গেছে ১৭১টি ম্যাচ, বলার অপেক্ষা রাখে না গোলের পাতায় তিনি শীর্ষে। জাতীয় দলের হয়ে মারাদোনার চেয়ে মেসির বর্তমান গোল সংখ্যা প্রায় তিনগুণ- ৯৬টি।

মরুভূমির বিশ্বকাপেও গোলের ফুল ফুটিয়ে চলেছেন মেসি। একের পর এক আঁচড় কাঁটছেন রেকর্ড বইয়ের পাতায় পাতায়। এরই মধ্যে গোল করেছেন ৫টি। অ্যাসিস্ট তিনটি। আর্জেন্টাইনদের বিশ্বকাপের পথচলার পরিসংখ্যানে এই দুই পাতার একটিতে মারাদোনাকে ছাপিয়ে গেছেন, আরেকটি স্পর্শ করেছেন। বিশ্বকাপে মারাদোনার গোল ৮টি, মেসির ১১টি। গাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে (১০টি) ছাপিয়ে তিনিই এখন সিংহাসনে।

খেলাধুলার পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা অপটা ১৯৬৬ বিশ্বকাপ থেকে রেকর্ড রাখার পর থেকে বিশ্ব মঞ্চে সবচেয়ে বেশি ৮ গোলে সহায়তার রেকর্ড এতদিন ছিল মারাদোনার একার। আর্জেন্টিনার ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ককে মেসি ছুঁয়ে ফেলেন ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেমি-ফাইনালে হুলিয়ান আলভারেসকে দিয়ে গোল করিয়ে।

আর্জেন্টিনার হয়ে মারাদোনার মতো মেসিরও দুটি শিরোপা। সংখ্যায় যদিও এক, ধারে-ভারে-উজ্জ্বলতার হিসেবে ভিন্ন। এখানেও কোথাও এগিয়ে মারাদোনা, কোথাও মেসি! দুজনেই জিতেছেন আর্তেমিও ফ্রান্সি কাপ; ১৯৯৩ সালে এই ট্রফি জিতেছিলেন ‘এল দিয়েগো’, ২০২২ সালে একই শিরোপা জিতেছেন মেসি বদলে যাওয়া ‘ফিনালিস্সিমা’ নামে।

কোপা আমেরিকার পাতায় এগিয়ে মেসি। সেই ১৯৯৩ সাল থেকে লাতিন ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের আঙিনায় চলা আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের হাহাকার তিনি ঘুঁচিয়েছেন গত বছর। মারাদোনার কখনও এই আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরা হয়নি।

মারাদোনা পরেছিলেন বিশ্বসেরার মুকুট। চারটি বিশ্বকাপে খেলা এই কিংবদন্তি ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো আসরে ফুটবল বিশ্বকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন পায়ের জাদুতে, বাঁ-হাতের চাতুরিতে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে পিটার শিলটনকে ফাঁকি দিয়ে হাত দিয়ে গোল করে জন্ম দিয়েছিলেন ‘হ্যান্ড অব গড’ বিতর্কের।

ওই ম্যাচে প্রতিপক্ষের পাঁচ ইংলিশ খেলোয়াড়কে কাটিয়ে লক্ষ্যভেদ করে লিখেছিলেন ‘গোল অব দা সেঞ্চুরির’ গল্প গাঁথা। একক প্রচেষ্টায় শিরোপা উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে চিরদিনের জন্য আর্জেন্টাইনদের নয়নমণি হয়ে যান। দুই বছর আগে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানো মারাদোনা তাই আজও আলবিসেলেস্তেদের অনুভবে, স্মৃতিতে, গল্পে উপস্থিত প্রবলভাবে। 

এই কাতার বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনার ম্যাচ হলে গ্যালারিতে, মাঠের বাইরে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের হাতে, বুকে জড়িয়ে থাকে মারাদোনার ছবি। সেখানে অবশ্য মেসির ছবিও থাকছে ইদানিং। কোপা আমেরিকার জয়ের পর দলটির সমর্থকরা ‘মেসি আর্জেন্টিনার নয়’, এই সমালোচনা বদলে এখন বলতে শুরু করেছেন, “আমাদের মারাদোনা ও মেসি আছে।”

কিন্তু মেসির যে বিশ্বকাপ নেই। ক্লাব ফুটবলে জেতা ৪১টি ট্রফিও এই শূন্যতা পূরণে যথেষ্ঠ নয়। এই শূন্যতা এবার তার ঘোচানোর শেষ সুযোগ। সেমি-ফাইনালের বৈতরণী পার হওয়ার পর তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, কাতার আসরই বিশ্ব মঞ্চে তার শেষ।

লুসাইলের আঙিনায় রোববার তাই বিশ্বকাপে শেষ বারের মতো আর্জেন্টিনার জার্সিতে, অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড বাহুতে জড়িয়ে নামবেন মেসি। বাঁ পায়ের জাদু ছড়িয়ে বিজয়ীর হাসি হাসতে পারলে শিরোপা সংখ্যায় মারাদোনাকে ছাপিয়ে যাবেন। হয়তো মারাদোনার মতোই আর্জেন্টাইনদের ভালোবাসাও পাবেন! যে ভালোবাসাটুকু সবসময় মনেপ্রাণে চেয়েছেন তিনি।

এই চাওয়া শুধু মেসির নয়, তার মায়েরও। একবার এক সাক্ষাৎকারে ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজের চাওয়া জানাতে সেলিয়া কুচিত্তিনি বলেছিলেন অনেক কথা। তার মধ্যে ‘ছেলের সুখ এবং ভালোবাসা’ পাওয়ার আশাবাদ ছিল সবচেয়ে বেশি।

“ফুটবলের দিক থেকে, আমি আশা করি, সে পেলের মতো, মারাদোনার মতো ইতিহাস গড়ুক। আশা করব, সে অনেক-অনেক দূর যাবে। কিন্তু সর্বোপরি একজন মা হিসেবে আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে চাই-আমার ছেলেটা যেন সুখী হয়।”

“তার একটা পরিবার হবে, তার জীবনটা জীবনের মতো হবে। কেননা, এখনও সে যেভাবে দিনযাপন করে, সেটা জীবন নয়। এখনও সে ফুটবলের প্রতি নিবেদিত, শারীরিক এবং মানসিকভাবে। সে বাইরে যায় না, তার মতো তরুণ বয়সে ছেলেরা অনেক কিছু করে, যার কোনোটাই সে করে না। এ কারণে আমার আশা তার জীবনটা চমৎকার হোক, যেটা তার প্রাপ্য।”

মেসির আসলে সমালোচনা ছাড়া বিশ্বকাপ, ভালোবাসা সবই প্রাপ্য। মারাদোনাকে ছাপিয়ে গেলেও, না যেতে পারলেও।