এমন দুঃসময়ের কবলে যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এবারই প্রথম পড়া, তা নয়, কিন্তু সে অতীতও অনেক পুরান।
Published : 24 Dec 2023, 04:02 PM
জয়োৎসবের রেশ থাকতে থাকতেই পা ফসকানো, লড়াকু পারফরম্যান্সে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেওয়ার পরের ম্যাচেই বিধ্বস্ত হওয়ার গল্প- মৌসুমের শুরু থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পারফরম্যান্স ঠিক এমনই অধারাবাহিক আর ব্যর্থতায় ভরা। সবশেষ ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেডের বিপক্ষে হারের মধ্য দিয়ে তাদের হতাশাময় এই পথচলার প্রথম অর্ধ পূর্ণ হয়েছে।
ক্রিসমাসের আগে, মৌসুমের এই পর্যন্ত সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে দলটি হেরেছে ১৩টি ম্যাচ; ১৯৩০ সালের পর থেকে কোনো মৌসুমে এতটা বাজে শুরু আর করেনি ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী দলটি।
প্রিমিয়ার লিগে শনিবার ওয়েস্ট হ্যামের মাঠে ২-০ গোলে হেরেছে প্রতিযোগিতাটির রেকর্ড চাম্পিয়নরা। গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর ছয় মিনিটের ব্যবধানে গোল দুটি হজম করে তারা; জ্যারড বোয়েন ওয়েস্ট হ্যামকে এগিয়ে নেওয়ার পর ব্যবধান দ্বিগুণ করেন মোহাম্মেদ কুদুস।
প্রিমিয়ার লিগে এই নিয়ে টানা তিন এবং সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে চার ম্যাচে জয়শূন্য রইল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড; এই চার ম্যাচের তিনটিতেই তাদের সঙ্গী পরাজয়। এমনকি এই চার ম্যাচে কোনো গোলও করতে পারেনি এরিক টেন হাগের দল।
ম্যাচ শেষে কোচ টেন হাগ কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই বলে দিলেন, তার দল ভালো খেলতে পারছে না। আর সাবেক মিডফিল্ডার পল স্কোলসের মতে, এমন পারফরম্যান্স আর ফল তার সাবেক ক্লাবের জন্য ‘বড় সমস্যা’।
সাবেক ইংল্যান্ড স্ট্রাইকার অ্যালান শিয়েরার বিবিসির ‘ম্যাচ অব দা ডে’-তে বলেছেন, “(টানা এই ব্যর্থতা) ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য বিব্রতকর। এই মৌসুমে তারা গোল করেছে ১৮টি, তাদের চেয়ে কেবল শেফিল্ড কম গোল করেছে। আমাদের পরিকল্পনার সাথে সেঁটে থাকতে হবে’, কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা আসলে কী, এমন কোনো আভাস ছেলেদের খেলায় আমি পাইনি। খুব খারাপ কিছু হয়ে চলেছে।”
দেখা মিলছে না গোল, জিততে পারছে না ম্যাচ, চোটাক্রান্ত খেলোয়াড়দের তালিকা দিনে দিনে লম্বা হচ্ছে-এসব তো ইউনাইটেডের মাঠের ভঙ্গুর, হতশ্রী দশাকে আরও যাচ্ছেতাই করে তুলছে। সঙ্গে মাঠের বাইরের সমস্যাও কম দুর্ভাবনার নয়। ক্লাবটির মালিকানা নিয়ে জটিলতা চলছে তো অনেক দিন ধরেই।
সব মিলিয়ে প্রিমিয়ার লিগের রেকর্ড চ্যাম্পিয়নদের অবস্থা সত্যিই আজ বড় দুশ্চিন্তার।
পরিসংখ্যানের আলোয় ইউনাইটেডের বিবর্ণতা
সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ২৬ ম্যাচ খেলে ১৩টিতেই হেরেছে দলটি। যেখানে গত মৌসুমে ৬২টি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলে তারা মোট হেরেছিল ১৩টি।
সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২০২৩ সালে ইউনাইটেড হারের সংখ্যা হলো ২০টি; এক বছরের হিসেবে যা ১৯৮৯ সালের পর সবচেয়ে বেশি, সেই বছরও ২০টি হেরেছিল তারা।
১৯৩০ সালের পর কোনো মৌসুমে ক্রিসমাসের আগে এত বেশি ম্যাচ হারেনি ইউনাইটেড। সেবার লিগ টেবিলের তলানিতে থেকে মৌসুম শেষ করেছিল দলটি।
এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগে ১৮ ম্যাচে মোটে ১৮টি গোল করতে পেরেছে ইউনাইটেড, তার মধ্যে সাত ম্যাচে পায়নি জালের দেখা।
এর আগে শীর্ষ লিগে প্রথম ১৮ ম্যাচে এবারের চেয়ে কম গোল তারা করেছিল কেবল তিনবার; ১৯৭৩-৭৪ (১৫টি), ১৯৭২-৭৩ (১৬টি), ১৮৯৩-৯৪ (১৫টি)।
১৯৯২ সালের নভেম্বরের পর এই প্রথম সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে টানা চার ম্যাচে গোল করতে ব্যর্থ হলো ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের দলটি। তিন দশক আগের সেই সময়ে দলটির কোচ ছিলেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন।
এবারের লিগে এখন পর্যন্ত আটটি ম্যাচে হেরেছে ইউনাইটেড। সবশেষ হারের পর তারা নেমে গেছে আট নম্বরে, ১৮ ম্যাচে ২৮ পয়েন্ট নিয়ে; শীর্ষে থাকা আর্সেনালের চেয়ে ১২ পয়েন্ট কম। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সবশেষ সাত ম্যাচে মাত্র একটিতে জিততে পেরেছে তারা।
এ তো গেল হার বা জয়ের হিসাব। মাঠের পারফরম্যান্সের বিচারেও ইউনাইটেডের অবস্থা ভীষণ নাজুক।
গত মৌসুমে টেন হাগের কোচিংয়ে লিগ কাপ জিতেছিল ইউনাইটেড। তৃতীয় স্থানে থেকে শেষ করেছিল প্রিমিয়ার লিগ। এফএ কাপেও ফাইনালেও উঠেছিল তারা।
এতে ডাচ এই কোচের হাত ধরে সাফল্যের পথে ফেরার আশা জাগে ইউনাইটেড শিবিরে। যদিও সেই আশা বেশ আগেই ফিকে হয়ে গেছে। চলতি মৌসুমের শুরু থেকেই যে ধুকছে তারা। তাতে টেন হাগের ওপর বাড়ছে চাপও।
গত সপ্তাহে লিভারপুলের মাঠে গিয়েও পয়েন্ট হারায় ইউনাইটেড। তবে সেই ম্যাচে লড়াকু ফুটবলের ছাপ রাখতে পেরেছিল তারা, প্রতিপক্ষের প্রবল চাপ সামলে ছিনিয়ে নিয়েছিল একটি পয়েন্ট। তাতে সমালোচনার প্রবল চাপ কিছুটা হলেও কমেছিল; কিন্তু সপ্তাহ না ঘুরতেই তা নতুন বেগ পেল।
এটা ঠিক যে, দলটির ওপর বড় ছোবল হেনেছে চোট। ভিন্ন ভিন্ন চোটে কাসেমিরো, হ্যারি ম্যাগুইয়ার, লিসান্দ্রো মার্তিনেস, ক্রিস্তিয়ান এরিকসেনসহ আরও বেশ কয়েক জন খেলোয়াড় এই মুহূর্তে মাঠের বাইরে আছেন। কোচ অবশ্য চোটকে কারণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করলেন।
“২০২৩ সালে আমরা লিগ কাপ জিতেছি, এফএ কাপের ফাইনাল খেলেছি, লিগে আমরা তৃতীয় ছিলাম। ভালো অনেক কিছু ছিল...কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের পারফরম্যান্স ভালো নয়। এর কারণ আছে, আমাদের অনেক খেলোয়াড় ইনজুরিতে আছে, তারা ফিরলে দল ভালো করবে। আমাদের শান্ত থাকতে হবে, ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, পরিকল্পনায় লেগে থাকতে হবে।”
তবে, টেন হাগ যাই বলুন না কেন, চোটের তালিকা যত লম্বাই হোক না কেন; এতটা সাদামাটা, বাজে পারফরম্যান্স- ইউনাইটেডের মতো দলের থেকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
দলটির ডিফেন্ডার লুক শ’ কোনোরকম রাখঢাক ছাড়াই আত্মসমালোচনা করলেন। বললেন, তার দলের পারফরম্যান্স ‘যথেষ্ট ভালো’ নয়।
“আমরা ম্যাচ হেরে চলেছি, পয়েন্ট হারাচ্ছি এবং নিজেদের জন্য সবকিছুকে কঠিন করে তুলছি। বিশেষ করে যেমন (লিভারপুলের বিপক্ষে) দ্বিতীয়ার্ধে আমরা ভালো খেলিনি।”
“আসলে কী, এটা চিন্তা করাটাও কঠিন। আমার মনে হয়, আমরা যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করতে পারছি না আর অন্যপাশে আমরা ক্লিনিক্যাল হতে পারছি না।”