পল থমাস স্মলির না থাকা নিয়ে ভাবছে না এলিট একাডেমিতে বেড়ে ওঠা আগামী দিনের ফুটবলাররা।
Published : 04 Aug 2023, 09:39 AM
ছোট ছোট গোলপোস্ট বসিয়ে, মাঠ ছোট করে তখন নিজেদের মধ্যে ম্যাচ শুরুর অপেক্ষা। কোচ পাপ্পু ও আবুল হাঁক ছাড়লেন, “আমার দুজন গোলরক্ষক লাগবে।” চার জনকে নিয়ে অনুশীলনে ব্যস্ত থাকা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু দুজনকে ছেড়ে দিলেন। শুরু হলো প্রস্তুতি। কোচেরা চিৎকার করতে লাগলেন, “নিজেদের মধ্যে কথা বলছো না কেন? কথা বলো, কথা বলো…।” প্রস্তুতির শুরুর অগোছালো ভাব কেটে গেল চন্দন-ইমরান-মিরাজরা নিজেদের মধ্যে কথা বলা আর হই-হুল্লোড় শুরু করতেই।
বাফুফের এলিট একাডেমিতে এই দৃশ্য প্রতিদিনের। আগের সঙ্গে ব্যতিক্রম কেবল পল থমাস স্মলির না থাকা। বাফুফের টেকনিক্যাল ও স্ট্র্যাটেজিক ডিরেক্টরের চাকরি ছেড়ে গত মাসে মালদ্বীপে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। স্মলির অনুপস্থিতিতে তার মস্তিষ্কপ্রসূত এলিট একাডেমির হালচাল জানার চেষ্টা করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। দ্বিতীয় পর্বে থাকছে খেলোয়াড়দের ভাবনা।
এই উঠতিদের কেউ এসেছে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) কিংবা অন্য কোনো একাডেমি থেকে। কেউবা একেবারেই তৃণমূল থেকে। আলাপচারিতায় তারা খুলে দিল মনের আগল। সেখানে ফুটে উঠল তাদের অতীত আর বর্তমান সময়ের প্রস্তুতির ফারাক, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একাডেমির সুযোগ সুবিধার নানা দিক, যেগুলো এই উঠতিদের চোখে এঁকে দিচ্ছে বড় স্বপ্ন।
স্মলির অনুপস্থিতিও খুব একটা ভাবাচ্ছে না এই তরুণদের। বরং বর্তমানে কাজ করা ছয় কোচে আস্থা রাখছে তারা। একাডেমির শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন, দিনভর কঠোর অনুশীলন, কোনো কিছুই কঠিন মনে হচ্ছে না তাদের।
স্মলির চলে যাওয়াতে একাডেমির ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা গুঞ্জন আছে। তবে ফুটবলারদের সেই দুর্ভাবনা স্পর্শ করেনি। তরুণ অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার আব্দুল্লাহ জুনায়েদ চিশতি যেমন জানালেন, দেশি কোচদের দুয়ার তাদের জন্য সবসময় খোলা।
“(স্মলি নেই) কোচদের নিয়ে আমাদের কোনো বিষয় নেই, যে আমাদের নেতৃত্ব দেবেন, আমরা তার কথাই মেনে চলব। কোচ দেশি বা বিদেশি হোক, উনি যা বলবেন, যেভাবে বলবেন, তা-ই করব। সবারই ইচ্ছা নিজের উন্নতির মাধ্যমে দেশের উন্নতি, আমারও তাই। এখানে আমাদের নিয়ে আসা হয়েছে, আমাদের উন্নতির মাধ্যমে দেশের ফুটবলের উন্নতি করার জন্য।”
“এর আগে আরামবাগের একাডেমিতে ছিলাম। ওখানকার পরিবেশ আর এখানকার পরিবেশ একেবারে আলাদা। সেখানে আমাকে গাইড করার মতো কেউ ছিল না। প্রস্তুতিতে যেতাম, এরপর মনখুশি চলতাম। বিশৃঙ্খল জীবন ছিল। এখানে সবকিছু নিয়মমাফিক, দিনে এক-দেড় ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারব না, সবকিছু স্যাররা বলে দেন। এখানে টাইমিংয়ের বাইরে কিছুই করতে পারব না।”
ময়মনসিংহ থেকে উঠে আসা জুনায়েদের বাবা রিপ্রেজেন্টেটিভ, মা গৃহিনী, বড় বোন এসএসসি দিয়েছে, বড় ভাই আলুর ব্যবসা করেন, ছোট ভাই পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। বাবা ছিলেন ফুটবলার, স্থানীয় নামকরা ক্লাব আল হেলালের অধিনায়ক। ১৬ বছর বয়সী এই তরুণ হতে চান কেভিন ডে ব্রুইনের মতো কার্যকর ফুটবলার। দেশে তার প্রিয় রবিউল ইসলাম।
শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের পথ ধরে জুনায়েদও একদিন হয়ে উঠতে চান প্রিয় তারকাদের মতোই বড় ফুটবলার।
“এখানে অনেক শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন। সবকিছুতে টাইমিং মেনটেইন করতে হয়। ছয়টায় প্রস্তুতি থাকলে পাঁচটায় উঠতে হয়। কলা-বিস্কুট খেয়ে রেডি হয়ে থাকি। স্যাররা মাঠ সাজানোর পর ডাক দিলে মাঠে নেমে পড়ি। ওয়ার্মআপের পর ৯০ মিনিট ট্রেনিং। এরপর নাস্তা সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে জিমে যাই, ফিরে গোসল সেরে আসার পর ডাইনিংয়ে যাই। দুপুরের স্ন্যাকস খেয়ে হালকা ন্যাপ নিয়ে বিকালে যোগ ব্যায়ামের জন্য যাই। কোচেরা আমাদের সঙ্গে বসেন। আমরা কেমন করেছি, কী ভুল করেছি, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেন, যেখানে ভুল করেছি, সেখানে কী করলে ঠিক করা যায়, সেগুলো বুঝিয়ে দেন।”
“আমাদেরকেও প্রশ্ন করা হয়, ‘এখানে কী করলে ঠিক হতো?’ আমাদের উত্তর ঠিক হলে স্যাররা বলেন, ‘ঠিক আছে। এভাবে করতে পারো।’ ভুল হলে বলে দেন, এভাবে নয়, ওভাবে করতে হবে। কারো ব্যক্তিগত সমস্যা থাকলেও আমরা কোচদেরকে বলি, তারা দিক-নির্দেশনা দেন। এরপর সন্ধ্যায় নাস্তা থাকে, রাতের খাবার খেয়ে ১০টার মধ্যে ঘুমাতে যায়। পরের দিন আবারও একই রুটিনে শুরু হয় সবকিছু।”
ফরিদপুরের ছেলে মোহাম্মদ কামাল বাবা-মায়ের চোখ রাঙানি এড়িয়ে, স্কুল ফাঁকি দিয়ে ফুটবল খেলে ভর্তি হয়েছিলেন বিকেএসপিতে। বর্তমানে তার ঠিকানা এলিট একাডেমি। এখানকার সুযোগ সুবিধা মানসম্পন্ন মনে হচ্ছে তার।
“এখানকার সুযোগ সুবিধা ভালো, খাওয়া-দাওয়া ভালো অন্যান্য জেলার তুলনায়। এখানে আমরা যে সুবিধা পাই, অন্য কোথাও মনে হয় পাওয়া যায় না। বিকেএসপিতেও আমরা ভালো অনুশীলন করতাম, কিন্তু এখানে রানিং, বল প্র্যাকটিস সবকিছুই আরও বেশি মানসম্পন্ন। কোচদের জানাশোনাও অনেক বেশি। তারা অনেক অভিজ্ঞ।”
বিকেএসপি আর এলিট একাডেমির শিক্ষার ধরণের পার্থক্য আরও পরিষ্কার হলো ফরোয়ার্ড মিরাজুল ইসলামের কথায়।
“২০১৭ সালে আমি বিকেএসপিতে ভর্তি হই। বিকেএসপির ছাত্র হিসেবে এখানে আছি। এলিট একাডেমিতে এসে যেটা শিখতে পারছি, সেটা বিকেএসপিতে পাইনি। ওখানে বেসিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা হয়। পল (স্মলি) আমাদের যেগুলো শিখিয়েছেন, সেগুলো বর্তমান কোচেরা শেখাচ্ছেন। বিসিএল বা অন্য কোনো টুর্নামেন্ট নয়, আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক ম্যাচ, সেখানে কী করতে হবে, কীভাবে খেলতে হবে, এটা দল হয়ে কিভাবে খেলব আমরা-এগুলোই এখানে শেখানো হয়। এখানকার অনুশীলন, মানসিক দিক নিয়ে শিক্ষা, আমাদের যে রুটিন কাজ, পজিশন নিয়ে মিটিং, আন্তর্জাতিক ম্যাচে নিজেদের ভূমিকা নিয়ে- এখানে এগুলো নিয়ে কাজ করি আমরা।”
১৯ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড কোনো একজনকে আদর্শ মানেন না। তবে বিশ্বসেরা তারকাদের দেখে সমৃদ্ধ করে তোলার চেষ্টা করেন নিজেকে।
“আমার কোনো আদর্শ খেলোয়াড় নেই। এমনি সবাই… মেসি, নেইমার, এমবাপে সবাই ভালো খেলোয়াড়, তাদের কাছ থেকে আমরা কিছু কিছু দিক নিতে পারি। যেমন মেসির ফ্রি কিক, এমবাপের গতি, নেইমারের স্কিল আমরা নিতে পারি। আমার পজিশনাল সেন্স এবং দূরপাল্লার শট ভালো, কিন্তু আমার হেডিংয়ে উন্নতি করা দরকার।”
দেশে কাজী তারিক রায়হান ও তপু বর্মন এবং দেশের বাইরে ব্রাজিলিয়ান চিয়াগো সিলভাকে আদর্শ মেনে বেড়ে উঠছেন ইমরান খান। কৃষক বাবা, গৃহিনী মায়ের এই ছেলে ভালো ফুটবলার হওয়ার চেষ্টার পাশাপাশি পড়ালেখাটাও চালিয়ে যাচ্ছেন।
“বড় ভাই অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যন্ত খেলার পর চোটে পড়েছিল, ওই রকম চিকিৎসা সুবিধা না পাওয়ায় সে আর খেলতে পারেনি। ভাইকে দেখেই আমার ফুটবলে আসা। ভাই বিকেএসপির ছাত্র ছিল, আমিও ভর্তি হলাম। বেশ কয়েকবার ট্রায়ালে চেষ্টা করার পর এবার এলিট একাডেমিতে এসেছি। বড় ভাইয়ের ওই চোটের কারণে আমার ফুটবলে আসাতে মায়ের বাধা ছিল, কিন্তু আব্বা সবসময় চেয়েছে আমি ফুটবল খেলি, তার সমর্থন পেয়েছি।”
“ফুটবলের পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছি। আসলে এখানে আমাদের ওভাবে পড়ার সুযোগ কম। সেক্ষেত্রে আমরা যে বইগুলো নিয়ে এখানে আসি, সেগুলোই নিজে নিজে পড়ি। প্রস্তুতির ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু সময় পাই, পড়াশোনার চেষ্টা করি।”
জামাল ভুঁইয়ার খেলার ধরনের সাথে মিল থাকায় মিডফিল্ডার চন্দন রায়ের প্রশংসা আলাদাভাবে ঝরল কোচদের মুখে। গত বছর হাভিয়ের কাবরেরা এই তরুণকে ক্যাম্পে ডেকেছিলেন। জাতীয় দলের সঙ্গে অনুশীলনও করেন এই মিডফিল্ডার। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলা নীলফামারীর এই উঠতির স্বপ্ন দেশের গন্ডি পেরিয়ে যাওয়ার।
“বাইরের দেশে খেলার ইচ্ছা আমার। দেশে আস্তে আস্তে খেলব, এরপর জাতীয় দলে খেলব, এরপর ইচ্ছা দেশের বাইরে খেলার। ক্যাম্পে দুই বছর ধরে আছি। ক্যাম্পে এসে অনেক কিছুতে লাভ হয়েছে আমাদের। অনুশীলন সুবিধা, কোচদের সাথে ওয়ান টু ওয়ান বসে সুবিধা-অসুবিধা নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ পাই আমরা।”
“আমিও ওনার (জামাল) চেয়ে ভালো হওয়ার চেষ্টা করব। ন্যাশনাল টিমের মতো এখানেও হাই ইন্টেনসিটির অনুশীলন হয়। ক্যাম্পে ডাক পাওয়ায় জাতীয় দলে খেলার ইচ্ছাটা আরও বেড়েছে। আমাকে বলে ফার্স্ট টাচে ( বলে প্রথম ছোয়াঁয়) আরও উন্নতি করা দরকার।”
এভাবেই একটু একটু করে স্বপ্ন বুনে এগিয়ে চলেছে উঠতি ফুটবলাররা।