সিশেলস আসলে কেমন দল?

বিস্ময়কর শোনালেও সত্য এই দলের অধিকাংশ ফুটবলারের মূল পেশা ফুটবল খেলা নয়!

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরসিলেট থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2023, 09:26 PM
Updated : 24 March 2023, 09:26 PM

আমি পেশায় বোট স্কিপার- রাখঢাক না করেই বললেন সিশেলস অধিনায়ক স্টেনিও মারি। জাতীয় দলের অধিনায়ক যেখানে নৌকার ক্যাপটেন, বাকিদের তখন কী অবস্থা? এবার কোচ নেভিল ভিভিয়ান বোথের উত্তর আরও কৌতুহল জাগানিয়া। জানালেন, কেউ পর্যটন শিল্পে, কেউ শিক্ষকতায়, কেউবা স্বাস্থ্য বিভাগে, কৃষিতে কিংবা নির্মাণশিল্পে চাকরি করেন! মানে, ফুটবল খেলাটা সে অর্থে সিশেলসের ফুটবলারদের মূল পেশা নয়!

বিস্ময়ের শেষ নয় এখানেই। সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে শনিবার বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে সিশেলসের ডাগ আউটে যাকে তর্জনী তুলে নানা নির্দেশনা দিতে দেখা যাবে, সেই বোথ নিজেও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ক শিক্ষক! কোচিং লাইসেন্স আছে তার, তবে মূল লেখাপড়া স্পোর্টস মেডিসিনের উপর।

প্রতিপক্ষ দল নিয়ে বাংলাদেশ কোচ হাভিয়ের কাবরেরার কথায়ও ঘুরেফিরে এসেছে ‘অ্যামেচার’ কিংবা ‘সেমি-প্রফেশনাল’ শব্দ যুগল। অবশ্য সেখানে সিশেলসকে সমীহ করার সুরও বেজেছে। কিন্তু সব মিলিয়ে প্রশ্নটা উঠছে- বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ সিশেলস আসলে কেমন দল?

ফিফার র‌্যাঙ্কিংয়ের পাতায় ঢু দিলে দেখাচ্ছে বর্তমানে পূর্ব আফ্রিকার দেশটির অবস্থান ১৯৯তম। বাংলাদেশ তাদের চেয়ে সাত ধাপ এগিয়ে ১৯২তম স্থানে। একটু মিল খুঁজে নেওয়া যায় এভাবে-বাংলাদেশের মতো তারাও এ বছর প্রথম খেলতে নামছে সিলেটের ম্যাচ দিয়ে।

ম্যাচ পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে ২০২২ সালে খেলা কোনো ম্যাচেই জিততে পারেনি তারা। ৯ ম্যাচের ছয়টিতে হার, বাকি তিনটি ড্র। বাংলাদেশের প্রাপ্তিও উজ্জ্বল নয় মোটেও। আট ম্যাচের মধ্যে জয় কেবল কম্বোডিয়ার বিপক্ষে। দুটিতে ড্র, বাকি পাঁচটিতে হার।

নিজেদের তেমন মানসম্পন্ন মাঠ নেই বলে সিশেলস ২০১৯ সালের পর থেকে বিদেশ-বিভূইয়ে খেলে বেড়াচ্ছে হোম ম্যাচ। বাংলাদেশের ফুটবলের অবস্থা এতটা বেহাল নয়। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম আছে; সিলেট, কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রামে ম্যাচ আয়োজনের সক্ষমতা আছে। ‘হোম ম্যাচ’ অন্তত জামাল-জিকোদের পরের উঠানে গিয়ে খেলতে হয় না।

এবার আসা যাক ক্লাব বা পেশাদার ফুটবল লিগের আর্থিক দিকটি। মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বাংলাদেশে প্রিমিয়ার লিগ হয় নিয়মিত। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের খেলোয়াড়দের কেউ কেউ অর্ধ কোটি টাকার উপরে বাৎসরিক পারিশ্রমিক পান।

ঠিক উল্টো মেরুতে সিশেলসের ফুটবলাররা। ক্লাব থেকে কোনো আর্থিক সহযোগিতা জোটে না জসুয়া-ডিনদের। দলটির কোচই সেটা খোলাসা করলেন অকপটে। জানালেন, খেলোয়াড়দের জন্য ফুটবল খেলাটা ‘সময় কাটানোর’ মতো!

“ক্লাবের কাছ থেকে এই খেলোয়াড়রা কোনো পারিশ্রমিক পায় না। যদি কোনো ম্যাচ জিতে বা কোনো খেলোয়াড় ভালো করে, তাহলে ক্লাব যদি অন্য কোথা থেকে কিছু আনুদান পায়, তাহলে সেখান থেকে কিছু খেলোয়াড়দের দেয়। একজন খেলোয়াড়কে সেটা ৩০ ডলারের মতো।”

“আমি আবারও বলছি, কেউ যদি মনে করে, আমি এই দলটাকে ভালোবাসি, ওদেরকে কিছু (অনুদান) দেব, তাহলে সেখান থেকে ওই পরিমাণ অর্থ খেলোয়াড়দের দেওয়া হয়। এর বাইরে কোনো টাকা-পয়সা দেওয়া হয় না।”

দেশটির ফুটবল কাঠামো এবং খেলোয়াড়দের জীবন-জীবিকা নিয়ে বোথ জানালেন আরও কিছু বিস্ময়কর তথ্য। লাখ খানেক মানুষের এই দেশটিতে আটটি দল নিয়ে হয় তাদের লিগ! প্রায় পাঁচশর মতো ফুটবলার আছে। তারা দিনের বেলায় কাজ করেন জীবিকার জন্য, ফুটবল তাদের কাছে অনেকটা সময় কাটানোর মত! যদিও তার দাবি, সিশেলসের লিগ দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ।

এবার আসা যাক দ্বিপাক্ষীক এই সিরিজ নিয়ে দুই দলের প্রস্তুতির বহর নিয়ে। গত দেড় মাসে প্রতি সোমবার মিলিয়ে মোট ছয়টি ট্রেনিং সেশন করার কথা জানালেন বোথা। মাত্র ছয়টি সেশন হওয়ার কারণ খেলোয়াড়দের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে অন্যত্র কাজ করা। সেখানে সৌদি আরবে দশ দিনের ট্রেনিং ক্যাম্প করে এসেছে বাংলাদেশ, সিলেটে এসে হয়েছে সপ্তাহখানেকের অনুশীলন।

এই সিশেলসই ২০২১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় এসে চমক উপহার দিয়েছিল। শ্রীলঙ্কায় হওয়া মহিন্দা রাজাপাকসে টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সঙ্গে করেছিল ড্র। পরে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে জিতেছিল আমন্ত্রণমূলক ওই টুর্নামেন্টের শিরোপা।

বর্তমান দলের ড্যারিল লুইস ও মাইকেল মানচিনের আছে ইংল্যান্ডে খেলার অভিজ্ঞতা! মানচিনে খেলেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষ দল চেলসিতে। এছাড়া নটিংহ্যাম ফরেস্ট, কুইন্সপার্ক রেঞ্জার্স, উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্সেও খেলেছেন। ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়ার সুবাদে খেলেছেন দেশটির বয়সভিত্তিক দলে। জাতীয় দল হিসেবে তিনি তুলে নিয়েছেন সিশেলসের জার্সি।

লুইস, মানচিনে থাকলেও বোথা নিজের দলকে ‘অ্যামেচার’ বলেছেন একাধিকবার। কিন্তু তারপরও সিশেলস কেমন দল, তা নিয়ে বোধহয় অনুসিদ্ধান্তে আসা কঠিনই বাংলাদেশের জন্য।