ফ্রান্সের প্যারিসে শনিবার রাতের ফাইনালে ১-০ গোলে জিতে রেকর্ড ১৪তম বারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতল মাদ্রিদের দলটি।
ইউরোপ সেরার মঞ্চে রিয়ালের এবারের সাফল্যকে অবিশ্বাস্য বললেও বুঝি কম বলা হয়। নকআউট পর্বের প্রতিটি ধাপেই তারা পড়েছিল ছিটকে পড়ার দ্বারপ্রান্তে এবং হার না মানা, হাল না ছাড়া মানসিকতায় প্রতিবারই খাদের কিনারা থেকে দুর্দান্ত সব ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লেখে দলটি।
ফাইনালের মঞ্চে অবশ্য তেমন কোনো গল্প বা মহাকাব্য নয়, বরং প্রতিপক্ষের টানা আক্রমণের মুখে ঘর সামলাতেই ব্যস্ত সময় কাটে তাদের। তবে, এত চাপে একটুর জন্যও দিক হারায়নি দলটি। রক্ষণ জমাট রেখে কাটিয়ে দেয় সময় আর বিশ্বস্ত প্রহরীর মতো পোস্ট আগলে রাখলেন কোর্তোয়া।
মাঠে আক্রমণের হিসেবে লিভারপুলের দাপট কতটা ছিল, তা ম্যাচ পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট ফুটে উঠছে। গোলের উদ্দেশ্যে ২৪টি শট নেয় তারা, যার ৯টি ছিল লক্ষ্যে। সেখানে রিয়াল নিতে পারে মোটে চার শট, লক্ষ্যে মাত্র দুটি।
পরক্ষণেই আরেকটি সুযোগ পায় লিভারপুল; এবার অবশ্য থিয়াগো আলকান্তারার শট যায় কোর্তোয়া বরাবর। এক মিনিট পর আবারও ভীতি ছড়ান সালাহ। তবে তিনিও শট নিয়ে বসেন কোর্তোয়ার সোজা।
চাপ ধরে রেখে ২১তম মিনিটে সেরা সুযোগটি পায় লিভারপুল। তবে কোর্তোয়ার নৈপুন্যে ও ভাগ্যের ছোঁয়ায় বেঁচে যায় রিয়াল। ডি-বক্সের বাইরে থেকে সাদিও মানের জোরাল নিচু শটে ঝাঁপিয়ে কোনোমতে আটকান গোলরক্ষক, তার হাতে লেগে বল বাধা পায় পোস্টে।
একচেটিয়া আক্রমণে প্রথম ২৮ মিনিটে মোট ছয়টি শট নেয় লিভারপুল, যার মধ্যে চারটি ছিল লক্ষ্যে। এই সময়ে রিয়াল কোনো শটই নিতে পারেনি। এরপর পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করলেও পারছিল না তারা। উল্টো ৩৪তম মিনিটে আবারও ডি-বক্সে দারুণ পজিশনে বল পেয়ে যান সালাহ। যদিও আবারও গোলরক্ষক সোজা হেড করে নিয়ে হতাশ করেন তিনি।
ফাবিনিয়ো ও কোনাতের থেকে বল কাড়তে ছুটে যান ফেদে ভালভেরদে, পারেননি তিনিও। তবে তাদের বল কাড়াকাড়ির মাঝেই ফাঁকায় পেয়ে যান বেনজেমা। এবার আর জালে পাঠাতে ভুল করেননি তিনি। তবে অফসাইডের পতাকা তোলেন লাইন্সম্যান। ভিএআর অনেক সময় নিয়ে দেখে অফসাইডের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। শেষবার বেনজেমা বল পাওয়ার সময় শেষ খেলেয়াড় হিসেবে তার পেছনে ছিলেন অ্যান্ড্রু রবার্টসন।
গোলের উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যে এটা ছিল রিয়ালের দ্বিতীয় শট। যেখানে ওই সময়ের মধ্যে লিভারপুলের ১০ শটের ৫টি ছিল লক্ষ্যে। মৌসুমে জুড়ে দুর্দান্ত খেলা ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গোল হলো চারটি।
একবিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেওয়া প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে গোল করলেন ২০০০ সালের ১২ জুলাই জন্ম নেওয়া ভিনিসিউস।
গোলপোস্টে ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটানো কোর্তোয়া পাঁচ মিনিট পর আবারও রিয়ালের ত্রাতা। একেবারের গোলমুখে সালাহর প্রচেষ্টা কোনোমতে পা দিয়ে আটকান তিনি। খানিক পর গোলমুখে সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও নিরাশ করেন কাসেমিরো। প্রথম সুযোগে শট নিয়েই ভুলটা করেন তিনি, বলও হারিয়ে ফেলেন।
বাকি সময়ে লিভারপুল কেবল আক্রমণই শানিয়েছে, কিন্তু সত্যিকারের সুযোগ তৈরি করতে পারেনি আর। আসরে সর্বোচ্চ ১৫ গোল করা এবং মৌসুমে রিয়ালের সব সাফল্যের মূল নায়ক বেনজেমা শেষে গোল করে মুহুর্তটা আরও রাঙানোর সুযোগ পেয়েছিলেন, তবে কাজে লাগাতে পারেননি।
তবে ক্ষণিকের সেই ব্যর্থতা ম্লান হয়ে গেছে শিরোপা হাসির কাছে। পাঁচ মিনিট যোগ করা সময়ের পর শেষের বাঁশি বাজতেই সেই চেনা দৃশ্য; হতাশায় মুখ ঢেকে নুয়ে পড়লেন লিভারপুলের অনেকে। আর পাশেই উল্লাসে ফেটে পড়ল রিয়ালের কোচ, খেলোয়াড় এবং গ্যালারির দর্শকরা।
২০১৭-১৮ আসরের ফাইনালে এই লিভারপুলকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ত্রয়োদশ শিরোপা জিতেছিল রিয়াল। তাদেরকেই কাঁদিয়ে সংখ্যাটা ১৪-তে উন্নীত করল মাদ্রিদের দলটি।
বরং প্রতিশোধ নিল রিয়াল; ১৯৮১ সালে এই প্যারিসেই ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে ‘অল রেড’ খ্যাত দলটির বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরেছিল তারা।
লিভারপুলের বিপক্ষে তাদের সবশেষ হারের স্মৃতিও ওটাই। এরপর থেকে এই নিয়ে আরও ছয়বার মুখোমুখি হয়ে রিয়াল জিতল পাঁচবার, অন্যটি ড্র।
মাদ্রিদে সময়টা যে এখন আনন্দে ভাসার, উৎসবে মেতে ওঠার।