কদিন আগের সময়গুলো ছিল উৎকণ্ঠায় ভরা। অপরহরণকারীদের হাতে বন্দী ছিলেন বাবা। লুইস দিয়াসের দিনগুলিও কাটছিল ভয়ে, শঙ্কায়। অসহনীয় সেই সময় কেটে গেছে। মুক্তি পেয়ে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচ দেখতে গ্যালারিতে এলেন লুইস মানুয়েল দিয়াস। দেখলেন ছেলের জোড়া গোলে কলম্বিয়া দারুণর জয়। আবেগ, উচ্ছ্বাসের ঢেউ বেরিয়ে এলো আনন্দাশ্রু হয়ে। কলম্বিয়া-ব্রাজিল ম্যাচের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে উঠল এই ছবিগুলোই।
২০২৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সকালে নিজেদের মাঠে পিছিয়ে পড়ে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্রাজিলকে ২-১ গোলে হারায় কলম্বিয়া। জোড়া গোলে দলের জয়ের নায়ক দিয়াস।
এই প্রথম বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ব্রাজিলের বিপক্ষে জয়ের স্বাদ পেল কলম্বিয়া। এই জয়ে কাতার বিশ্বকাপে খেলতে না পারা দলটির ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলার সম্ভাবনা বাড়ল আরও। লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের বাছাইয়ের টেবিলে ৯ পয়েন্ট নিয়ে তিনে আছে তারা।
বাছাইয়ের বৈতরণী কলম্বিয়া পেরুতে পারলে বিশ্বকাপের জন্যও তা হবে আকর্ষণীয় ব্যাপার। সালসা, শৈল্পিক ফুটবল এবং আবেদনময়ী উদযাপনে কলম্বিয়ানরা মাতিয়ে রাখবে বিশ্বকাপের আঙিনা। এগুলো অবশ্য ভবিষ্যতের ভাবনা। বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিয়াস ও তার বাবা!
কলম্বিয়ার ছোট শহর বারানকাস থেকে গত ২৮ অক্টোবর দিয়াসের বাবাকে অপহরণ করেছিল গেরিলা গ্রুপ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি বা ইএলএন-এর সদস্যরা। একই দিন তার মাও অপহৃত হন, পুলিশ দ্রুতই তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
কিন্তু বাবার মুক্তির জন্য শঙ্কা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে সময় কাটে দিয়াসের। ১২ দিন পর দিয়াসের বাবাকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। মুক্তি পাওয়া বাবা-ছেলের অশ্রুসিক্ত, আবেগঘন ছবি নাড়া দিয়েছিল সবাইকে।
ব্রাজিল ম্যাচে কলম্বিয়ার চেনা হলুদ জার্সিতে মানুয়েল ছিলেন গ্যালারিতে, ছেলেকে অনুপ্রাণিত করতে। ছেলে হতাশ করেনি একটুও। জোড়া গোলে গড়ে দেয় ম্যাচের ভাগ্য।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটারে) একজন টুইট করেছেন, “সৃষ্টিকর্তা এই সুন্দর পরিবারটির সহায় হউন। আশা করি, এরকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেন তারা আর কখনই না যায়; কেবল তারা নয়, কলম্বিয়ার কোনো পরিবারই যেন না যায়; কেননা, আমরা এভাবে বাঁচতে চাই না।”
দিয়াসও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এক বার্তা লেখেন, “একটা পরিবারের মতো আবার এক হওয়ার সুযোগ দেওয়ায় সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ।”
আবেগের এই রেশ দিয়াসকে জড়িয়ে রাখে ব্রাজিল ম্যাচের পরও। বাবাকে জয় উৎসর্গ করতে গিয়ে অশ্রু আটকে রাখতে পারেননি তিনি। মানুয়েলকেও গ্যালারিতে উচ্ছ্বাস করতে দেখা যায় আপ্লুত নয়নে। ম্যাচ শেষে কথা বলার সময়ও দিয়াসকে ছুঁয়ে যায় আবেগ।
“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। তিনিই সবকিছু সম্ভব করেছেন। আমরা সবসময় কঠিন মুহূর্তের মধ্যে বাস করি, কিন্তু জীবন আপনাকে শক্তিশালী এবং সাহসী করে তোলে। জীবনের মতো ফুটবলও তাই করে। এই জয় আমাদের প্রাপ্য।”
নিজ দলের হারের হতাশা আড়ালে পড়ে গেল আলিসনের মন্তব্যেও। ম্যাচ শেষের প্রতিক্রিয়ায় ব্রাজিল গোলরক্ষকের কথাতেও থাকল লিভারপুল সতীর্থের জন্য ভালোলাগা।
“সে আমার বন্ধু। বিগত দিনগুলোতে সে অনেক ভুগেছে। এটা ফুটবলের চেয়ে বেশি কিছু, এই জয় দিয়াসের প্রাপ্য।”
দুঃসময়ে পাশে থাকা বন্ধু আলিসনকেও প্রশংসায় বেঁধেছেন দিয়াস।
“আলিসন আমাকে বলেছে, সে খুবই খুশি। কেননা, সে জানে আমরা কিসের মধ্য দিয়ে গেছি।”
“সে দারুণ একজন মানুষ। আমি তাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি। কেননা, মাঠের বাইরে সে মহৎ একজন মানুষ এবং কঠিন সময়ে আমি যেন শান্ত থাকতে পারি, সেজন্য সব ধরণের সাহায্য আমাকে করেছিল সে।”
দিয়াসের কলম্বিয়া আগামী বুধবার বাছাইয়ে পরের ম্যাচে প্যারাগুয়ের মুখোমুখি হবে। আলিসনের ব্রাজিলের পরের ম্যাচের প্রতিপক্ষ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা। দুজনেই এখন ব্যস্ত হবেন পরের ম্যাচ নিয়ে।
ভেনেজুয়েলার সঙ্গে ঘরের মাঠে ১-১ ড্রয়ের পর উরুগুয়ের বিপক্ষে ২-০ গোলে হেরে বসে ব্রাজিল। ব্যর্থ পথচলায় এবার এই হার!
সেলেসাওদের টানা দুই ম্যাচে এমন হারের পরও হয়তো এই ফল নিয়ে তেমন কথা হবে না! হেরে যাওয়া আলিসনের কথাটিই যেন এ ম্যাচের সব, “এটা ফুটবলের চেয়েও বেশি কিছু।”