নরসিংদী-১: নৌকা আত্মবিশ্বাসী, আশায় আশায় ধানের শীষ

বস্ত্রশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ নরসিংদী-১ আসন এক সময় পরিচিত ছিল বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে; কিন্তু এবার নির্বাচনী এলাকায় ধানের শীষের পোস্টারই চোখে পড়ছে কম।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Dec 2018, 04:13 PM
Updated : 24 Dec 2018, 03:58 AM

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী চষে বেড়াচ্ছেন পুরো এলাকায়; চলছে নৌকা মার্কার জমজমাট প্রচার।  

গত দুটি নির্বাচনে এ আসনে নৌকাকে বিজয়ী করে আনা পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরু এবারও এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী।

আর বিএনপি এবার প্রার্থী করেছে দলের যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনকে। মনোনয়ন পাওয়ার পরদিন থেকেই তিনি কারাগারে।

৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হিরু ও খোকনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন আরও ছয়জন। তবে স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনী এলাকায় আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছেন নৌকা আর ধানের শীষের দুই প্রার্থী।

গত দশ বছরের উন্নয়নের খতিয়ান তুলে ধরে হিরু বলছেন, এবারও তিনি আত্মবিশ্বাসী। অন্যদিকে খোকনের কর্মী-সমর্থকদের আশা, পোস্টার-প্রচারণা লাগবে না, সাধারণ মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলেই তারা জয় পেয়ে যাবেন।

নরসিংদী সদর উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন এবং দুটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত নরসিংদী-১ আসনে ভোটার আছেন তিন লাখ ৮০ হাজার ৯৫ জন।

১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনটি নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির প্রার্থী সামসুদ্দিন আহমেদ এছাক বড় ব্যবধানে জয়ী হন।

২০০৪ সালে এছাকের মৃত্যুর পর উপ নির্বাচনে জিতে এমপি হন বিএনপির খায়রুল কবির খোকন।চিত্র পাল্টায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে।

নবম সংসদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নজরুল ইসলাম হিরু সাত হাজার ভোটের ব্যবধানে খোকনকে হারিয়ে সংসদে পৌঁছে যান।

২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনেও এই আসনটি ধরে রাখে আওয়ামী লীগ। টানা দ্বিতীয়বার এমপি হয়ে নজরুল ইসলাম হিরু পান প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নজরুল ইসলাম হিরু, বিএনপির ধানের শীষ নিয়ে খায়রুল কবির খোকন, মই নিয়ে বাসদের মোবারক হোসেন আকন্দ, গোলাপ ফুল নিয়ে জাকের পার্টির মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া, হাতপাখা নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. আশরাফ হোসেন ভূঁঞা, মাছ প্রতীক নিয়ে গণফ্রন্টের মো. জাকির হোসেন এবং লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জাতীয় পার্টির মো. শফিকুল ইসলাম নির্বাচন করছেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলছেন, গত দশ বছর ক্ষমতায় থাকায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিরু নরসিংদীতে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করেছেন। দলের এখন কোনো কোন্দল নেই, তার ভাবমূর্তি নিয়েও কোনো সমস্যা হয়নি। এগুলো হিরুর পক্ষে জনমত তৈরিতে সহায়তা করেবে।

অন্যদিকে বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, ধানের শীষের প্রার্থী খোকন ছাড়াও দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীরা বিভিন্ন মামলায় কারাগারে। সাংগঠনিকভাবে কোণঠাসা হলেও বিএনপির ‘ভোট ব্যাংক’ নির্বাচনে ঠিকই কাজে লাগবে।

শনিবার মহিষাশুরা ইউনিয়নে ভোটের প্রচার চালানোর ফাঁকে নজরুল ইসলাম হিরু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জেলা শহরের বাইরের এবং মেঘনার চরের চারটি চরের মানুষরা নিজেদের অবহেলিত মনে করত। কিন্তু আমি ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। রাস্তাঘাট, বিদ্যুত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছি। চরের মানুষের দুটি প্রধান দাবি নরসিংদীর সঙ্গে সরাসরি সেতু এবং বিদ্যুত- আমিই পূরণ করেছি। এজন্য মানুষ আমাকে ভোট দেবে বলে মনে করি।”

নরসিংদী শহরের বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে ধানের শীষের চেয়ে হাতপাখার পোস্টার বেশি দেখা গেছে। বিএনপির কোনো নির্বাচনী ক্যাম্পও কোথাও নেই। খায়রুল কবির খোকন বিভিন্ন মামলায় কারাগারে থাকায় তার পক্ষে ভোট চাইছেন তার স্ত্রী মহিলা দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা।

আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের ‘বাধায়’ প্রচার চালাতে পারছেন না অভিযোগ করেন শিরিন বলেন, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী প্রশাসনকে ‘ন্যক্কারজনকভাবে’ ব্যবহার করছেন।

“প্রতিদিনই কর্মীদের ধরা হচ্ছে। কোনো পোস্টার, লিফলেট বিতরণ করতে দিচ্ছে না। মাইক বাজালে ভেঙে দিচ্ছে। আমি যদি কোনো উঠান বৈঠকে যাই, আধা ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ গিয়ে যারা আমার সঙ্গে ঘুরেছে তাদের ধরে নিয়ে আসে। একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে রাখা হয়েছে।”

এ অবস্থায় ‘সারভাইভ’ করার কোনো সুযোগ দেখছেন বলে মন্তব্য করলেও আশা ছাড়ছেন না শিরিন সুলতানা।

“আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের পোস্টার লাগবে না, লিফলেট লাগবে না। মানুষ যেভাবে উন্মুখ হয়ে আছে, ভোট দিতে পারলে আমরা বিজয়ী হবে। সেই বিশ্বাস নিয়েই আমরা এখনো মাঠে আছি।”

বিএনপির অভিযোগ পুরোপুরি ‘বানোয়াট’ মন্তব্য করেন নৌকার প্রার্থী হিরু বলেন, এমপি হওয়ার পর দশ বছরে বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে তিনি কোনো মামলা দেননি।

“ধৈর্য্যের সঙ্গে আওয়ামী লীগকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনীতি করেছি, আর সব মানুষের এমপি হিসেবে কাজ করেছি। আমার অনেক নেতাকর্মী বদলা নিতে চেয়েছে, কিন্তু আমি দিইনি।”

নির্বাচনের আগে কারাগারে যাওয়া খায়রুল কবির খোকনের ‘রাজনৈতিক কৌশল’ হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা।

“তিনি হাই কোর্ট থেকে জামিনে ছিলেন, হঠাৎ করে কেন আদালতে গিয়ে হাজির হলেন সেটা আমার বোধগম্য হয় না।”

কর্মী-সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি

মাধবদী-বালাপুর সড়কের পাশে মহিষাশুরা ইউনিয়নের দরগাকান্দায় কথা হয় কৃষক আবদুল মোতালেবের সঙ্গে। নিজেকে ‘জন্মসূত্রে’ আওয়ামী লীগের সমর্থক দাবি করা মোতালেব বলেন, তাদের কেন্দ্রে কখনো বিএনপি জয়ী হয়নি, এবারও হবে না বলেই তার বিশ্বাস।

“আগে এমপি আছিল শামসুদ্দিন এছাক। হেও কোনোদিন আঙ্গো (আমাদের) এলাকায় আইয়ে নাই, খোকন সাব এমপি হওয়ার পরেও হ্যারে পাই নাই। কিন্তু আওয়ামী লীগ আওয়ার পর আঙ্গো এলাকায় রাস্তাঘাট পাইছি। নৌকা মার্কায় ভোট দিয়া উপকার পাইছি।”

তবে স্থানীয় পাওয়ারলুম শ্রমিক মো. কাউসারের দাবি, এ এলাকায় বিএনপির ভোটার এখনও বেশি । তিনি বলছেন, বিএনপির লোকজন ভয়ে কম কথা বলে।

“বড় নেতারা নাই। ছোট নেতারাও সব জেলে আছে। কেউ পোস্টার লাগাইতে আসলে পুলিশ-আওয়ামী লীগের কর্মীরা বাধা দেয়। নির্বাচন ক্যাম্নে করবে।”

পাইকারচর ইউনিয়নের বালাপুর বাজারে গিয়ে নৌকা এবং ধানের শীষ- দুই প্রার্থীরই পোস্টার দেখা গেল। এখানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপিও কিছু প্রচার চালাতে পারছে বলে জানান রংমিস্ত্রি এবাদুল হক।

তিনি বলেন, “ভোটে কেডা যে জিতে কওন যায় না। তয় আঙ্গো এলাকায় বিএনপির ভোট বেশি।”

আবদুর রহমান নামে আরেক বিএনপি সমর্থক বলেন, “বিএনপির লোকজন মাডে নামতারে না। চুপ মাইরা আছে। কয় দিন আগে বিএনপি একটা জনসভা করতে চাইছিল। পুলিশ আইসা না কইরা গ্যাছে। হ্যাগোবালা (তাদের বেলায়) ঠিক আছে, বিএনপি মিছিল করত চাইলে পুলিশ আইয়্যা পড়ে।”

পাইকারচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. সোলাইমান বলেন, তার এলাকা মেঘনাবাজার কেন্দ্র থেকে কখনও বিএনপির প্রার্থী পাস করতে পারেনি। এলাকার উন্নয়নে কাজ করায় আওয়ামী লীগের ভোট ‘আরও বেড়েছে’।

“গত চাইর পিরিয়ড ধইরা এই কেন্দ্রে বিএনপি পাস করতারে না। এইখানে বিএনপির লোকঅই নাই, পোস্টার মারব ক্যাডা? সব রাস্তাঘাট সুন্দর, এক মাথাত্তে আরেক মাথাত রিকশায় যাওন যায়। হের লাইগ্গা মানুষ নৌকায় বোট দিব।”

নির্বাচন কেমন হচ্ছে এমন প্রশ্নে কাঁঠালিয়া ইউনিয়নের নোয়াকান্দী গ্রামের কাপড় ব্যবসায়ী শরিফুল বলেন, আওয়ামী লীগের লোকেরা নির্বাচন করতে পারে। বিএনপির লোকেরা পারে না।

“ডরে কেউ পোস্টার লাগায়ও না। এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তাতে ভোট দিতারমু এমন আশা করি না। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে যাইতে না করছে।”

বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগকে আবারও নির্বাচিত করা উচিত বলে মন্তব্য নুরালাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জামান মিয়ার।

তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর তার কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি দেশের উন্নয়নে অনেক কাজ করেছেন। দেশকে এগিয়ে নিতে যে কাজগুলো এখনও অসমাপ্ত, সেগুলো শেষ করার জন্যই আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়া উচিত।”

ভোটারদের ভাবনা কী?

নির্বাচন  নিয়ে কী ভাবছেন জানতে চাইলে শিলমান্দি ইউনিয়নের খিদিরপুর গ্রামের শফিকুল ইসলাম বলেন, “আমি এখনও ঠিক করি নাই কারে ভোট দিমু। কিন্তুক ভোট যারেই দেই, আমি চাই ভোট সুষ্ঠু হউক, কোনো দাঙ্গা হাঙ্গামা য্যান না হয়। এইটা শুধু আমি না আমার গেরামের সব মানুষই চায়।”

নরসিংদী শহরের লাইব্রেরিপট্টির ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান বলেন, নির্বাচনে সবার সমান সুযোগ থাকলে ‘ভালো হতো’।

“নির্বাচন যদি একটা খেলা হয়, তাইলে দুই তিনটা পক্ষ থাকবে। কিন্তু এই নির্বাচনে দেখেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ মাঠে নাই। এই খানে নির্বাচন জমা বলে না।”

লাইব্রেরিপট্টির ব্যবসায়ী সানাউল্লাহ নিজেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক দাবি করে বলেন, ‘একপেশে’ নির্বাচনে মজা নেই।

“বিরোধী দলের প্রচার-প্রচারণা চালাত, শোডাউন হইত। এখন তো কিছুই নাই। শহরের নির্বাচনের কোনো ঝাঁঝ নেই। মাঠের খেলায় দুই দল থাকলে মজা হয়। এক দলের খেলায় কোনো মজা নাই।”