খোলা সেমাই তৈরির পরিবেশ ও উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে নেতিবাচক প্রচারে ক্রমেই এর বিক্রি কমে আসছে। সেই বাজারটিই চলে যাচ্ছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে।
Published : 28 Mar 2025, 11:42 PM
সেমাই ছাড়া বাঙালির ঈদ যেন পানসে। একসময় পাড়া-মহল্লার দোকানে হরেদরে খোলা সেমাই মিলেছে, এখনো মেলে কিছু কিছু। তবে ধীরে ধীরে সেখানে চকচকে প্যাকেটে নানা স্বাদের সেমাই জায়গা নিচ্ছে।
সেমাইয়ের বাজারে এখন করপোরেট দুনিয়ার দাপট। ক্রেতারাও ‘স্বাস্থ্যকর’ ভেবে চোখ বন্ধ করে বেছে নিচ্ছেন সেসব ‘করপোরেট সেমাই’।
চকচকে মোড়কে বন্দি সেমাইয়ের স্বাদ বাড়াতে যুক্ত হচ্ছে কিসমিস, বাদামসহ নানা উপকরণ। সেমাইয়ের স্বাদে ভিন্নতা আনতে করপোরেট কোম্পানিগুলো রীতিমত প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
আবার নামমাত্র উপকরণ মেশানো সেমাই মোড়কে মুড়িয়ে খোলা বাজারের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করার অভিযোগও রয়েছে।
ময়দা ও চালের গুঁড়া দিয়ে চিকন সেমাই তৈরি হয় খোলা বাজারে। আর মোড়কের সেমাইয়ের প্রধান উপকরণই ময়দা।
খোলা চিকন সেমাই প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকায়। আর লাচ্ছা সেমাই প্রতিকেজি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা দরে।
মোড়কে ঢুকিয়ে সেই লাচ্ছা সেমাই বিক্রি হচ্ছে কমপক্ষে ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১২০০ টাকা কেজিতে।
খোলা ও মোড়কে বিক্রি হওয়া লাচ্ছা সেমাই- সবই ঘি দিয়ে ভাজা বলে বিক্রেতারা দাবি করেন।
খোলা সেমাই তৈরির পরিবেশ ও উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে নেতিবাচক প্রচারে ক্রমেই এর বিক্রি কমে আসছে। আর সেই বাজারটিই চলে যাচ্ছে করপোরেট কোম্পানিগুলোর হাতে।
করপোরেট কোম্পানির কাছে বাজার হারাতে বসা লাচ্ছা সেমাই উৎপাদনকারী ঢাকার কেরাণীগঞ্জের তৈলঘাটের ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন এবার আগাম ক্রয়াদেশ ছাড়া সেমাই তৈরি করছেন না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আগে তো রোজা এলেই ময়দা, চিনি, তেল, ঘি সংগ্রহ করতে শুরু করতাম। টাকা ধার কইরা আনতাম। রোজার মাঝখানে বানাইয়া ২০ রোজার পর থেকে বাজারে-বাজারে দিয়ে আসতাম।
“সেমাই তো বিক্রি হয় সবার শেষে। ঈদের দুই তিন-দিন আগে থাইক্কা বাজার শুরু হয়। আমাগো বানানো তো আরো আগে। অহন, সবাই প্যাকেট সেমাই খায়। অর্ডারও কমতাছে।”
খোলা পরিবেশে সেমাই তৈরির ভিডিও টেলিভিশন, ইউটিউব, সোশাল মিডিয়ায় বেশি বেশি প্রচারের কারণেই ব্যবসা ধ্বংসের পথে–এমন দাবি করেন এই ব্যবসায়ী।
“আমাগো সেমাই তো ধরলেই বুঝা যায়, এক্কেরে তাজা বানানো। সর্বোচ্চ ১০ দিন আগে ভাজার পরে কাস্টমার পায়। আপনে দেহেন, কোম্পানির মাল কবে বানাইছে, হেরা তো প্যাকেট কইরা মেয়াদ লেখতাছে দুই বছর।”
বিভিন্ন দোকান ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ঘুরে মোড়কের সেমাইয়ের উৎপাদন ও মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখের ব্যবধান ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত দেখা গেছে।
কোম্পানিগুলো সবশেষ যে মোড়কের সেমাই বাজারে ছেড়েছে তাও গত ফেব্রুয়ারি মাসে উৎপাদিত।
ঢাকার মতিঝিল টি অ্যান্ডটি কলোনি, শান্তিনগর, কারওয়ান বাজার ও মহাখালী এলাকার দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ঈদ কাছে চলে আসায় সেমাই তুলতে শুরু করেছেন দোকানিরা।
সাধারণত ঈদের দুই-একদিন আগে বাজারের খোলা জায়াগায় অস্থায়ী চুলা বসিয়ে ভাজা হয় লাচ্ছা সেমাই। গত কয়েক বছরে সেই প্রবণতাও কমে গেছে।
ছোটো বেলায় বাবার সঙ্গে সেমাই কিনতে যাওয়ার সেই স্মৃতি স্মরণ করে শান্তিনগরের হামিদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আব্বার সঙ্গে বাজারে যেতাম লাচ্ছা সেমাই কিনতে। দোকানের সামনে ভাজত, ঘ্রাণে ম ম করত। সেমাই হাতে নিয়ে আব্বা মুঠ বন্ধ করে চেপে চেপে দেখতেন সেমাই কেমন ভাজা হল।
“এখন সেই খোলা সেমাই কেনা হয় না। দোকানের সামনে তো এখন ভাজাও হয় না। কোথায় ভাজে কে জানে, দোকানে এলে পলিথিনে মোড়ানো দেখি। তাই প্যাকেটের সেমাই কিনি, দাম অনেক বেশি নেয়। কিন্তু কি আর করব।”
মোড়কের সেমাইতে স্বাদ পেলেও খোলা সেমাই তরতাজা হওয়ায় স্বাদ বেশি বলে মত দেন তিনি।
শান্তিনগরের রহমান ট্রেডার্সের কর্ণধার শফিকুর রহমান বলেন, “সেমাই বিক্রি আরো পরে। ২৫ রোজার পরে বিক্রি হবে। প্যাকেটের চেয়ে খোলাটাই আমার বেশি চলে। দামে কম, লোকজন দেখে নিতে পারে।”
স্বল্প পরিমাণে দোকানের সামনে সাজিয়ে রাখা সেমাই দেখিয়ে কারওয়ান বাজারের মেসার্স হামজা স্টোরের রফিকুল ইসলাম বলেন, “সেমাই তো ঈদের বাজারের সবশেষে কেনেন কাস্টমাররা। তাই এখনো সেভাবে ডিসপ্লে করা হয়নি। এখন প্যাকেট সেমাই বিক্রি হয় বেশি। খোলাও বিক্রি হয়, আমি খোলা সেমাই বিক্রি বাদ দিছি।”
বাজারে যেসব কোম্পানির সেমাই বেশি চলে, তার একটি প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। কোম্পানির জনসংযোগ কর্মকর্তা তৌহিদ জামান দাবি করলেন, দেশের বাজারের ২০ শতাংশ সেমাই এখন তারা সরবরাহ করছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তৌহিদ বলেন, "আমাদের সেমাইয়ের ব্যবসা চলে দুই ঈদকে কেন্দ্র করে। তিন মাসের মত ব্যবসা হয়। অন্যান্য সময়ে চললেও তা খুবই সীমিত। তবে আমরা সেমাই রপ্তানিও করি।”
দাম বাড়েনি সেমাই ও গুঁড়ো দুধের
সারা বছরই সেমাইয়ের চাহিদা থাকলেও দুই ঈদে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বললেন, বছরে সেমাই উৎপাদন হয় আনুমানিক ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টন। তবে পুরো সঠিক তথ্য তাদের কাছে নেই।
খোলা সেমাইয়ের চেয়ে এখন প্যাকটের সেমাইয়ের চাহিদা যে বেশি, শফিকুরও সে কথা বললেন।
“খোলা বাজারের সেমাইয়ের তো মান নিয়ন্ত্রণের বিষয় থাকে। এটি কীভাবে হবে তার তো কোনো নির্দেশনা নেই। আবার সবকিছু তো সরাসরি মাণ নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব না। সচেতনতা যতটা বাড়ানো যায়। এজন্য প্যাকেটের সেমাই বেশি চলছে।”
সারা বছরের চাহিদার এক তৃতীয়াংশ সেমাই ঈদের সময় বিক্রি হয় বলে জানালেন শফিকুর রহমান।
বেশিরভাগ করপোরেট কোম্পানি ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম ওজনের সেমাই প্যাকেট করে বাজারে ছেড়েছে। কোম্পানি ভেদে ১৫০ গ্রাম প্যাকেটের দাম ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আর ২০০ গ্রাম প্যাকেটের সেমাই ৬০ থেকে ৭০ টাকা।
খোলা ও প্যাকেটের সেমাই আগের বছরেও একই দরে বিক্রি হয়েছে বলে দোকানিদের ভাষ্য।
প্যাকেটের লাচ্ছা সেমাই বিক্রি হচ্ছে ১২০০ টাকা কেজি দরে। কোনো কোনো কোম্পানি ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই ৪০০ গ্রামের প্যাকেটের দাম রাখছে ৪০০ টাকা।
লাচ্ছা সেমাই পরিবেশনের অবশ্যকীয় উপকরণ গুঁড়ো দুধের দাম এবার স্থিতিশীল দেখা গেছে। ডলারের বাজার স্বাভাবিক হওয়ায় এবং চাহিদার পুরোটাই আমদানি হওয়ায় কোনো কোনো কোম্পানির দুধের দাম আগের বছরের চেয়ে বরং কিছুটা কমেছে।
ট্রেডিং কপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি কেজি ডানো গুঁড়ো দুধ ঢাকার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭৪০ টাকা থেকে ৮৩০ টাকায়। আগের বছরে যা ৮০০ টাকা থেকে ৮২০ টাকা ছিল।
অন্যান্য ব্র্যান্ডের মধ্যে ফ্রেশ, মার্কস, ডিপ্লোমা গুঁড়ো দুধ বিক্রি হচ্ছে আগের বছরের চেয়ে অন্তত ১০ টাকা কমে।
সেমাইয়ের স্বাদ বাড়ানো কাজু বাদাম প্রতি কেজি ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মানভেদে কিসমিসের দাম কেজিপ্রতি ৭০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।
এছাড়া ১০০ গ্রাম এলাচ ৬০০ টাকা এবং ১০০ গ্রাম দারুচিনি ৬০-৭০ টাকায় মিলছে।