পুঁজিবাজারে খেলা চলছে এখনো: ইব্রাহিম খালেদ

পুঁজিবাজার তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের দাবি, কারসাজি চলছে এখনো। তার মতে, বাজার চাঙা করতে অর্থপ্রবাহ বাড়ানোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আস্থা ফিরিয়ে আনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Dec 2011, 07:17 AM
Updated : 29 Oct 2014, 01:47 PM

পুঁজিবাজারে ‘ভুল’ নির্দেশনায় চলছে বলেও মনে করেন তিনি। তার মতে, ব্যর্থতার দায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এসইসির হলেও সে দিকে সরকারের নজর কম।

কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খালেদ সোমবার পুঁজিবাজার বিষয়ক এক বৈঠকে বলেন, “বাজারে এখনো অনেক খেলা চলছে।”

“এখন দেশের শেয়ারবাজার ভুল নির্দেশনায় চলছে। সবাই বলছে, সমসা পুঁজির। তারল্য সঙ্কটের কথা বলে সরকার কিছু আড়াল করতে চাইছে, কিন্তু প্রকৃত সমস্যা হলো আস্থার সঙ্কট। ভুলভাবে সমস্যা চিহ্নিত করার কারণে কোনো উদ্যোগই সাফল্য আনতে পারছে না।”

গত বছরের শেষের দিকে পুঁজিবাজারে অস্থিরতা দেখা দিলে এই বছরের শুরুতে ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি কমিটি করে সরকার। ওই কমিটি কারসাজি হয়েছে মনে করে সে বিষয়ে আরো অনুসন্ধানের সুপারিশ করে।

ইব্রাহিম খালেদের কমিটির সুপারিশ বিভিন্ন মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন পুনর্গঠন করা হয়।

এরপর গত কয়েকমাসে পুঁজিবাজারে পুনরায় অস্থিরতা তৈরি হলে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ অবস্থা নিরসনের তাগিদ আসে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বৈঠক করেন বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। এরপর পুঁজিবাজার স্থিতিশীলে প্রণোদনামূলক পদক্ষেপও নেয় সরকার।

ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “যেই দেশে পুঁজিবাজার ঠিক করতে প্রধানমন্ত্রীকে চার ঘণ্টা বৈঠক করতে হয়, এটা লজ্জাজনক। প্রধানমন্ত্রী এসইসিকে বাঁচাতে চেয়েছেন। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার জন্যে এসইসিকে তো ফায়ার (বরখাস্ত) করা উচিত।”

তবে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সীমাবদ্ধতার কথাও বলেন সাবেক এ ডেপুটি গভর্নর। তার মতে, “এসইসি স্বাধীন নয়। এর ওপর অনেক চাপ আছে।”

ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “বাজারে যারা কারসাজি করে, তারাই আবার নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নিয়োগে হস্তক্ষেপ করে। ফলে এদের কাছ থেকে সঠিক কাজ পাওয়া যায় না। তাহলে কীভাবে মানুষ এই বাজারের ওপর আস্থা রাখবে?”

আগের প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “আমার রিপোর্ট প্রকাশের আগে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এই রিপোর্ট প্রকাশ করা যাবে না। কারণ এখানে অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তির নামা আছে। এটা তিনি কীভাবে বলেন? মন্ত্রীর চেয়েও কি তারা (কারসাজিতে অভিযুক্ত) ক্ষমতাবান?”

সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্যে বাজার বিকেন্দ্রীকরণের (ডিমিউচুয়্যালাইজেশন) পরামর্শ দিয়েছেন ইব্রাহিম খালেদ। তবে এতে বিভিন্ন মহল থেকে বাধা আসবে বলে মনে করছেন তিনি। “সরকারকে জোর করেই করতে হবে। কেউ কি আর নিজের ক্ষমতা ছাড়তে চায়?” বলেন তিনি।

সোমবার মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে ‘স্টেট অব দ্যা ক্যাপিটাল মার্কেট অ্যান্ড রিসেন্ট পলিসি ইনিশিয়েটিভ’ শীর্ষক ওই সংলাপ আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. মোহম্মদ ফরাসউদ্দিনও এসইসিকে দায়ী করে সংলাপে বলেন, “বাজারে অস্বাভাবিক উঠানামা হচ্ছে। ....এসইসির সার্ভেল্যান্স টিম কোথায়? বাজার দেখে মনে হয়, বাজারে এসইসির কোনো সার্ভেল্যান্স নেই।”

ইব্রাহিম খালেদের মতো এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকীও মনে করেন, সমস্যার কারণ তারল্য সঙ্কট নয়।

তিনি বলেন, “আসলে সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনার সমস্যাই দায়ী। এসইসি, ডিএসই, সিএসই, বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। বাজার ঠিক করতে আসলে যথাযথ ব্যবস্থাপনা নেওয়া হয়নি।”

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “সবাই ব্রোকারেজ হাউজের লাইসেন্স বাড়ানোর কথা বলছে। কিন্তু শুধু বাড়ালেই তো হবে না, এটি এসইসির নজরদারির মধ্যে থাকতে হবে। বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোই এসইসি ঠিকভাবে নজরদারি করতে পারছেন না। সুতরাং এই বিষয়টি ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

তবে পুঁজিবাজারের বর্তমান চিত্র মাসখানেকের মধ্যে পাল্টে যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজ বলেন, “ব্যাংক ক্লোজিং এর কারণে এখন বাজার কিছুটা মন্দা যাচ্ছে। তবে জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারি মাসের দিকে বাজার ভালো হতে পারে।”

বাজার স্থিতিশীল করতে সদ্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দেন তিনি।

বৈঠকে আরো বক্তব্য রাখেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি আল মারুফ খান, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি আহসানুল ইসলাম, এবিবি সভাপতি কে মাহমুদ সাত্তার প্রমুখ।

সিপিডির ডিস্টিংগুইজড ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানের গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাজার নিয়ন্ত্রক হিসাবে এসইসির দক্ষতার অভাব রয়েছে। এছাড়া সমন্বয়েল অভাব, বিও একাউন্টের স্বচ্ছতা না থাকা, এসইসির সঠিক বাজার নজরদারির অদক্ষতা ও কারিগরি অপ্রতুলতা বাজার অস্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলছে।

এতে আরো বলা হয়, দেশের পুঁজিবাজারে সুবিধাভোগী ব্যবসা (ইনসাইডার ট্রেডিং) প্রকাশ্য বিষয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো আচরণ বাজার অস্থিতিশীলতার অন্যতম কারণ।

শুধু তহবিল না বাড়িয়ে পুঁজিবাজারের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনাটাই জরুরি বলে মনে করেন ড. মোয়াজ্জেম। তবে তার চোখে সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ ধরা পড়ছে না।

সমস্যার সমাধানে সিপিডির সুপারিশ, এসইসিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সজাগ থাকতে হবে। এসইসির সার্ভেল্যান্স পদ্ধতি আরো কার্যকর করতে হবে। বিও একাউন্টের লেনদেন ব্যবস্থায় আরো স্বচ্ছতা আনতে হবে। ডিএসই ও এসইসির নিরীক্ষা পদ্ধতি ঢেলে সাজাতে হবে। কঠোর নজরদারির মাধ্যমে দ্রুত দুই স্টক এক্সচেঞ্জে ডি মিউচুয়ালাইজেশন কার্যকর করতে হবে।