সাম্প্রদায়িক সহিংসতা: দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই শুধু চান নোয়াখালীর হিন্দুরা

পুলিশ জানায়, এসব ঘটনায় ৩২টি মামলার মধ্যে তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে ২৪টির।

আবু নাছের মঞ্জু. নোয়াখালী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Oct 2022, 06:07 PM
Updated : 14 Oct 2022, 06:07 PM

এক বছর আগে শারদীয় দুর্গাপূজার সময় মন্দিরে-মন্দিরে হামলা, প্রাণহানীর ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিকেই প্রধান্য দিচ্ছেন নোয়াখালীর সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

তাদের মতে, হামলা-অগ্নিসংযোগের আর্থিক ক্ষতি হয়তো একসময় কাটিয়ে উঠা যাবে; কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি না করলে মনের ক্ষত সারিয়ে আতঙ্ক দূর করা যাবে না।

২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর জেলার বাণিজ্যিক শহর চৌমুহনীতে দূর্গাপূজার দশমীর দিন জুমার নামাজের পর একদল লোক মিছিল নিয়ে বিভিন্ন মন্দির, পূজামণ্ডপ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন। এ ঘটনায় দুইজন নিহতসহ অর্ধশতাধিক আহত হন।

সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলো অনেকটা মেরামত হলেও মনের ক্ষত শুকায়নি সনাতন ধর্মালম্বীদের।

জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এসব ঘটনায় দায়ের করা ৩২টি মামলার মধ্যে তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে ২৪ মামলার। বাকি মামলাগুলোর তদন্তও শেষ পর্যায়ে আছে।

কী ঘটেছিল সেদিন

২০২১ সালে কুমিল্লায় দুর্গা পূজার মণ্ডপ থেকে পবিত্র কোরআন শরিফ উদ্ধারের পর সারা দেশের মতো নোয়াখালীর বেগমগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নোয়াখালী জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভেকেট পাপ্পু সাহা জানান, চৌমুহনীতে শ্রীশ্রী ঠাকুর রামচন্দ্রদেবের সমাধিক্ষেত্র, রাধামাধব জিউর মন্দির কমপ্লেক্সে, ইসকন মন্দিরসহ সাতটি মন্দির, ছয়টি পূজা মণ্ডপ এবং আশপাশের ২০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ সময় বিজয়া সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরে যতন সাহা ও ইসকন মন্দিরে প্রান্ত চন্দ্র দাস নামে দুইজনের প্রাণহানিসহ আহত হন অর্ধশতাধিক লোক।

বিজয়া সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরের সাংগঠনিক সম্পাদক জয় ভূঁঞা জানান, সেদিন বিভিন্ন মন্দিরে হামলা ও লুটপাটের পাশাপাশি প্রতিমাগুলো ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, “মূল্যবান এসব প্রতিমা দেশে তৈরি হয় না, আমাদের পাশের দেশ ভারত থেকে আনতে হয়। আমরা এখন পর্যন্ত সেই প্রতিমাগুলো স্থাপন করতে পারিনি।”

ঘটনার দিন ঠাকুর রামচন্দ্রদেবের আশ্রমের প্রবেশমুখে তনু রায় চৌধুরীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘বধূয়া সাজ’-এ ভাঙচুর, লুটপাটের পর আগুন দেওয়া হয়েছিল।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তনু রায় চৌধুরী বলেন, “স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও আমরা এমন দৃশ্য দেখিনি। আমার এখানে তিনবার লুট করার পর চতুর্থবার আগুন দিয়ে সব ধ্বংস করে দিয়েছে। সেই হামলায় আমার ৫০ লাখ টাকার উপরে ক্ষতি হয়েছে। আমি ব্যাংক ঋণ দেনায় আছি। এবারও মানুষের কাছ থেকে ঋণ দিয়ে কিছু মাল তুলে ব্যবসাটা ধরে রেখেছি। দোকানটা খালি খালি লাগে সব সময়।”

রাধামাধব জিউর মন্দির কমপ্লেক্সের সহসভাপতি মধূসূধন দেবনাথ বলেন, “গত বছর তাণ্ডবটা যেটা হয়েছে। আমি বলবো, তাণ্ডবই। সেটা আমাদের মনে যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষত সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষত কিন্তু ভোলার মতো না। পাশাপাশি আমাদের যে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি, সেটা আমরা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারলেও পুরোপুরি পারিনি।

“আমি ৭১-এর যুদ্ধ দেখেছি, পরবর্তী সময়ে বাবরি মসজিদের গণ্ডগোলের সময় দেখেছি, কিন্তু এই চৌমুহনীতে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি।”

প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি

আকস্মিক এ তাণ্ডব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গায়ে যে ক্ষত সৃষ্টি করছে তা সেরে উঠতে সময় লাগবে বলে মনে করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। এই ক্ষত সারিয়ে তোলার জন্য ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শান্তি নিশ্চিত করা, ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং সবার সহযোগিতায় সম্প্রীতির পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।

এ ব্যাপারে রাধামাধব জিউর মন্দির কমপ্লেক্সের সহসভাপতি মধূসূধন দেবনাথ বলেন, “আমাদের একটাই দাবি, সরকার যেন নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এসব ঘটনায় যারা প্রকৃত দোষী তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিটা নিশ্চিত করে। তাহলে আমরা মনে করবো, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না।

“দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে অপরাধীদেরও বার্তা দেওয়া যাবে যে, তারা ঘটনা ঘটিয়ে পার পাবে না। আমরা যারা সংখ্যালঘু আছি, তারা একটু হলেও আশস্ত হবো যে, প্রকৃত অর্থে যারা দোষী তারা শাস্তিটা পাচ্ছে।”

শ্রীশ্রী ঠাকুর রামচন্দ্রদেবের আশ্রমের সদস্য রণজিৎ সাহা বলেন, “আমাদের এখানে আমরা হিন্দু-মুসলমান সবাই দীর্ঘদিন একসাথে থাকি। এই আশ্রমে যেকোনো উৎসব আমরা হিন্দুরা একা করি না। আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা আমাদের সার্বিকভাবে সহায়তা করেন।

“সেদিন এই চৌমুহনীতে যা দেখেছি, এর আগে আমরা তা কল্পনাও করতে পারিনি। সেদিন পুরো দেশটা যেন আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। আমরা তো এই বাংলাদেশ চাইনি। সেদিনের ঘটনা আমাদের হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ জন্ম দিয়েছে তা আমরা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি, কতটুকু পেরেছি জানি না। তবে, এখানকার অধিকাংশ মানুষই আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে বার্তা দিয়েছে যে, আমাদের কিছু হবে না।”

রণজিৎ সাহা আরও বলেন, “১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দুরা যখন ভারতে চলে যায় তখনও এই আশ্রমটা অনেকটা অরক্ষিত ছিল। কিন্তু তখনও এই আশ্রমের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে দেননি আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা। গত বছর ১৫ অক্টোবর এখানে একদল দুষ্কৃতকারী বা ধর্মান্ধ লোক যা ঘটিয়েছে সেটা আমরা চিন্তাই করতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, “আমরা মনে করি, আমাদের হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে যারা পরিকল্পিতভাবে নস্যাৎ করতে চেয়েছে তাদেরকে তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শান্তি না দিলে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটার সম্ভাবনা থেকে যাবে। সেইসঙ্গে সরকার আমাদের ঐতিহ্যবাহী এসব মন্দির, আশ্রমের যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দিবে বলে আমাদের বিশ্বাস।”

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভেকেট পাপ্পু সাহা বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ও আশ্রমগুলোকে সহায়তার জন্য সরকারিভাবে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকাটি এখন ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে আছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ হতবিল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এক একটি মন্দিরের জন্য এক থেকে চার লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদেরও প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ হতবিল থেকে এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে।”

সরকারের নানা পদক্ষেপ

জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জানান, চৌমুহনীতে সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে সরকারিভাবে কম-বেশি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকেও সহায়তা করা হয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে সহায়তার জন্য তালিকা তৈরি করা হয়েছে। বরাদ্দ হাতে পেলে তা বণ্টন করা হবে।

জেলা পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম জানান, নোয়াখালীর চৌমুহনীসহ বিভিন্ন থানা এলাকায় সম্প্রদায়িক ঘটনায় দায়ের করা ৩২টি মামলার মধ্যে পিবিআই ও সিআইডি ২২টি মামলার এবং ১০টি পুলিশ তদন্ত করেছে। এর মধ্যে ২৪টি মামলা তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে। 

এসব মামলায় এজাহারভুক্ত ১২৫ জন ও সন্দেহভাজন ৯৯ জনসহ সর্বমোট ৩২৪ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেপ্তার অনেক আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সবগুলো মামলা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের শান্তি নিশ্চিত করা হবে বলে জানান তিনি।

পুলিশ সুপার বলেন, কারা কী উদ্দেশ্যে এসব ঘটনা ঘটিয়েছে তদন্তে এ সংক্রান্ত অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ভবিষ্যতে আর কোনো স্বার্থন্বেষী মহল যেন এমন ঘটনা ঘটাতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

তিনি বলেন, “সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং আমাদের আগাম প্রস্তুতির কারণে নোয়াখালীতে এবারের দুর্গাপূজার শান্তি-শৃঙ্খলা ও উৎসমুখর পরিবেশ দেশব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।”

আরও পড়ুন

পূজামণ্ডপে তাণ্ডবের এক বছর, নোয়াখালীতে উৎসব এবার ‘কিছুটা বিবর্ণ’

ক্ষত ঢেকে নানুয়ার দিঘির পাড়ে ফিরেছে ‘উৎসবের আমেজ’

কুমিল্লা: মন্দিরে সংঘবদ্ধ হামলাকারীরা অচেনা, বলছেন স্থানীয়রা

গ্রেপ্তার ইকবালকে নেওয়া হয়েছে কুমিল্লায়

‘উসকানি’ দিয়ে মন্দিরে হামলা, আটক ৪৩

সাম্প্রদায়িক হামলা: নোয়াখালীতে গ্রেপ্তার আরও ৪, রিমান্ডে ৫

নোয়াখালীতে মন্দির-মণ্ডপে হামলা: ৩ আসামির ‘স্বীকারোক্তিমূলক’ জবানবন্দি

নোয়াখালীতে পূজামণ্ডপে দফায় দফায় হামলা-ভাংচুর, ১৪৪ ধারা