পূজামণ্ডপে তাণ্ডবের এক বছর, নোয়াখালীতে উৎসব এবার ‘কিছুটা বিবর্ণ’

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলো মেরামত করা হলেও শুকায়নি মনে দাগ কেটে বসা সেই ক্ষতগুলো।

আবু নাছের মঞ্জু. নোয়াখালী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2022, 07:48 PM
Updated : 30 Sept 2022, 07:48 PM

দর্গাপূজার মণ্ডপে তাণ্ডবের বছর ঘুরে আবার এসেছে শারদীয় এই উৎসবের ক্ষণ। বরাবর এই উৎসব ঘিরে নোয়াখালীর মণ্ডপগুলো বর্ণিল সাজের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। মাসখানেক ধরে চলে সাজসজ্জা। 

তবে এক বছর আগের সেই দিনের স্মৃতি উৎসবের রঙকে কিছুটা হলেও বিবর্ণ করেছে। 

সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলো মেরামত করা হলেও শুকায়নি মনে দাগ কেটে বসা সেই ক্ষতগুলো। 

তবে প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিরা যেকোনো মূল্যে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে মন্দিরে এবং চেতনায় উৎসবমুখরতা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। 

গত বছর দুর্গাপূজায় কুমিল্লায় মণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার কথা ছড়িয়ে পড়লে কুমিল্লা ছাড়াও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, হাতিয়া, চাটখিল উপজেলা, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। 

এ সময় হিন্দুদের মন্দির, আশ্রম, পূজামণ্ডপ, বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। 

নোয়াখালীর চৌমুহনীতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। 

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার শীল জানান, গত বছর নোয়াখালীতে ১৬৯টি মণ্ডপে প্রতিমা পূজা এবং ৬টি মণ্ডপে ঘটপূজা হয়। এর মধ্যে বাণিজ্যিক শহর চৌমুহনীতে ১১টি দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছিল। 

এবার জেলায় নতুন করে আরও ৬টি পূজামণ্ডপ বাড়িয়ে ১৭৫টি প্রতিমা পূজা এবং ৫টিতে ঘটপূজা হবে। চৌমুহনীসহ বেগমগঞ্জ উপজেলায় এবার ২৫টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হবে। 

নোয়াখালীতে দুর্গোৎসবকে ঘিরে ২/৩ মাস আগে থেকেই নানা সাজে সাজতে শুরু করে মণ্ডপগুলো। ভক্তদের দৃষ্টি কাড়তে তৈরি হয় দেশসেরা সাজসজ্জা ও প্রতিমা। দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও দৃষ্টিনন্দন দুর্গাপূজার মধ্যে নোয়াখালীর বাণিজ্যিক শহর চৌমুহনী ও জেলা শহর মাইজদীর নাম উল্লেখযোগ্য। 

গত বছর ১৫ অক্টোবর দশমীর দিন চৌহমুনীতে ১১টি পূজামণ্ডপ ও ৬টি মন্দিরে একযোগে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল। এছাড়া বেগমগঞ্জ উপজেলার ছয়ানীতে একটি পূজামণ্ডপ, একটি কালীমন্দির ও দুর্গাপুরে একটি পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়েছিল। 

চৌমুহনীর বিজয়া সার্বজনীন দুর্গামন্দিরের সাংগঠনিক সম্পাদক জয় ভূঞা জানান, ওই তাণ্ডবে দুজনের প্রাণহানিসহ লুটপাট করা হয় মন্দিরের অর্থ, ভাঙচুর করা হয় সব প্রতিমা। 

“মন্দিরগুলো মেরামত করা হলেও ভয়াভহ সেই তাণ্ডবের দুঃসহ স্মৃতি, মনের ক্ষত এখনও শুকায়নি। গত বছরের হামলার আতংক এবারের উৎসবের রঙকে করেছে কিছুটা বিবর্ণ। ভাটা পড়েছে জাঁকজমকপূর্ণ লাইটিং ও সাজসজ্জায়।” 

তবে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন উৎসবকে প্রণোচ্ছল করার পাশাপাশি নিরাপদ করার ব্যাপারেও তৎপরতা অব্যাহত রাখার কথা বলছে। 

জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, “নোয়াখালীর হাজার বছরের সাম্পদায়িক সম্পীতির ঐতিহ্যকে ধরণ করে এবাও উৎসবমুখর পরিবেশে শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপিত হবে। সার্বজনীন এই উৎসবে কোথাও যেন কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে না পারে সেজন্য একমাস আগে থেকে জেলা উপজেলায় পাড়ায় মহল্লায় সম্প্রীতি সভা করা হয়েছে।” 

জেলা পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, “আমাদের সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে এবারের দুর্গোৎসব ভিন্ন মাত্রা পাবে। পূজার আগে থেকে সম্প্রীতি সভা আয়োজন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আগাম পদক্ষেপ গ্রহণ, প্রতিটি পূজা মন্দির ও মণ্ডপে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি, সিনিয়র অফিসারদের নেতৃত্বে তদারকি টিম গঠন করা হয়েছে। কোথাও কোনো প্রকার অপ্রীতকর ঘটনা ঘটনামাত্র আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।” 

নোয়াখালী পৌরসভার মেয়র শহিদ উল্লাহ খান বলেন, “দুর্গাপূজায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় পৌরসভার পক্ষ থেকে সবগুলো মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও বিভিন্ন ধর্মের নেতাদের অংশগ্রহণে সম্প্রীতি সমাবেশ করা হয়েছে। সবাইকে সাথে নিয়ে আমরা যেকোনো মূল্যে অতীতের মতো এবারও আমাদের সম্প্রীতির ঐহিত্য রক্ষা করব।” 

সহিংসতার ৩২ মামলা, অভিযোগপত্র জমা ২৬টির 

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, হাতিয়া, চাটখিল উপজেলাসহ বিভিন্ন স্থানে সেদিন সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় হিন্দুদের মন্দির, আশ্রম, পূজামণ্ডপ, বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। 

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মাখন লাল দাস জানান, ২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর জুমার নামাজের পর বাজারের বিভিন্ন মসজিদ থেকে কয়েক হাজার মুসল্লি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বের হন। এক পর্যায়ে প্রধান সড়কের উত্তর পাশের শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারসহ হিন্দু ধর্মালম্বীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এক পর্যায়ে মিছিলকারীরা রামঠাকুর আশ্রম, রাধামাধব জিওর মন্দির, ইসকন মন্দিরসহ প্রায় ১১টি মন্দির ও মন্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। 

কলেজ রোড়ের বিজয়া দশমী পূজাণ্ডপে হামলার সময় যতন সাহা (৩২) নামে একজনের মৃত্যু হয়। পরদিন সকালে ইসকন মন্দিরের পুকুরে প্রান্ত চন্দ্র দাস (২০) নামে অপর একজনের মরদেহ ভেসে ওঠে। 

এছাড়া হামলার সময় বেগমগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি কামরুজ্জামান শিকদারসহ চার পুলিশ সদস্য এবং অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়। 

এর আগে ১৩ ও ১৪ অক্টোবর জেলার হাতিয়া, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুধারাম ও  সেনবাগ থানা এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন মন্দির ও বাড়িঘরে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। 

পুলিশের জেলা বিশেষ শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ডিআইও ওয়ান) মোস্তাফিজ ভূইয়া বলেন, জেলার বিভিন্ন স্থানে সম্প্রদায়িক ঘটনায় বিভিন্ন থানায় ৩২টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে বেগমগঞ্জ থানায় ১৫টি, হাতিয়া থানায় ১০টি, সেনবাগ থানায় একটি, সোনাইমুড়ী থানায় একটি, চাটখিল থানায় একটি, কোম্পানীগঞ্জ থানায় দুটি, কবিরহাট থানায় একটি ও সুধারাম থানায় একটি মামলা হয়। এসব মামলায় এজাহারে এক হাজার ছয় জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৯ হাজার ৯৫৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।  এসব মামলায় এজাহারভুক্ত ১২৫ ও সন্ধিগ্ধ ৯৯ জনসহ সর্বমোট ৩২৪ জনকে গ্রেপ্তার করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। 

মামলা সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) জেলা কার্যালয়ের ১১টি, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জেলা কার্যালয়ে ১১টি এবং জেলা গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) ১০টি মামলা হস্তান্তর করা হয়। পিবিআই জেলা কার্যালয় তাদের ১১টি মামলা, সিআইডি তাদের ১১টি মামলার মধ্যে ৬টি এবং ডিবি পুলিশ তাদের ১০টির মধ্যে ৯টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। 

জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পাপ্পু সাহা বলেন, বিভিন্ন মামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের কারাগারে থাকা বেশিরভাগ আসামি পরবর্তীতে জামিনে বেরিয়ে আসায় ভুক্তভোগীদের ভয় আতংক কাটছে না। 

“আমরা চাই নিরপরাধ লোকজনকে বাদ দিয়ে তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের যেন বিচারের আওতায় আনা হয়। প্রকৃত অপরাধীরা যদি বিচারের মাধ্যমে শাস্তি পায়; তাহলে আতংক কাটবে বলে আমি মনে করি।” 

জেলা পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, “সম্প্রদায়িক হামলার প্রতিটি মামলা সর্বোচ্চ গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। এসব মামলায় এরমধ্যে গ্রেপ্তার অনেক আসামি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। সবগুলো মামলা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের শান্তি নিশ্চিত করা হবে।”

আরও পড়ুন

Also Read: ক্ষত ঢেকে নানুয়ার দিঘির পাড়ে ফিরেছে ‘উৎসবের আমেজ’

Also Read: কুমিল্লা: মন্দিরে সংঘবদ্ধ হামলাকারীরা অচেনা, বলছেন স্থানীয়রা

Also Read: গ্রেপ্তার ইকবালকে নেওয়া হয়েছে কুমিল্লায়

Also Read: ‘উসকানি’ দিয়ে মন্দিরে হামলা, আটক ৪৩

Also Read: সাম্প্রদায়িক হামলা: নোয়াখালীতে গ্রেপ্তার আরও ৪, রিমান্ডে ৫

Also Read: নোয়াখালীতে মন্দির-মণ্ডপে হামলা: ৩ আসামির ‘স্বীকারোক্তিমূলক’ জবানবন্দি

Also Read: নোয়াখালীতে পূজামণ্ডপে দফায় দফায় হামলা-ভাংচুর, ১৪৪ ধারা