রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কেপিআই এলাকায় পাকা সীমানা প্রাচীরে ঘিরে স্থাপনা নির্মাণ করলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কিছু জানে না বলছে।
Published : 11 Feb 2023, 08:56 AM
পাবনার পাকশীতে হার্ডিঞ্জ সেতু এলাকায় রেলের জমিতে স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা হোটেল ও পিকনিক স্পট নির্মাণ করছেন কোনো অনুমতি ছাড়া।
এই এলাকায় রয়েছে লালন সেতু ও নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র।
এই স্থাপনা নির্মাণকারী মোক্তার হোসেন মুক্তি পাবনার পাকশী ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি। তিনি এই জমিতে স্থাপনা নির্মাণের কোনো অনুমতি নেননি বলে জানান।
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কেপিআই (কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন) এলাকায় পাকা সীমানা প্রাচীরে ঘিরে স্থাপনা নির্মাণ করলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কিছু জানে না বলছে।
পুলিশের ভাষ্য, ঘটনাস্থল রেলের জায়গা হওয়ায় পুলিশকে অবহিত না করলে তারা ‘স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে’ কাজ করতে পারে না।
‘কেপিআই নীতিমালা, ২০১৩’ এ ‘কেপিআই’-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে: কী পয়েন্ট ইনসটলেশন (কেপিআই) অর্থ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত কোনো প্রতিষ্ঠান/কারখানা/জনস্বার্থে ব্যবহৃত স্থাপনা যেগুলো দেশের যুদ্ধ সামর্থ্য অথবা জাতীয় অর্থনীতির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং যা ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশে যুদ্ধ কিংবা প্রতিরক্ষা সামর্থ্য বা জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পদ্মা নদীর উপর নির্মিত হার্ডিঞ্জ রেলওয়ে সেতু দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে রেল যোগাযোগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এর পাশেই অপর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা লালন শাহ সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলওয়ের পাকশী বিভাগের ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (স্টেট অফিসার) নুরুজ্জামান জানান, বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কারণে এলাকাটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় কেপিআই তালিকাভুক্ত করে নিরপত্তার নিশ্চিত করার নির্দেশনা রয়েছে।
হার্ডিঞ্জ সেতু এলাকায় গিয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, লালন শাহ সেতু ও হার্ডিঞ্জ সেতুর মাঝে অবস্থিত সড়ক বিভাগের পরিদর্শন বাংলোর পশ্চিম পাশের ফটকের সামনে বেশ কয়েকজন শ্রমিক ইট সিমেন্টের দেয়ালে পাকা সীমনা প্রাচীর তৈরিতে ব্যস্ত। ঝোলানো সাইনবোর্ডে লেখা ‘হার্ডিঞ্জ সেতু পিকনিক স্পট এন্ড লালন শাহ কফি শপ’। বিশাল এলাকা ঘিরে তৈরি হচ্ছে মঞ্চ, বসার ছাউনী, সিমেন্টের চেয়ার।
নির্মাণাধীন এসব স্থাপনায় ঢাকা পড়েছে সড়ক বিভাগের পরিদর্শন বাংলোর মূল ফটকও।
স্থানীয়রা জানান, বেশ কয়েক বছর আগে হার্ডিঞ্জ সেতুর নিচে টং ঘরের মতো খাবারের দোকান করেন মুক্তি। সেখানে ব্যবসা ভালো হওয়ায় কিছুদিন পর পরিসর বাড়িয়ে আধাপাকা দেয়াল ও টিনের চালে রেস্টুরেন্ট করে ব্যবসা করতে থাকেন। এখন কয়েকদিন ধরে পুরো এলাকা ঘিরে রিসোর্ট তৈরির কাজ করছেন।
প্রকাশ্যে তিনি জায়গা দখল করে এমন স্থাপনা গড়লেও পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলওয়ের পাকশী বিভাগের ভূসম্পত্তি বিভাগ এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
শ্রমিক ও স্থানীয়দের সঙ্গে রিসোর্ট নিয়ে কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হন মোক্তার হোসেন মুক্তি। নিজেকে সাবেক যুবলীগ নেতা ও রেলওয়ের ঠিকাদার পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন ‘জনস্বার্থে’ তিনি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট তৈরি করছেন।
এ বিষয়ে কোনো অনুমোদন না থাকার কথাও স্বীকারও করেন তিনি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতিদিন পাকশী হার্ডিঞ্জ সেতু, লালনশাহ সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটক আসে এখানে। পিকনিক মৌসুমে বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ আসেন এখানে। কিন্তু এখানে তাদের বসে সময় কাটানোর মতো ন্যূনতম ব্যবস্থাও নেই। টয়লেট, হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থা না থাকায় তারা ভোগান্তিতে পড়তেন।
“তাদের কথা চিন্তা করেই আমি এই হোটেল ও পিকনিক স্পট নির্মাণ করছি।”
রিসোর্ট নির্মাণে অনুমতি নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অনুমতি এখনও নেওয়া হয়নি। শীঘ্রই আবেদন করব।”
কেপিআই নিরাপত্তা নীতিমালা, ২০১৩ এর ৪.১১ উপধারায় বলা হয়েছে, কেপিআই এলাকায় কোনো অবৈধ স্থাপনা যাতে নির্মাণ না হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সজাগ থাকবে এবং এ ধরনের কোনো অবৈধ স্থাপনা বিদ্যমান থাকলে অথবা নির্মিত হলে তা উচ্ছেদের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। এর ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ দায়ী থাকবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাকশী বিভাগীয় রেলের এক কর্মচারী বলেন, রেলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই পিকনিক স্পট নির্মাণ করছেন মুক্তি। কেপিআই এলাকা হার্ডিঞ্জ সেতু ও লালন শাহ সেতুর বিশেষ নিরপত্তার দায়িত্ব পাকশী পুলিশ ফাঁড়ির। নির্মাণাধীন অবৈধ পিকনিক স্পট থেকে যার দূরত্ব ৫০ গজেরও কম।
পাকশী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, “মোক্তার হোসেন মুক্তি ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি। কিন্তু বর্তমানে তার কোনো দলীয় পদ-পদবী নেই। দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে কেউ আইন বহির্ভূত কাজ করলে আমরা তার দায়িত্ব নিতে রাজি নই।”
পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলওয়ের পাকশী বিভাগের ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা নুরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফেঅর ডটকমকে বলেন, হার্ডিঞ্জ সেতুর নিচে রেলের জায়গায় কোনো পিকনিক স্পট নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। হার্ডিঞ্জ সেতু দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
“এক্ষেত্রে আমাদের কোনো কর্মকর্তার গাফিলতি আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হবে।”
ঈশ্বরদী থানার ওসি অরবিন্দ সরকার বলেন, “হার্ডিঞ্জ সেতুর অবকাঠামোর নিরপত্তার বিষয়টি আমাদের পাকশী ফাঁড়ির সদস্যরা দেখভাল করেন। আর যেহেতু ওটা রেলের জায়গা তারা আমাদের অবহিত না করলে আমরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজ করতে পারি না। তবুও বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।”
এটি সম্পূর্ণভাবে রেলের ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তাদের এখতিয়ারভুক্ত; তবে নিরপত্তা নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক কোনো স্থাপনা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।