করতোয়ায় নৌকাডুবি: মা-বাবা হারা দীপুকে নিয়ে তদন্ত প্রধানের আবেগি পোস্ট

পোস্টের সবাই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দীপুর প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে সমব্যথী হন।

পঞ্চগড় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2022, 01:01 PM
Updated : 30 Sept 2022, 01:01 PM

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় মহালয়ার অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে হতাহতের মধ্যে শিশু দীপুর বাবা-মা আছেন।

করতোয়া নদীতে নৌকাডুবিতে দীপু বেঁচে ফিরলেও চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে মা-বাবাকে। ঘটনার পরদিন মা রূপালি রানীর (৩৬) মরদেহ উদ্ধার হলেও এখনও নিখোঁজ বাবা ভূপেন্দ্র নাথ বর্মণ (৪০)।

দীপুদের বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের হাতিডোবা-ছত্রশিকারপুর গ্রামে।

বৃহস্পতিবার চার বছর বয়সী শিশু দীপুকে কোলে নিয়ে সরকারি সহায়তা নিতে আসে স্থানীয় মাড়েয়া জংলিপীর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া বড় ভাই দীপন চন্দ্র বর্মণ। আরেক ভাই পরিতোষ চন্দ্র বর্মণ একই বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র।

সরকারি সহায়তা নিতে ভাইয়ের সঙ্গে আসা দীপুকে কোলে তোলে নেন সেখানে উপস্থিতি পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও তদন্ত কমিটির প্রধান দীপঙ্কর রায়। যিনি ফেইসবুকে ‘অথৈ আদিত্য’ নামে একটি আইডি চালান। দীপুকে নিয়ে দেওয়া তার ফেইসবুক পোস্ট বেশ সাড়া ফেলেছে।

তিনি লিখেছেন “দীপু আমার কোলে এসে সোজা আমার চোখের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকল। ও কী যেন বলতে চায়, ওর চোখ সারাক্ষণ কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আমার বুকের ভেতরে হু হু করে উঠল, গলার মধ্যে কীসের যেন দলা আটকে গেল, নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে!”

“আমার মনে হল, আমার কোলে থাকা ছোট্ট দীপু চিৎকার করে বলতে চায়, ‘এই তোমরা বড়োরা সবাই মিলে আমার বাবা-মাকে আমার কাছে থেকে সড়িয়ে রেখেছো‌... আমি কিচ্ছু চাই না...শুধু আমি আমার বাবা-মাকে ফেরত চাই...!'”

পোস্টের সব পাঠকই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দীপুর প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে সমব্যথী হন।

শহীদ নামে একজন লিখেছেন “দীপুর জন্য বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই প্রার্থনা দীপু যেন ভালো থাকে।”

ইয়াসমিন লতা নামে একজন লিখেছেন, “চোখে পানি এসে গেল। প্রতিটি সন্তান তাদের বাবা-মায়ের ভালোবাসার ছায়ায় নিশ্চিন্তে নিরাপদে থাক। দীপুর জন্য অনেক ভালোবাসা।”

আরেকজন লিখেছেন “সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া, সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত, ওম শান্তি শান্তি শান্তি অর্থাৎ সবাই যেন সুখী হয়, সকলে আরোগ্য লাভ করুক, সকলে অপরের মঙ্গলার্থে কাজ করুক, কশ্মিনকালেও যেন কেহ দুঃখ ভোগ না করেন। জগতের সকল প্রাণী শান্তি লাভ করুক।”

নিজের দেওয়া ফেইসবুক পোস্ট সম্পর্কে দীপঙ্কর রায় বলেন, “প্রশাসনের সরকারি একজন কর্মকর্তা হিসেবে ত্রাণ সহায়তা বিতরণের অনুষ্ঠানে গিয়ে দীপুদের ঘটনা জানতে পারি। আমরা তো এ সমাজেরই মানুষ। এজন্য অনেকের মত দীপু আমাকেও কিছুটা ভাবিয়েছে। সেই ভাবনা থেকেই পোস্টটি দিয়েছি। পাঠকরা বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন।”

মায়ের মরদেহ পেলেও বাবা যে আর বেঁচে নেই সেটা প্রায় নিশ্চিত ধরে নিয়ে দীপুর বড় ভাই দীপনের ভাষ্য- “আমাদের দেখে রাখবার আর তো কেউ থাকল না। এখন দীপু ও অন্য ভাইকে মানুষ করবো কীভাবে, আমিই পড়ালেখা করে বড় হব কীভাবে?”

গত রোববার মহালয়া উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নৌকায় করে বোদা উপজেলার বরদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন উৎসবে যোগ দিতে। দুপুরে মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় একটি নৌকা উল্টে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ডুবে যাওয়া নৌকাটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিল। কিছু মানুষ সাঁতরে তীরে ফিরতে পারলেও অনেকে নিখোঁজ থাকেন। ঘটনার পরপরই স্থানীয়রা নৌকা নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নামেন তল্লাশিতে। পরে কয়েকদিন ধরে লাশ উদ্ধার হতে থাকে। এখন পর্যন্ত ৬৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে ভূপেন্দ্র নাথ বর্মণ (৪০), পঞ্চগড় সদর উপজেলার কামাত-কাজলদিঘী ইউনিয়নের ঘাটিয়ার পাড়া গ্রামের শিশু জয়া রানী (৪) ও বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের সুরেন্দ্র নাথ বর্মন (৬৫) নিখোঁজ আছেন।

ঘটনার ষষ্ঠ দিনে শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টায় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা করতোয়ার নদীর বিভিন্ন স্থানে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। তবে বিকাল ৩টা পর্যন্ত কোনো লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।