বরিশালে এক প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনা ছাড়া বড় কোনো গোলযোগ কোথাও ঘটেনি। অবশ্য বিকালে কিছু সময়ের জন্য ভোটাদের ভুগিয়েছে বৃষ্টি। খুলনায় ভোট চলেছে শান্তিপূর্ণভাবেই।
Published : 12 Jun 2023, 04:34 PM
এক মেয়র প্রার্থীর উপর আকস্মিক হামলা, এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ এবং ইভিএমে ভোট দিতে বিলম্বের আলোচনার মধ্যে শেষ হল বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ।
সোমবার সকাল ৮টায় দুই নগরীর ৪১৫টি ভোটকেন্দ্রে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বরিশালে এক প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনা ছাড়া বড় কোনো গোলযোগ কোথাও ঘটেনি। অবশ্য বিকালে কিছু সময়ের জন্য ভোটাদের ভুগিয়েছে বৃষ্টি। খুলনায় ভোট চলেছে শান্তিপূর্ণভাবেই।
বিকাল ৪টার পরও যেসব কেন্দ্রের চৌহদ্দির মধ্যে ভোটার ছিল, তাদের ভোটগ্রহণ শেষ করেই কেন্দ্রভিত্তিক ফল ঘোষণা হবে।
পরে বরিশাল ও খুলনা শিল্পকলা মিলনায়তনে ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র থেকে বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করবেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা।
নির্বাচন কমিশন ধারণা করছে, বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪৫-৫০ শতাংশের মতো ভোট পড়তে পারে।
বরিশাল সিটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ (খোকন সেরনিয়াবাত) বলেছেন, শান্তিপূর্ণ এ ভোটে ফলাফল যাই হোক, তা তিনি মেনে নেবেন।
খুলনা সিটি করপোরেশনের নৌকার প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকও ফল মেনে নেওয়ার মানসিকতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন।
তবে দুই সিটিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরা ভোট নিয়ে অভিযোগ করেছেন।
তাদের মধ্যে বরিশালে ইসলামী আন্দোলনের মেয়র পদপ্রার্থী মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীমের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
খুলনায় ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী হাতপাখার ভোট নৌকায় পড়ার অভিযোগ করেছেন। বরিশালে জাতীয় পার্টির এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন।
তবে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেছেন, “বরিশালের একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা ছাড়া খুব সুন্দর ভোট হয়েছে। সবখানে শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। আমরা আশা করি, ৫০% এর কম বেশি ভোট পড়বে খুলনা ও বরিশালে।”
দু্ই সিটি ছাড়াও কক্সবাজার পৌরসভা ও নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায়ও ইভিএমে ভোট হয়। কক্সবাজারে সর্বোচ্চ ৬০% ভোট পড়ার আশা ইসির।
গাজীপুরের মতই বরিশাল ও খুলনার কেন্দ্রে কেন্দ্রে বসানো হয় সিসি ক্যামেরা, যার মাধ্যমে ঢাকায় বসে সরাসরি ভোটের পরিস্থিতিতে নজর রাখে নির্বাচন কমিশন।
বিএনপি ভোটে অংশ না নিলেও ২৫ মে গাজীপুর সিটি নির্বাচন জমিয়ে দিয়েছিলেন এক স্বতন্ত্র প্রার্থী; তারপরও ভোটের হার ছিল ৪৮ শতাংশ।
সেই তুলনায় অনেকটাই নিরুত্তাপ বরিশাল ও খুলনার এবারের নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতিই বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছিলেন।
সবশেষ তিন নির্বাচনে বরিশালে ২০০৮ সালে ৮১.৯৯%; ২০১৩ সালে ৭২.১% , ২০১৮ সালে ৫৫% ভোটগ্রহণ হয়েছিল।
খুলনায় ২০০৮ সালে ভোট পড়েছিল ৭৭.৮০%, ২০১৩ সালে ৬৮. ৭০% ও ২০১৮ সালে প্রায় ৬২%।
পাঁচ বছর আগে এই দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের চিত্র ছিল অনেকটাই ভিন্ন। গোলযোগ, অনিয়ম, এজেন্টদের মারধর ও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ছিল ভোটের দিন। এবার তেমন গণ্ডগোল ঘটেনি।
দুই নগরেই মেয়র পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
বরিশালে মেয়র পদে ৭ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১১৫ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৪২ জন লড়ছেন।
খুলনা সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে ৫ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৩৬ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৯ জন লড়ছেন।
বরিশালে প্রার্থী যারা
মো. আলী হোসেন হাওলাদার (স্বতন্ত্র, হরিণ)
মিজানুর রহমান বাচ্চু (জাকের পাটি, গোলাপফুল)
আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ (আওয়ামী লীগ, নৌকা)
মো. ইকবাল হোসেন (জাতীয় পার্টি, লাঙ্গল)
মো. আসাদুজ্জামান (স্বতন্ত্র, হাতি)
মো. কামরুল আহসান (স্বতন্ত্র, টেবিল ঘড়ি)
মুফতী সৈয়দ মো. ফয়জুল করিম (ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হাত পাখা)
>> পদ: মেয়র একজন, ৩০ জন সাধারণ কাউন্সিলর, ১০ জন সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর
>> ভোটার: ২ লাখ ৭৬ হাজার ২৯৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৮৯ জন এবং নারী ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮০৯ জন।
>> কেন্দ্র/কক্ষ: ভোটকেন্দ্র ১২৬ ও ভোটকক্ষ ৮৯৪টি।
>> রিটার্নিং কর্মকর্তা: ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির।
খুলনায় মেয়র প্রার্থী যারা
মো. আ. আউয়াল (ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হাত পাখা)
মো. শফিকুল ইসলাম মধু (জাতীয় পাটি, লাঙ্গল)
তালুকদার আব্দুল খালেক (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, নৌকা)
এস এম শফিকুর রহমান (স্বতন্ত্র, টেবিল ঘড়ি)
এস এম সাব্বির হোসেন (জাকের পার্টি, গোলাপ ফুল)
>> পদ: একজন মেয়র, ৩১ জন সাধারণ কাউন্সিলর এবং ১০ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর।
>> ভোটার: ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ জন। পুরুষ ২ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩৩ জন; নারী ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯৬ জন।
>> কেন্দ্র/কক্ষ: ভোটকেন্দ্র ২৮৯টি; ভোটকক্ষ ১৭৩২টি।
>> রিটার্নিং কর্মকর্তা: ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দীন।
বরিশালে হঠাৎ উত্তেজনা
সকাল থেকে খুলনা ও বরিশালে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট হচ্ছিল। এর মধ্যে বরিশালে হঠাৎ তৈরি হয় উত্তেজনা।
নগরীর ছাবেরা খাতুন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার পর হাতেম আলী কলেজ চৌমাথার কাছে হাতপাখা মার্কার প্রার্থী ফয়জুল করীমের গায়ে হাত তোলার অভিযোগ উঠে।
ফয়জুল করীম বলেন, ৩০-৪০ জন ‘নৌকা সমর্থক’ অতর্কিতভাবে এই হামলা চালায়। ঘুষিতে তার মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায়।
“আমাদের ঘিরে হঠাৎ কী নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু করল, ফট করে দেখি আমাকে ঘুষি দেওয়া শুরু করছে। কীসের আমার উপর হামলা, আমি নিজের লোকদের তখন সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে দিয়েছি। আমি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ওদের পতন ঘটিয়ে মাঠ থেকে বিদায় হব।”
এ নিয়ে মামলা করবেন জানিয়ে হাতপাখার প্রার্থী বলেন, “নির্বাচন শেষ হোক। আমি যেহেতু রক্ত ঝরিয়েছি। আওয়ামী লীগের পতন হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি রাজপথ ছাড়ব না।”
বরিশার মহানগর পুলিশের কমিশনার সাইফুল ইসলাম এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “প্রার্থীর ওপর হামলার অভিযোগ পেয়েছি। কে বা কারা এই হামলা করেছে; উনার দাঁত ফেটে রক্ত বেরিয়েছে। সব জায়গায় সিসি ক্যামেরা আছে, আমরা তাদের বের করে ফেলব।
“প্রার্থীর ওপর যেই হামলা করে থাকুক তার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গ্রেপ্তার করা হবে।”
পরে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, “আকস্মিক ঘটনা ছাড়া সবকিছু সুন্দর। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কখনোই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। কিন্তু একটা সিচুয়েশনের মধ্যে হঠাৎ করে একজন প্রার্থীর গায়ে হাত তুলেছে বলে আমরা জেনেছি।
“যারা যারা এটার সঙ্গে জড়িত, তদন্তপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক… প্রথমে গ্রেপ্তার, তারপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
এদিকে ফয়জুল করীমের ওপর হামলার পর বিক্ষুব্ধ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাকর্মীরা বিকালে লাঠিসোঁটা হাতে মিছিল নিয়ে নগরীতে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দিয়ে থামিয়ে দেয়।
বরিশাল বন্দর থানার ওসি আসাদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুপুরের পর তারা জড়ো হয়েছিলেন। পরে তাদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।”
চরমোনাই পীরের সমর্থকরা হামলার পর বরিশাল নগরীতে ঢোকার চেষ্টা করছে, বিষয়টি নজরে আনলে ঢাকায় নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলেন, “এই ঘটনা ম্যানেজ করে প্রতিহত করা হয়েছে।”
ফয়জুল করীমের ওপর হামলায় আওয়ামী লীগ কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে খোকন সেরনিয়াবাতের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আফজালুল করিম বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “একজন প্রার্থী রক্তাক্ত হয়েছেন এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আমরা শুনেছি যেটা, সেখানে তাদের ভেতরে হঠাৎ করে অরাজকতা। আমার মনে হয়, তাদের সুপরিকল্পিত কোনো পরিকল্পনা থাকতে পারে শহরের ভেতরে অরাজকতা সৃষ্টি করতে। আমাদের দিক থেকে তাদের সঙ্গে কোনো বৈরিতা নেই, ছিল না, থাকবেও না।”
এ ধরনের অভিযোগকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে তারা নানানভাবে মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে আসছে। নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে তাদের কোনো ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।”
বিকালে হাতপাখা সমর্থকদের শহরে প্রবেশের চেষ্টার ঘটনা ধরে আওয়ামী লীগ নেতা আফজালুর রহমান বলেন, “সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন চলাকালীন সময়ে কিভাবে তারা লাঠি, রামদা, অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়?
“আমরা মনে করি, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে ব্যাহত করার জন্য তারা এভাবে করছে। শহরের বাইরের লোকজন মিছিল সহকারে শহরের ভেতরে ঢুকছে। আমাদের বহিরাগত থাকলে নির্বাচন আইনে তাদের আইনের আওতায় আনা হত।”