খুলনা মেডিকেলে শয্যা ও জনবল সঙ্কট, ভোগান্তি চরমে

আরও ১ হাজার ৬৮টি শয্যা বৃদ্ধির প্রস্তাবনা ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলে জানান হাসপাতালের পরিচালক।

শুভ্র শচীনখুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Nov 2022, 08:00 AM
Updated : 29 Nov 2022, 08:00 AM

শয্যা, চিকিৎসক, চিকিৎসা সরঞ্জামের অপ্রতুলতাসহ নানা সঙ্কটে জর্জরিত খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঋতু পরিবর্তনের এইসময়ে রোগীর চাপ বাড়ায় ভোগান্তি চরমে উঠেছে সেবাপ্রার্থীদের। 

দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ মানুষের চিকিৎসার অন্যতম ভরসাস্থল এই হাসপাতালে সারাবছরই রোগীর চাপ থাকে। শয্যাসংকটের কারণে বারান্দার মেঝেতে রেখে রোগীদের চিকিৎসা নিতে হলেও এখন তাতেও সংকুলান হচ্ছে না। 

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. রবিউল হাসান বলেন, ৫০০ শয্যার হাসপাতালে ভর্তি থাকা প্রায় এক হাজার ৫০০ রোগীর পাশাপাশি বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই হাজার রোগীর চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়েই অনেক রোগীকে মেঝেতে রাখতে হচ্ছে। 

সোমবার সকালে সরেজমিনে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠতেই দেখা যায়, বারান্দার ফ্লোরের দু’ পাশে পাটি, কাঁথা-বালিশ বিছিয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ও তাদের স্বজনসহ অসংখ্য মানুষ-শুয়ে বসে রয়েছেন। সেখানেই চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন রোগীরা। গ্রহণ করছেন ওষুধ-পথ্য ও খাবার। 

মাঝখানের এক-দেড় ফুট খালি জায়গা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন রোগীর স্বজন ও হাসপাতালের লোকজন। এতে ধুলা উড়ে রোগীদের নাক, মুখ, চোখ ও খাবারের মধ্যে যাচ্ছে। 

একই অবস্থা দেখা যায় মেডিসিন ওয়ার্ডের পাঁচটি ইউনিটের বারান্দা, সার্জারি ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে, ২, ৩ ও ৪ তলায় লিফটের সামনে, ব্লাড ব্যাংকের সামনের বারান্দা, চিকিৎসকদের কক্ষের সামনের মেঝেতেও। 

হাসপাতালের রোগীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে ভোগান্তির নানা চিত্র। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না। 

দ্বিতীয় তলার বারান্দার ফ্লোরে থাকা খুলনার পাইকগাছার সোলাদানা থেকে আসা শুকুর আলী বিশ্বাস বলেন, হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে শয্যা নেই। তাই শ্বাসকষ্ট নিয়ে বাধ্য হয়ে গত ১০ দিন ধরে হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতেই আছি। 

তিনি আরো বলেন, ডাক্তার দুটি টেস্ট করতে বলেছিলেন, একটি টেস্ট এখান থেকে করাতে পেরেছি। আরেকটি বাইরের ক্লিনিক থেকে করতে হয়েছে। 

ক্ষোভ প্রকাশ করে শুকুর বলেন, প্যাথলজি বিভাগে পরীক্ষার জন্য স্যাম্পল দিতে ভোর থেকে দীর্ঘলাইন পড়ে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে স্যাম্পল সংগ্রহ। স্বল্প এইসময়ে স্যাম্পল দিতে পারেন না লাইনে থাকা এক তৃতীয়াংশ রোগী। এতে বাধ্য হয়ে বাইরে বাড়তি খরচে পরীক্ষা করাতে হয়। 

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলজিস্ট ডা. মো. নিয়াজ নওশেদ জানান, মূলত যন্ত্রপাতি কম, কিছু মেশিন নষ্ট, পরীক্ষার কিট ও জনবল সংকটের কারণে সব পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। 

হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা দুই রোগীর অভিযোগ, দিনে মাত্র একবার ডাক্তার দেখতে আসেন। জরুরি প্রয়োজনে ডাকলে ইন্টার্ন চিকিৎসক বা নার্স আসেন। ডাকলে তারাও বিরক্ত হন। হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে রয়েছে দালালচক্রের অত্যাচার। হাসপাতালের খাবারের মানও তেমন ভাল নয়। রোগীর জরুরি অস্ত্রপচারের জন্যও অপেক্ষা করতে হচ্ছে দিনের পর দিন। 

বহির্বিভাগে অপেক্ষমাণ খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার বালিয়াঙ্গা থেকে আসা স্বপ্না খাতুন বলেন, তার মেয়ের পেটে ব্যথা হওয়ায় ডাক্তার দেখাতে এসেছেন। টিকিট কেটে প্রায় আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন, কিন্তু এখনও তার সিরিয়াল আসেনি। 

এসব সঙ্কট ও অভিযোগ নিয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. রবিউল হাসান বলেন, আমাদের প্রয়োজনীয় জনবল নেই। ৫০০ শয্যা অনুযায়ী হাসপাতালের জনবল কাঠামো। চিকিৎসকের ২৮৮টি পদের মধ্যে ৯২টি পদ খালি। অন্যান্য পদ শূন্য রয়েছে ৪৩টি। দুটি অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন টেবিল রয়েছে আটটি। 

খাবার ও ওষুধের সঙ্কট নিয়ে তিনি বলেন, ভর্তি সব রোগীকে হাসপাতালের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় খাবার দেওয়া সম্ভব হলেও ৫০০ শয্যার জন্য বরাদ্দ ওষুধ বাধ্য হয়ে দেড় হাজার রোগীকে দিতে হচ্ছে। 

তবে আরও ১ হাজার ৬৮টি শয্যা বৃদ্ধির প্রস্তাবনা ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলেন রবিউল।

খুলনা সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বলেন, হাসপাতালে এখন এসময়ে রোগীর সংখ্যা এমনিতেই বেশি। চিকিৎসকরা উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দিচ্ছেন। 

তিনি বলেন, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দালালদের নিয়ন্ত্রণের জন্য আনসার সদস্যদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জনবল সংকট থাকায় তদারকি করা হচ্ছে না। তবে দালাল নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। 

খুলনা অঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা নাগরিক সংগঠন বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, ১৯৮৮ সালে খুলনা নগরীর বয়রা এলাকায় প্রতিষ্ঠিত ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালটি ১৯৯৬ সালে মেডিকেল কলেজে পরিণত হয়। তখন নাম পরিবর্তন হয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়। ২০০৮ সালে তা ৫০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত হয়। 

আশরাফ বলেন, শয্যা সংখ্যা ৫০০ থাকলেও বর্তমানে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকছে প্রায় ১৫০০। এ অবস্থায় সক্ষমতার তিনগুণ এসব রোগীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না। এতে চিকিৎসকরা যেমন বিপাকে পড়েছেন, তেমনই দুর্ভোগ ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন রোগী ও তার স্বজনরা। 

হাসপাতালে শয্যা বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো জরুরি বলেন আশরাফ।