“আমরা একেবারে পথে বসে গেছি। এখন আমরা কী করবো? আমার ছেলে গেলো, সঙ্গে আমাদের সব শেষ হয়ে গেলো।”
Published : 17 Feb 2024, 11:55 AM
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে মারা যাওয়ার খবর পাওয়ায় মাদারীপুরের তিন যুবকের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। ছেলে হারানোর শোকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঋণ পরিশোধের দুশ্চিন্তা।
শুক্রবার দুপুরে মৃত্যুর খবর আসা ওই তিন যুবকের মধ্যে একজন সদর উপজেলার এবং অন্য দুজন রাজৈর উপজেলার বাসিন্দা।
তারা হলেন, সদর উপজেলার পাঁচখোলা ইউনিয়নের পশ্চিম পাঁচখোলা গ্রামের আলী আকাব্বরের ছেলে সম্রাট (২৫), রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২১) ও সেনদিয়া গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২৫)।
এছাড়া এখনো নিখোঁজ রয়েছেন গোপালগঞ্জের মকসুদপুর উপজেলার গোহালা ইউনিয়নের পান্নু শেখের ছেলে আপন শেখ।
শুক্রবার দুপুরে ওই তিন যুবকের মৃত্যুর খবর আসলে এলাকা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। স্বজন-প্রতিবেশীরা জানান, এমনিতেই আদরের সন্তানদের হারিয়ে দিশেহারা পরিবারগুলো। তার ওপর ব্যাংক ঋণ ও সুদে এনে দালালদের দেওয়া টাকা পরিশোধ করা নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।
নিহত সজল বৈরাগীর বাবা সুনীল বৈরাগী বলেন, “নৌকা ডুবিতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া একজন ফোন করে মামুন ও আমার ছেলে সজলের মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।”
তিনি বলেন, “জমি, গরু বিক্রি করে, লোন করে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছেলেকে ইতালি যাওয়ার জন্য পাঠাই। কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্ন সত্যি হলো না। সব স্বপ্ন সাগরে শেষ হয়ে গেলো।
“আমরা একেবারে পথে বসে গেছি। এখন আমরা কী করবো? আমার ছেলে গেলো, সঙ্গে আমাদের সব শেষ হয়ে গেলো। এ ঘটনায় আমরা দালাল মোশারফ কাজীর কঠিন বিচার চাই।”
নিহত দুই যুবকের স্বজনরা জানান, গত ১৪ জানুয়ারি মামুন শেখ ও সজল বৈরাগীসহ বেশ কয়েকজন যুবক ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়। দালালরা তাদের লিবিয়া নিয়ে রাখে।
পরে বুধবার লিবিয়া থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় রওনা দেয় তারা। ৩২ জন ধারণ ক্ষমতার নৌকাটিতে ৫২ জন অভিবাসন প্রত্যাশীকে তুলে দেয় দালালরা। পথে ভূমধ্যসাগরে তিউনিসিয়ার জলসীমানায় থাকা অবস্থায় নৌকাটির ইঞ্জিন ফেটে যায়। এতে মামুন ও সজলসহ বেশ কয়েকজন মারা যান।
খবর পেয়ে বেশ কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টগার্ড। এ ঘটনায় গোপালগঞ্জের আপন শেখ এখনো নিখোঁজ।
নিহত মামুন শেখের বড় ভাই সজীব শেখ বলেন, “গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের সুন্দরদী গ্রামের বাদশা কাজীর ছেলে মোশারফ কাজী মানব পাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য।
“তিনি প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৩-১৫ লাখ টাকা নেন। পরে ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রীবোঝাই করে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে পাঠালে এই দুর্ঘটনা ঘটে। ”
“আমি সরকারিভাবে আমার ভাইয়ের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা এবং দালাল মোশারফ কাজীর শাস্তির দাবি করছি,” যোগ করেন সজীব শেখ।
এদিকে সদরের বাসিন্দা সম্রাটের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় পাঁচ মাস আগে মাদারীপুরের রাশেদ খান নামে এক দালালের মাধ্যমে ৭ লাখ টাকার বিনিময়ে সম্রাট ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পাড়ি দিয়েছিল ইতালির পথে।
কিন্তু রাশেদ খান ঢাকা থেকে সম্রাট লিবিয়ায় নিয়ে একটি বন্দী শিবিরে আটকে রাখে। সেখানে তার ওপর চালানো হয় নির্যাতন, ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হতো না। এরপর শুক্রবার হঠাৎ করেই খবর আসে সম্রাট মারা গেছেন।
সম্রাটের ভাই আজগর বলেন, “কতগুলো টাকা খরচ করে ভাইকে বিদেশ পাঠিয়েছি। এখন আমার ভাই নাই। সে মারা গেছে। এখন টাকাও গেলো, ভাইও গেলো।
“আমরা এর বিচার চাই, দালালরা আমার ভাইকে মেরে ফেলছে। এখন আমরা কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।”
স্বজনদের অভিযোগ, রাশেদ খান ও তার ভাই টুলু লোকজনকে প্রলোভন দেখিয়ে ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে নির্যাতন করে। তার বিরুদ্ধে মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে একাধিক মামলা রয়েছে।
তবে অভিযুক্ত দালাল মোশারফ কাজী লিবিয়ায় থাকায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তার ছেলে যুবরাজ কাজীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।
এছাড়া আত্মগোপনে থাকায় দালাল রাশেদ খান ও টুলু খানদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
মাদারীপুরের রাজৈর থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান হাওলাদার আসাদ ও সদর থানার ওসি এএইচএম সালাউদ্দিন জানান, ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।