সিলেটে ট্রাক-পিকআপ সংঘর্ষ: ছেলের জন্য পাত্রী দেখে রেখেছিলেন সৌরভের মা

বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হতাহতদের স্বজনের ভীড় বাড়তে থাকে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

বাপ্পা মৈত্রসিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2023, 09:15 AM
Updated : 7 June 2023, 09:15 AM

এক সপ্তাহ আগে বেড়ানোর কথা বলে সুনামগঞ্জের দিরাই থেকে সিলেটে এসেছিলেন সৌরভ মিয়া। পরে বাড়ির লোকদের না জানিয়েই পরিচিতদের সঙ্গে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে লেগে যান। এ দিকে বাড়িতে তার বিয়ের জন্য পাত্রী পছন্দ করে রেখেছিলেন মা আমিনা বেগম। 

তাই ট্রাকের সঙ্গে পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে ছেলে সৌরভের (২৭) মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না আমিনা বেগম। 

ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে স্বামী সিরাজ মিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে আসা আমিনা বেগম বুধবার সাড়ে ১২-টার দিকে কান্নাজনিত কণ্ঠে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার পুতরে (ছেলে) বিয়া কারইতে আসলাম, মেয়ে দেখি রাখছিলাম গো। আমার পুতের কিতা হইল, তোমরা আমার পুতরে আনি দেও।’’ 

শোকাহত এই মায়ের কান্না-আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে সিলেটের ওসমানী হাসপাতালের পরিবেশ। তাকে ধরে রাখা স্বজনরাও সৌরভের বিভিন্ন কথা বলে-বলে কান্না করছেন। পাশে বসেই কান্না করছেন সিরাজ মিয়াও। 

সিরাজ মিয়া ও আমিনা বেগমের বাড়ি দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে। তাদের ছেলে সৌরভ মিয়া বেড়াতে এসে সিলেট নগরীর আম্বরখানা এলাকায় পরিচিতদের সঙ্গে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। 

অন্য দিনের মতো বুধবার ভোরে উঠে ওসমানীনগরের গোয়ালাবাজারে যাওয়ার জন্য পিকআপে উঠেন সৌরভসহ ৩০ জন নির্মাণশ্রমিক। 

পথে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে দক্ষিণ সুরমায় নাজিরবাজার এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মালবাহী একটি ট্রাকের সঙ্গে তাদের বহনকারী পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে সৌরভসহ ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ১০-১২ জন।

বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হতাহতদের স্বজনের ভীড় বাড়তে থাকে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তাই আমিনা বেগমের আশে-পাশে আরও অনেকে কান্নায়-আহাজারিতে স্বজন হারানোর শোক জানাচ্ছেন। 

হাফিজা বেগম নামে আরেক নারী জানান, রাত ৪টার দিয়ে তার মেয়ের জামাই মেহের বাসা থেকে কাজের জন্য বের হয়ে আসে। তিনি নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। 

পরে মেহেররে সঙ্গে থাকা লোকজনের মাধ্যমে খবর পান সড়ক র্দুঘটনায় আহত মেহেরকে ওসমানী হাসপাতালে আনা হয়েছে। হাসপাতালে এসে জানতে পারেন মেহের মারা গেছে। 

তিনিও কান্না জানিত কণ্ঠে বলতে থাকেন- এখন তার মেয়ের কি হবে। কারা দেখবে তাদের, এ কথা বলতে বলতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। তখন পাশে থাকা আরেক নারী হাফিজা বেগমকে ধরে রাখেন।   

হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন দুর্ঘটনায় আহত পাপ্পু দাস। তার ভাষ্য, “ভোরে নগরীর আম্বরখান পয়েন্ট থেকে আমরা প্রায় ২৮ থেকে ৩০ জন নির্মাণ শ্রমিক গোয়ালাবাজার যাওয়া জন্য রওনা হয়েছিলাম। পথে বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকটি আমাদের পিকআপকে ধাক্কা দিয়ে উল্টো ফেলে দেয়। 

“এতে ঘটনাস্থলেই এক নারী শ্রমিকসহ কয়েকজন মারা যান। পরে পুলিশ গিয়ে আমাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। আমার পা ও মাথায় আঘাত পেয়েছি।’’  

একই বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন নির্মাণ শ্রমিকের সর্দার শের ইসলাম। 

তিনি বলেন, “ভোরে নগরীর আম্বরখান পয়েন্ট থেকে আমার প্রায় ২৮ থেকে ৩০ জন নির্মাণ শ্রমিক নিয়ে গোয়ালাবাজার যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলাম। পথের মধ্যে ট্রাকটি এসে সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।” 

পরে তিনি আর কান্নায় কথা বলতে পারেননি। এ সময় তার পরিবারের সদস্যরাও কথা বলতে নিষেধ করেন। দুর্ঘটনায় শের ইসলাম তার ভাইকেও হারিয়েছেন। 

কোমরে আঘাত পেয়ে চিকিৎসাধীন শাকিল আহমদ নামে আরেক শ্রমিক জানান, মেডিকেল আসার পর তার জ্ঞান ফিরেছে। 

মাথা পায়ে আঘাত পাওয়া মিজানুর রহমান জানান, পিকআপে বেশি মানুষ থাকায় কিভাবে কি হল বুঝে উঠতে পারেননি। হাসপাতালে এসে জ্ঞান ফিরেছে তার।  

আহত আরেক শ্রমিক জয় বলেন, “আমি শুধু দেখেছি গাড়ি এদিক-ওদিক যাচ্ছে; পরে আর কিছুই বলতে পারি না। হাসপাতালে এসে আমার জ্ঞান ফিরেছে।” 

দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি মো. শামসুদ্দোহা বলেন, বুধবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মালবাহী একটি ট্রাকের সঙ্গে নির্মাণ শ্রমিকদের বহনকারী পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই ১১ জনের মৃত্যু হয়।

দুর্ঘটনায় খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ৮ জনকে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।

হাসপাতালে ভর্তির পর আরও তিনজনের মৃত্যু হয় বলে ওসমানী মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক জুয়েল আহমেদ চৌধুরী জানান।