বরিশাল সিটি ভোট: বিএনপি নেতাদের শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা

আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে দলটির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব ভাবনার কথা জানা গেছে।

সাইদ মেমনবরিশাল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 May 2023, 03:28 AM
Updated : 7 May 2023, 03:28 AM

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দলের কেউ যদি এ সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নেন, তাহলে নিয়ম অনুযায়ী তাকে বহিষ্কার করা হবে। এ অবস্থায় শ্যাম রাখি না কুল রাখি পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন বরিশাল মহানগরীর অন্তত দেড় ডজন নেতা। 

একদিকে নির্বাচনে জিতে কাউন্সিলর হওয়ার সম্ভাবনা, অন্যদিকে নিশ্চিত বহিষ্কারাদেশ। কোন পথ বেছে নেওয়া রাজনীতিক হিসেবে যথাযথ হবে সেটিই এখন ভাবাচ্ছে তাদের। 

আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে দলটির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব ভাবনার কথা জানা গেছে। এসব নেতাদের মধ্যে রয়েছেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে থাকা নেতা থেকে শুরু করে সহযোগী সংগঠনের পদধারী নেতাও। 

জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক হাফিজউদ্দিন আহমেদ বাবলু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৩০টি সাধারণ ও ১০টি সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো শক্ত প্রার্থী বিএনপিতে রয়েছেন। এদের মধ্যে দেড় ডজন নেতা-নেত্রী রয়েছেন যারা একাধিকবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন।” 

এদের মধ্যে রয়েছেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জাহিদুল কবির জাহিদের মতো নেতা যিনি ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে চারবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছে। একাধিকবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে দলের যুগ্ম আহবায়ক আলতাফ মাহমুদ সিকদার, জিয়াউদ্দিন সিকদার কেএম শহীদুল্লাহসহ অনেকের। 

দলটির শক্ত প্রার্থী হিসেবে ভোটের আলোচনায় উঠে এসেছে বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতার নাম। তবে দলের সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই তাদের। 

এ বিষয়ে হাফিজউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, “দলের সিদ্ধান্ত হলো, বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এ সিদ্ধান্ত কেউ অমান্য করলে তাদের বহিষ্কার করা হবে।” 

তবে দল অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিলেও নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতা। এদের মধ্যে কয়েকজন সরাসরি বিএনপির কোনো কমিটিতে না থাকলেও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গেই তারা জড়িত। 

এর মধ্যে রয়েছেন মহানগর বিএনপির সাবেক কমিটির সদস্য মাইনুল হক, সাবেক সহ-সভাপতি ফিরোজ আহম্মেদ, আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আ ন ম সাইফুল আহসান আজিম, মো. সেলিম হাওলাদার, মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান টিপু এবং মহানগর ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক জাবের আব্দুল্লাহ সাদি। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জাবের আব্দুল্লাহ সাদি জানান, বর্তমানে দলে তার কোনো পদ নেই। এটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন। স্থানীয় মুরুব্বি ও মসজিদের মুসল্লিরা তাকে নির্বাচনে লড়তে চাপ দিচ্ছেন। সে কারণেই তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন। 

৫ নং ওয়ার্ড থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন কাউন্সিলর প্রাথী মাইনুল হক। 

তিনি মহানগর বিএনপির সাবেক কমিটির সদস্য ছিলেন জানিয়ে বলেন, “আমাদের তো চিঠি দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে কেউ নিষেধ করেনি। চিঠি পেলে প্রত্যাহার করে নেব।” 

বরিশাল মহানগর বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ফিরোজ আহম্মেদ নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে দুইবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর। তবে বর্তমানে বিএনপির কোনো কমিটিতে নেই তিনি। 

ফিরোজ বলেন, “এবারও ২৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করব। মনোনয়ন ফরমও সংগ্রহ করেছি। ভোটাররা চাইলে অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকব।” 

দলে কোনো পদ-পদবি না থাকায় তাকে বহিষ্কারের সুযোগ নেই জানিয়ে এই স্থানীয় রাজনীতিবিদ বলেন, “বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভোট দিতে বিরত থাকার নির্দেশনা দেওয়া – এটা ঠিক হয়নি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে আরও ভাবনা-চিন্তা করা উচিত ছিল।” 

দল থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো নোটিশ দেয়া হয়নি জানিয়ে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির ১ নম্বর সদস্য আ ন ম সাইফুল আহসান আজিম বলেন, ২২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এবারও নির্বাচন করবেন তিনি। তবে আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা পেলে তখন বাকি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। 

আজিম বলেন, “স্থানীয় সরকার নির্বাচন তো দলীয় নয়। এটা ১২ মাস জনগণকে সেবা দেওয়ার বিষয়। এখানে নির্বাচন না করা মানে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করা।”

তিনি আরও বলেন, “নির্বাচন বর্জন করে করে বসে থাকলে তো হবে না। এতে মাঠ ফাঁকা পড়ে থাকবে। অন্য প্রার্থীরা এসে মাঠ দখল করে নেবে। বিএনপির সাধারণ নেতা-কর্মীরা এমনিতেই বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে।” 

নির্বাচনে অংশ নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে থাকতে চান ছাত্রদল থেকে বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত এ নেতা। তিনি আরো বলেন, “আমি নির্বাচনে অংশ নিলে দল যদি বহিষ্কার করে তাহলে কতটুকু লাভবান হবে? বরং দল একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হারাবে। কিছুদিন পরে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিলে আমি যে আবার দলে ফিরব, এমন তো কোনো কথা নেই। তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এসব বিষয় মাথায় রাখা উচিত।” 

নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েছেন মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ আমিনুল ইসলাম আমিন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাধারণ মানুষ চায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি। কিন্তু দলেরও তো একটা সিদ্বান্ত রয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত কী করব তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছি।” 

তবে নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানান তিনি। 

অন্যদিকে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান টিপু মনে করেন, দলের সিদ্ধান্ত মেয়র পদের জন্য প্রযোজ্য। কেননা কাউন্সিলর নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয় না। তাই এবারও ৬ নম্বর ওয়ার্ডেই লড়বেন ওয়ার্ডটির সাবেক এ কাউন্সিলর। 

তার দাবি, নির্বাচনে না যাওয়ার জন্য দলের চাপ রয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সাধারণ মানুষের চাপ রয়েছে। 

টিপু বলেন, “বরিশাল নগরী বিএনপি অধ্যুষিত। এখানে ৩০টি সাধারণ ও ১০টি সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে অন্তত ৩০ জন বিএনপির প্রার্থী জয়ী হবেন। তারা বিএনপির যেকোনো আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে পারবেন। তাই দলের উচিত হবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়ে তৃনমূল পর্যায়ে নেতৃত্ব তৈরি করা। এতে সামগ্রিকভাবে দলও উপকৃত হবে।” 

নগরীর ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে পাঁচবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর মো. সেলিম হাওলাদার মহানগর বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য। 

যদিও কমিটিতে কে তাকে রেখেছে তা তিনি জানেন না। মো. সেলিম বলেন, “বিএনপি করি। কিন্তু আমি কমিটির কোনো ফরমে সই করিনি। দলের কোনো মিটিং মিছিলেও যাইনি। আমি নির্বাচন করব। দল যদি বাদ দিতে চায়, দিক। 

“আমার ভোটার বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও হুজুররাও। তারা আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন। তারা আমাকে প্রার্থী হিসেবে চায়। তাদের দেওয়া সম্মান রক্ষাও আমার দায়িত্ব,” যোগ করেন এ নেতা। 

মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হারুন অর রশিদ নগরীর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের অবস্থা হয়েছে শ্যাম রাখি না কুল রাখি। তারপরেও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা মাঠ ছাড়ব না। এরপরেও যদি দল হার্ড লাইনে যায় তখন সিদ্বান্ত নেব যে কোনটি বেছে নেব।” 

সংরক্ষিত ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মজিদা বোরহান নির্বাচনে থাকবেন জানালেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। 

মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়া উদ্দিন সিকদার ২৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে একাধিকবার নির্বাচিত কাউন্সিলর। তবে এবার তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। 

তিনি বলেন, “বর্তমান সরকারের অধীন বিএনপি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। এজন্য দীর্ঘদিন ধরে দেশে আন্দোলন সংগ্রাম চলছে। তাই আমি নির্বাচনে অংশ নেব না।” 

১২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তিনবারের কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কেএম শহীদুল্লাহ এবং ২১ নম্বর ওয়ার্ডের আলতাফ মাহমুদ সিকদার স্থানীয় রাজনীতিতে বেশ প্রভাবশালী। এ দুই নেতা বরিশাল সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও প্যানেল মেয়র ছিলেন একাধিকবার। 

আলতাফ মাহমুদ এখনও সিদ্ধান্ত না জানালেও কেএম শহীদুল্লাহ নির্বাচনে অংশ নেবেন না বলে জানিয়েছেন। 

মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এবং চারবারের কাউন্সিলর মীর জাহিদুল কবির বলেন, “দলের কঠোর নির্দেশ হলো এ সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে না। এ নির্দেশ অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে বহিষ্কারসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ কারণে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে বিএনপি থেকে কেউ অংশ নেবে না।” 

বিএনপির ১০ দফা আন্দোলন চলমান উল্লেখ করে এই নেতা বলেন, “সেই আন্দোলনের প্রথম দাবি হচ্ছে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন। তা যতদিন বাস্তবায়ন না হবে ততদিন বিএনপি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না।” 

দল যেহেতু এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ঘোষণাই করেছে তাই এখানে কোনো যুক্তি দেখানো উচিত নয় বলে মনে করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার।