কিছু নির্দিষ্ট পণ্য ছাড়া অনুমতি না থাকা ও খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্য আনতে অনাগ্রহের কথা জানান এক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক।
Published : 09 Dec 2024, 09:01 AM
ফেনীর বিলোনিয়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে রপ্তানি হলেও খরচ বেশি পড়ে যাওয়ায় পণ্য আমদানিতে আগ্রহ নেই ব্যবসায়ীদের।
এ ছাড়া গেল অগাস্টের শুরুতে সরকার পরিবর্তনের জেরে ভারতীয় ভিসা জটিলতায় প্রতিনিয়ত কমেছে যাত্রী পারাপার।
ফলে পণ্য রপ্তানির কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকলেও অনেকটা অলস সময় পার করছেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা।
ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলার সীমান্তে অবস্থিত বিলোনিয়া স্থলবন্দর। যেটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুহুরীঘাট এলসিএস স্টেশন নামেও পরিচিত।
২০০৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিলোনিয়া শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয়। পরে ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর এ বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়।
সম্প্রতি ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলার ঘটনা ঘটে। বিলোনিয়া সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশ-বিরোধী বিক্ষোভও করেন ইসকন ভক্তরা। তার প্রতিবাদ জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরাও শূন্যরেখায় গিয়ে বাংলাদেশ মিশনে হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। এ নিয়ে কিছুটা উত্তেজনাও ছিল।
সম্প্রতি বন্দরে গিয়ে দেখা যায়, স্থলবন্দরের মূল ফটকে সুনশান নিরবতা। ফটকের প্রবেশদ্বারে নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে ভেতরে গিয়ে প্রশাসনিক ভবনের পুরোটা ফাঁকা দেখা যায়।
দুজন কর্মকর্তা ভবনের বাইরে রোদ পোহাচ্ছেন। বন্দরের সহকারী পরিচালক ছুটিতে থাকায় কথা হয় হিসাবরক্ষক ও ওয়্যারহাউজ সুপারের সঙ্গে।
হিসাবরক্ষক মো. হানিফ বলেন, আমদানিকারকদের অনাগ্রহের কারণে বিলোনিয়া স্থলবন্দর দিয়ে কোনো পণ্য আসে না; শুধু রপ্তানিই হয়। রাপ্তানি পণ্যও একটি, সিমেন্ট।
তিনি বলেন, বাংলাদেশি বিভিন্ন কোম্পানির সিমেন্ট রপ্তানি হয়। চলতি বছরের নভেম্বরে ৩৬৯ গাড়ি সিমেন্ট রপ্তানি হয়েছে। ২০ টনের প্রতিটি গাড়িতে ৪০০ ব্যাগ করে সিমেন্ট ছিল।
অক্টোবরে ২৪১ গাড়ি, সেপ্টেম্বরে ২৪৩ গাড়ি, অগাস্টে ১০৫ গাড়ি ও জুলাইয়ে ২২৩ গাড়ি সিমেন্ট রপ্তানি হয়েছে।
জুলাই-অগাস্টে দেশের অবস্থা কিছুটা অস্থিতিশীল থাকায় রপ্তানি কমলেও বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে।
বন্দরের ওয়্যারহাউজ সুপার ইমাম হাসান বলেন, গত রমজান মাসে এ বন্দর দিয়ে একটি পণ্য আমদানি হয়েছিল।
পারভেজ নামে এক ব্যক্তি পাঁচ টন বেল আমদানি করেন। এ ছাড়া এ বন্দরে কোনো পণ্য তেমন আমদানি হয় না।
খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি কমেছে বলে ধারণা করছেন তিনি।
বন্দর ঘুরে পাওয়া যায়নি কোনো সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীকে।
মোবাইল ফোনে কথা হয় ‘এমএস জিয়ান এন্টারপ্রাইজ ও উত্তরণ ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল’ এর ব্যবস্থাপক ইসমাঈল হোসেনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, “এ বন্দর দিয়ে গবাদিপশু, মাছের পোনা, তাজা ফলমূল, গাছ-গাছরা, বীজ, গম, পাথর, কয়লা, রসায়নিক সার, চায়না ক্লে, কাঠ, টিম্বার, চুনাপাথর, পোঁয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, বল ক্লে ও কোয়ার্টজ আমদানির অনুমতি আছে।
“বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের পণ্য রপ্তানির অনুমতি রয়েছে।”
‘বিলোনিয়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’ এর আমদানি-রপ্তানিকারক মিজানুর রহমান পারভেজ বলেন, বাংলাদেশের যেসব পণ্য আমদানি করার প্রয়োজন যেমন মসলা, চাউল, আগরবাতি, টমেটো। এগুলো এ অঞ্চলে চাহিদা বেশি। কিন্তু এগুলো আমদানির অনুমতি নেই।
তিনি বলেন, আবার গম, পেঁয়াজ, আদাসহ অন্য নিত্যপণ্য আমদানির অনুমতি থাকলেও সেগুলো আনতে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। বিক্রয় মূল্যের চেয়ে ক্রয় ও পরিবহন মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এ বন্দর দিয়ে আমদানিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ নেই।
বিলোনিয়া স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মনির মজুমদার মোবাইল ফোনে বলেন, “এ বন্দরের অবকাঠামো অন্য অনেক বন্দরের চেয়ে অত্যাধুনিক।
“কিন্তু খরচ বেশি পড়ে যাওয়ার কথা বলে আমদানিকারকরা ভারত থেকে এ বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি কম করে।”
বিলোনিয়া স্থল শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত হোসেন মোবাইল ফোন বলেন, বন্দর দিয়ে সম্প্রতি যাত্রী পারাপার কমেছে। তবে রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে।
গেল বছরের নভেম্বর মাসে আট হাজার ৮২৬ মেট্রিকটন পণ্য রপ্তানি হয়েছে, টাকার অংকে যা সাত কোটি ৫৩ লাখ ৪২ হাজার ৪৮০।
এক বছরের ব্যবধানে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত পণ্য রপ্তানি হয়েছে আট হাজার ৮১৩ মেট্রিকটন, টাকার অংকে যা আট কোটি ২৫ লাখ ৫৭ হাজার ৬০০।
তিনি বলেন, “গেল অগাস্টে সরকার পরিবর্তনের ফলে পণ্য রপ্তানিতে এ শুল্ক স্টেশনে কোনো সমস্যা হয়নি। শুধু ভিসা জটিলতায় যাত্রী পারাপার কমেছে।”
স্থলবন্দরটির কাস্টমসের এসআই আমিনুল হক বলেন, ২০২৩ সালের নভেম্বরে এখান দিয়ে ভারতে যান ৬৬১ জন, আসেন ৬৪২ জন।
এক বছরের ব্যবধানে চলতি বছরের নভেম্বরে এ বন্দর ব্যবহার করে ভারতে গিয়েছেন ৫৯৭ জন, এসেছেন ৩৯১ জন।
বিলোনিয়া ইমিগ্রেশন পুলিশের ইনচার্জ এসআই মো. শাহ আলম বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবর্তনের পর নতুন করে ভারতীয় ভিসা ইস্যু বন্ধ রয়েছে। চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট অতি প্রয়োজনীয় কিছু ভিসা ইস্যু করা হচ্ছে বলে তার জানা আছে।
তিনি বলেন, গত কয়েক মাসে যারা বিলোনিয়া স্থলবন্দর দিয়ে যাতায়াত করছেন তারা সবাই আগের ইস্যুকৃত ভিসা ব্যবহার করছেন।
“ভারত নতুন করে ভিসা ইস্যু না করলে সামনের বছর নাগাদ এ বন্দর দিয়ে যাত্রী পারাপার আরও কমে যাবে,” বলেন বন্দরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা।
বন্দর দিয়ে পারাপারে যাত্রীরা যা বলছেন
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের পদুয়া এলাকার বাসিন্দা নির্মল কুমার পাল গত সোমবার দুপুরে ভারত থেকে বিলোনিয়া দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন।
তিনি বলেন, আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে তিনি ও তার স্ত্রী ভারতের আগরতলার উদয়পুর গিয়েছিলেন গত মাসে।
সেবারই প্রথমবার তিনি বিলোনিয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান। যেতে বা আসতে কোনো সমস্যা হয়নি। কাস্টমস বা ইমিগ্রেশন কোথাও কোনো ঝামেলা হয়নি।
ভারতের সাউথ ত্রিপুরা বীর চন্দ্র নগরের বাসিন্দা কেশব মগ হৃদয় বলেন, গত ২৬ নভেম্বর পাঁচ দিনের জন্য মামার বাড়ি ফেনীর দাগনভূঞাতে বেড়াতে আসেন। বেড়ানো শেষে সোমবার দুপুরে বিলোনিয়া সীমান্ত দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
বিগত কয়েক বছর এখান দিয়ে তিনি আসা-যাওয়া করছেন। বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন হলেও ভারতে থেকে আসা বা যাওয়ায় কোনো প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়নি তাকে।
সম্প্রতি ফেনী শহরের মাস্টারপাড়ার বাসিন্দা তন্বী সোম শ্যামাপূজায় ঘুরতে আগরতলা গিয়েছিলেন।
ফেরার পথে প্রয়োজনীয় কিছু ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য আনলে বাংলাদেশ ইমিগ্রশন ও কাস্টমসে তাকে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
তিনি এর আগে বেনাপোল ও আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করলেও এবার বিলোনিয়া বন্দরে জেরার মুখে পড়েন।
বিজিবি-৪ ফেনী ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন, “সম্প্রতি ভারতে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার পর সীমান্তে নজরদারি আগের চেয়ে বেশি জোরদার করা হয়েছে।”
বিজিবি সদস্যরা নিয়মিত টহলকাজ ও অবৈধভাবে পণ্য আনা-নেওয়া রোধে চেষ্টা করছে বলে দাবি তার।