৫ অগাস্ট থেকে পরবর্তীতে টানা চারদিন সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলতে প্রায় কিছুই ছিল না।
Published : 14 Aug 2024, 10:01 PM
প্রবল গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে রাজশাহী ও নওগাঁয়।
ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি-ঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনায়।
৫ অগাস্ট থেকে পরবর্তীতে টানা চারদিন সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে থানা থেকে লুট করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। বাদ যায়নি সংবাদ মাধ্যমের কার্যালয়ও।
৫ অগাস্ট রাজশাহীর নগর ভবনে আগুন দেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে ল্যাপটপ, চেয়ার, টেবিল, এসি, কম্পিউটারসহ সব মালামাল লুট করা হয়।
এ ছাড়া ভাঙচুর, লুটপাট করে আগুন দেওয়া হয় সিটি করপোরেশনের ১৫টি ওয়ার্ড কার্যালয়ে। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে কয়েকজন কাউন্সিলরের বাড়িতেও।
লুটপাটের পর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নগরীর উপশহরে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের বাসভবন। নগরের সিঅ্যান্ডবির মোড়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) সদর দপ্তরেও আগুন দেওয়ার পর চলে লুটপাট।
আগুন দিয়ে লুটপাট চালানো হয়েছে নগরীরসহ রাজশাহীর ১১টি থানায়। বিশেষ করে আরএমপি সদর দপ্তর, বোয়ালিয়া, কাশিয়াডাঙ্গা, রাজপাড়া, মতিহার, মালোপাড়া ফাঁড়ি ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হয়। লুট করা হয় অস্ত্র-গুলিসহ মালামালও। জেলা পুলিশের মোহনপুর থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
হামলা থেকে বাদ যায়নি হাইকেট পার্ক ও রাজশাহী চিড়িয়াখানা। হাইকেট পার্কে আগুন না দিলেও ব্যাপক ভাঙচুর করার পর নিচতলা থেকে ১০ তলা পর্যন্ত সমস্ত মালামাল লুট করা হয়।
পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রাজশাহী এ এইচ এম কামারুজ্জামান চিড়িয়াখানা ও উদ্যানের আবাসিক হোটেল। এরপর লুটপাট করা হয় সেখানকার মালামাল। লুট হয়েছে লেকের মাছসহ পশু-পাখিও। হরিণ ধরে নিয়ে জবাই করে পিকনিট করেছে হামলাকারীরা।
অনলাইন নিউজ পোর্টাল পদ্মাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের কার্যালয়সহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল আলাম বেন্টুর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
নগরীর কল্পনার মোড়ে লবঙ্গ ফাস্টফুড অ্যান্ড চাইনিজ এবং মোল্লাপাড়ায় লবঙ্গ কনভেনশন সেন্টারে আগুন দেওয়ার পর লুটপাট করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল আলম বেন্টুর দুটি প্রাইভেট কার ও নয়টি ডাম্প ট্রাক। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নগরীর কোন স্টেশন মোড়ের তার ব্যবসায়িক কার্যালয়ও।
ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে সাবেক প্রতিমন্ত্রী আব্দুল ওয়াদুদ দারা, রাজশাহী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা ও অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা, রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ, রাজশাহী-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর বাড়ি এবং ‘থিম ওমর প্লাজা’ মার্কেটসহ সংসদ সদস্যদের রাজনৈতিক কার্যালয় ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
ভাঙচুর ও লুটপাটের পর গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নগর আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভবন। ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে নগরীসহ জেলার শতাধিক আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও নেতাদের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ হয়েছে বাগমারা বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স ও জাদুঘর।
গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নগরীর লক্ষ্মীপুর মোড়ের বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। রাজশাহী কলেজ ও সিঅ্যান্ডবি মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙতে না পেরে কালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ৫ অগাস্ট নওগাঁ শহরের পোস্ট অফিস পাড়ায় সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাধন চন্দ্র মজুমদারের বাসায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে একদল হামলাকারী। খাদ্যমন্ত্রীর মেয়ে সোমা মজুমদারের বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একই কায়দায় হামলা হয়েছে।
শহরের সরিষাহাটির মোড়ে নওগাঁ-৫ (নওগাঁ সদর) আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন জলিল, নওগাঁ-৬ (রাণীনগর-আত্রাই) ওমর ফারুক, নওগাঁ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি দেওয়ান ছেকার আহমেদ, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আমানুজ্জামান সিউল, জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি খোদাদদ খান, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম, নওগাঁ শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি ইকবাল শাহরিয়ার, নওগাঁ চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির কার্যালয়, গোস্তহাটির মোড়ে আজাদ চিস্তির চিস্তি প্লাজা, আবুল জলিল ইলেকট্রনিক্স মার্কেট, নওগাঁ খ্রিস্টান চার্চসহ বিভিন্ন আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা।
এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতাকমীদের প্রায় অর্ধশত মোটরসাইকেল এবং ২০টিরও বেশি প্রাইভেট কারসহ গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে থাকা সরকারি পুকুরের মাছ লুটের ঘটনাও ঘটেছে।
ব্যবসায়ী পরিতোষ সাহা ও তার শেয়ার হোল্ডারদের শহরের তাজ সিনেমা হল, ইস্টার্ন প্রডিউস কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড, ম্যানিলা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, কমিউনিটি সেন্টার, ব্রিজের মোড়ের ডিএলএস কমপ্লেক্স, একটি বাস, একটি মিনি ট্রাক, একটি মাইক্রোবাসে হামলা, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়েছে।
বুধবার সকাল থেকে নওগাঁ শহরের বাঙ্গাবাড়িয়া এলাকায় নওগাঁ জেনারেল হাসপাতাল সংলগ্ন প্রায় ২০ বিঘা আয়তনের একটি সরকারি পুকুরে জাল নামিয়ে মাছ লুট করে পুকুরটি দখল করে নেওয়া হয়। সরকারি পুকুরটি লিজ নিয়ে এতোদিন মাছ চাষ করে আসছিলেন নওগাঁ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি দেওয়ান ছেকার আহমেদ।
এ ছাড়া নওগাঁ পৌরসভার শিবপুর এলাকায় বাইপাস সড়ক সংলগ্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন তিনটি পুকুরের মাছ লুটপাটের ঘটনা ঘটে ৬ অগাস্ট। ওই তিনটি পুকুরের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান ছেকার আহমেদ।
নিয়ামতপুর উপজেলার শ্রীমন্তপুর ইউনিয়নের দিঘীরপাড় গ্রামে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ছোট ভাই মনোরঞ্জন মজুমদারের দখলে থাকা প্রায় ১০০ বিঘা আয়তনের সরকারি একটি দিঘির মাছও লুটপাট করা হয়েছে। ৫ অগাস্ট রাত থেকে ওই দিঘিতে জাল ফেলে স্থানীয় লোকজন মাছ লুট করা শুরু করে।
দুদিন ধরে এই লুটপাট চলে। ওই দিঘি থেকে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা মূল্যের মাছ লুট করে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
একই উপজেলার চন্দননগর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর তলাখরপা গ্রামে ৭ অগাস্ট আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে থাকা তিনটি পুকুরে লুটপাট চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষ্ণুপুর তলাখরপা গ্রামে পুকুর দখলে নিয়ে মাছ লুটের পর সন্ত্রাসীরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বাড়িতেও হামলা চালায়। এতে আটজন আহত হয়েছেন।
রাণীনগর উপজেলার আবাদপুকুর হাটে, বনমালী কুড়ি, জলকই গ্রামে বিভিন্ন বাড়িতে হামলা, মারধরের ঘটনা ঘটেছে। সংখ্যালঘুদের দোকানপাটেও হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে।
বদলগাছী উপজেলার মামুদপুর গ্রামে ৯ অগাস্ট ভোররাতে রুবেল হোসেন নামে এক বর্গাচাষি ১০ বিঘা জমির ৩ হাজার কলাগাছ কেটে সাবাড় করে দিয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন।