“কাঠের তৈরি ঘরের বড় একটি অর্ডার আমরা পেয়েছি। এটা দেশের জন্য গর্বের।”
Published : 19 Oct 2024, 09:23 AM
কেউ কাঠের ওপর নকশা করছেন, কেউ আবার নকশা ফুটিয়ে তুলতে শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষছেন। কয়েকজনকে কাঠে আঠা লাগিয়ে জোড়া দিতে দেখা গেল। এসব প্রক্রিয়া শেষে শ্রমিকদের নিপুণ হাতের দক্ষতায় তৈরি হচ্ছে এক একটি কাঠের ঘর।
অনেকটা ‘উল্টো নৌকার’ মতো দেখতে ঘরের কাঠামো, দরজা, জানালা ছাদ এমনকি ভেতরের আসবাবপত্রও তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে আম, জাম, মেহগনিসহ দেশি সব গাছের কাঠ। ঘরগুলো তৈরি করা হচ্ছে, বাগেরহাটের সিএনবি বাজার সংলগ্ন করোরি গ্রামে ‘ন্যাচারাল ফাইবার্স’ নামের একটি কারখানায়।
কারখানার কারিগররা বেলজিয়ামের জনপ্রিয় বোটানিক্যাল গার্ডেন ও চিড়িয়াখানা ‘পাইরি ডাইজা’র জন্য এসব ঘর তৈরি করছেন। প্রতিষ্ঠানটি আসবাবসহ প্রাথমিকভাবে ১২০টি ঘরের ক্রয়াদেশ পেয়েছে বলে জানা গেছে।
ঘর তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি ঘর ১১ মিটার লম্বা এবং চওড়া সোয়া ৪ মিটার। দুটি বেডরুমে মোট পাঁচজন থাকার উপযোগী এ ঘর সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ঘরের একপাশে একটি বারান্দা, বেডরুমের সঙ্গে বাথরুম ও বসার ঘর রয়েছে। বসার ঘরে টেলিভিশন দেখার ব্যবস্থা এবং ঘরের ভেতরেই রান্না করারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ঘরের প্রতিটা অংশ খুলে আলাদাভাবে প্যাকেজিং করে পাঠানো হবে বেলজিয়ামে।
কাঠের তৈরি নমুনা ঘরটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পছন্দ হওয়ায় চুক্তি অনুযায়ী আগামী বছরের মধ্যে ১২০টি ঘর তৈরি করে রপ্তানির জন্য কাজ শুরু করেছে ন্যাচারাল ফাইবার্স। খুব দ্রুত কাঠের তৈরি ঘরের প্রথম চালানটি যাবে বলে আশা প্রতিষ্ঠানটির। প্রথমবারের মতো তাদের তৈরি করা পরিবেশবান্ধব ঘর বিদেশে রপ্তানি হওয়ায় ‘খুশি’ প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা।
আগামীতে ইউরোপের বড় বাজার ধরতে সরকার তাদের সহযোগিতা করবে সেই আশা প্রতিষ্ঠানটির। একের পর এক পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি করে সবার নজর কেড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের পণ্য বিদেশে রপ্তানিতে দেশে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।
বিদেশি পরামর্শকদের সঙ্গে শ্রমিকদের যোগাযোগ থেকে শুরু করে সার্বিক দেখভাল করছিলেন ন্যাচারাল ফাইবার্স-এর প্রধান নির্বাহী মোস্তাফিজ আহমেদ। ৫৭ বছর বয়সী এ ব্যবসায়ীর সঙ্গে ব্যবসার হাল ধরে আছেন ছোট ভাই মোজাহিদ আহমেদ।
মোস্তাফিজ বলেন, “কাঠের তৈরি ঘর যাবে ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামের একটি ইকোপার্কে। পার্কের নাম পাইরি ডাইজার। এই পাইরি ডাইজার পার্কের কাছ থেকে ক্রয় আদেশ নিয়েছে গ্রিসের একটি প্রতিষ্ঠান ‘কোকোম্যাট’। কোকোম্যাটের সঙ্গে ন্যাচারাল ফাইবার্সের ব্যবসা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ওই প্রতিষ্ঠানটি আমাদের কাজটি দিয়েছে। কাঠের তৈরি ঘরের নকশার কাজ দিয়েছে। ঘরে কী ধরনের কাঠসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে তার তালিকা দিয়েছে।
“এরই মধ্যে তাদের দেওয়া নকশা অনুযায়ী ঘর তৈরি করেছি। পাইরি ডাইজার ইকোপার্ক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে এসে কাঠের তৈরি ঘর পরিদর্শন করে তা নিতে অনুমোদন দিয়েছে। তাদের আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে মোট ১২০টি ঘর তৈরি করে তা সেট করে দিয়ে আসার চুক্তি হয়েছে।”
বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়ক থেকে নেমেই রাখালগাছি ইউনিয়নের করোরি গ্রাম। ২০১৭ সালে এই গ্রামে একর জমির ওপর গড়ে ওঠে ন্যাচারাল ফাইবার্স নামের প্রতিষ্ঠানটি। তারা ‘পরিবেশবান্ধব’ সরঞ্জাম তৈরি করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। প্রত্যন্ত এ গ্রামে তৈরি সেসব সরঞ্জাম দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিদেশে। একদিকে বাড়ছে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি আয় অন্যদিকে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
ন্যাচারাল ফাইবার্স কারখানা ঘুরে কারিগরদের অসাধারণ নিপুণ শৈলী দেখে চোখ আটকে গেল। কাঠের তৈরি ঘরটি কয়েকটি লোহার খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। সামনে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে প্রথমেই ঘরে ঢোকার প্রবেশদ্বার।
প্রবেশদ্বার থেকে ভেতরে ঢুকলে মনে হবে আপনি একটি রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়েছেন। ভেতরে দুটি শোবার ঘর, একটি অতিথিশালা, সামনের অংশে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার বসার স্থান। সব মিলিয়ে ভেতরটি দৃষ্টিনন্দন।
সেখানে কথা হয় ন্যাচারাল ফাইবার্সের উৎপাদন ব্যবস্থাপক শংকর বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, “আমরা মূলত ইউরোপের বাজারটি ধরার চেষ্টা করেছি। এরই মধ্যে আমরা সফলও হয়েছি। কাঠের তৈরি ঘরের বড় একটি অর্ডার আমরা পেয়েছি। এটা দেশের জন্য গর্বের। যে কাঠের ঘর আমরা তৈরি করেছি তা শতভাগ পরিবেশবান্ধব। প্রত্যন্ত গ্রামে এই কারখানাটি গড়ে উঠেছে। এখানে দেড়শ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।”
এ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা সবাই দক্ষ বলেও দাবি করেন তিনি। বলেন, সামনে আরও শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে। এই শ্রমিকরা বর্তমানে তিন দিনের মধ্যে একটি কাঠের ঘর তৈরি করতে পারেন। বেলজিয়ামে যে অর্ডারটি আমরা পেয়েছি সেই ঘর ফিটিং করতে এই শ্রমিকরাই ওই দেশে যাবেন। ইউরোপের ভিসা পাওয়া অনেক কঠিন। এখানকার শ্রমিকরা সেই ভিসা পাচ্ছে, এটা অকল্পনীয়।
“আমরা এরই মধ্যে ১২০টি ঘরের অর্ডার পেয়েছি। ভবিষ্যতে আরও পাব। আমরা যে কাঠের ঘর তৈরি করেছি তা থ্রি-স্টার মানের। এই ঘরের মধ্যে কিচেন, বেডরুম, বাথরুম ও গেস্টরুম রয়েছে।”
ন্যাচারাল ফাইবার্সের প্রতিষ্ঠাতা স্বত্বাধিকারী মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের কারখানায় ঘরগুলো তৈরি করে কার্টুনে প্যাকেট করে বেলজিয়ামে নিয়ে আমাদের দেশের মিস্ত্রিরা তা সেট করে দিয়ে আসবে।
“এই ঘরে ব্যবহৃত কাঠ আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। এজন্য আফ্রিকার দেশ ঘানার একটি কোম্পানির মাধ্যমে কাঠ আমদানি করতে চুক্তি হয়েছে। এ ছাড়া অনেক সরঞ্জাম আছে যা আমাদের দেশে নেই। সেইসব সরঞ্জাম (লোহা, তামা, সিরামিক) ইউরোপ থেকে নিতে হবে।
“এই ঘরে ব্যবহার করা সরঞ্জাম ইউরোপের স্ট্যান্ডার্ড হতে হবে। ওই দেশ এই ঘর দেখে সনদ দেবে। বাংলাদেশ থেকে এমন একটা কঠিন কাজ তাও আবার এমন একটি অজপাড়াগাঁয় বসে করতে হচ্ছে। তবে আশার কথা এই যে, আমরা সফল হয়েছি।”
এই ঘরের দাম কেমন পড়বে জানতে চাইলে মোস্তাফিজ বলেন, “সরঞ্জামের দামের উপর নির্ভর করবে। তবে দাম আনুমানিক ৩০ হাজার ইউরোর মতন আসতে পারে।”
তিনি বলেন, “এই ঘরে ব্যবহার হয়েছে আফ্রিকার লোহা কাঠ (ইপে উড), দেশীয় মেহগনি, আম, জাম। এই ঘরে কোনো ধরনের রঙের ব্যবহার করা যাবে না। হতে হবে ন্যাচারাল।
“জাহাজে করে এসব ঘর বেলজিয়ামে রপ্তানি করা হবে। বাংলাদেশের মোংলা সমুদ্র বন্দরে বেলজিয়ামের জাহাজ ভিড়ে না। যার কারণে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে হবে।”
কাঠের আসবাব বিদেশে রপ্তানি করলে সরকার সাত শতাংশ ইনসেনটিভ দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এটা আমরা পাব। পণ্য রপ্তানিতে বন্দরে ব্যবসায়ীদের কিছু ঝামেলা ফেইস করতে হয় সেই ঝামেলা যাতে না হয় সেজন্য সরকারের সহযোগিতা চাইছি।
“এসব সমস্যা না থাকলে ভবিষ্যতে আরও বেশি করে ক্রয় আদেশ (অর্ডার) আনতে পারব। ইউরোপে আগে ক্রোয়েশিয়া, বুলগেরিয়াসহ বেশকিছু দেশ কাঠের ঘর তৈরি করে বিক্রি করত। তারা এখন ধনী হয়ে গেছে। তারা এখন আর তৈরি করে না। বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমিকরা এখন এই কাঠের কাজ করে থাকে। পরিবেশবান্ধব এই শিল্পটি সম্ভাবনাময় শিল্প।”
ইউরোপে কাঠের তৈরি সরঞ্জামের একটি বড় বাজার ফাঁকা রয়েছে। এই বাজারটা ধরতে পারলে অন্য উদ্যোক্তারাও সুযোগ পাবে বলে মনে করে মোস্তাফিজ আহমেদ।
গ্রিসের প্রতিষ্ঠান কোকোম্যাটের প্রতিষ্ঠাতা পল এমোফেডিস বলেন, “বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ন্যাচারাল ফাইবার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরি করছে জানতে পেরে আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা পরিদর্শন করি।
“আমরা আমাদের চাহিদার পণ্য তৈরির জন্য তাদের স্যাম্পল তৈরি করে দেখাতে বলি। তারা আমাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য তৈরি করে দিতে সক্ষম হয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। এই পণ্য ইউরোপের দেশে খুব শিগগির নিতে পারব বলে আশা করছি।”