নবদুর্গা: দেবীর নয় রূপের পূজা শ্রীমঙ্গলের মণ্ডপে

এক যুগ ধরে বৈদিক রীতি অনুযায়ী এখানে নবদুর্গার পূজার আয়োজন করা হচ্ছে জানায় পূজা কমিটি।

বিকুল চক্রবর্তী, মৌলভীবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Oct 2022, 11:47 AM
Updated : 1 Oct 2022, 11:47 AM

শুরু হয়েছে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। দেশের অধিকাংশ স্থানে শনিবার মহাষষ্ঠী তিথিতে আনুষ্ঠানিকভাবে দেবীর বোধন হলেও মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গলের একটি মণ্ডপ পূজার ঢাকের তালে মুখরিত হয়ে উঠেছে আরও পাঁচদিন আগেই।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল সাতগাঁও ইউনিয়নের ইছামতি চা বাগানের মঙ্গলচণ্ডির থলিতে এ মণ্ডপে পূজা হচ্ছে সনাতন ধর্মের বৈদিক রীতি অনুযায়ী দেবী দুর্গার নয়টি রূপের পৃথক পৃথক প্রতিমা তৈরি করে।  

এক যুগ ধরে বৈদিক রীতি অনুযায়ী এখানে পূজার আয়োজন করে আসছেন জানিয়ে পূজা কমিটির আয়োজক সুরঞ্জিত দাশ ও টুটু দেব জানান, শত শত বছরের প্রাচীন এই দেবস্থলি। যেখানে দেবী মঙ্গলচণ্ডী জাগ্রত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সারা বছরই এখানে ভক্ত সমাগম ঘটে।

নয় দিনব্যাপী এ পূজাকে ‘নবদুর্গা’র পূজা হিসেবে অভিহিত করে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও পুরোহিত দীপংকর ভট্টাচার্য্য জানান, সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) পূজার প্রারম্ভিক দিনে করা হয় দেবীর শৈলপুত্রী রূপের পূজা। এরপর ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন দেবীর ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা রূপের পূজা শেষে শনিবার করা হচ্ছে কাত্যায়নী রূপের পূজা।

এভাবে কালরাত্রী, মহাগৌরী, সিদ্ধিদাত্রী রূপে পূর্জাচনা শেষে দশমী দিনে অনান্য প্রতিমার সঙ্গে হবে দেবীর বিসর্জন।

মণ্ডপের সাজ-সজ্জার দায়িত্বে থাকা বিপ্লব দেব জানান, এই মন্দিরটি জাগ্রত একটি মন্দির। যার নাম শ্রীশ্রী মঙ্গলচণ্ডী মন্দির। অনেকে মনে করেন, শ্রীশ্রী মঙ্গলচণ্ডী থেকেই শ্রীমঙ্গল নামের উৎপত্তি।

তিনি বলেন, “মায়ের আজ্ঞায় বাংলাদেশে একমাত্র এই মন্দিরে নবরূপে দেবী দুর্গা মায়ের পূজা হয়।”

এই পূজা মণ্ডপের অপর পুরোহিত দয়াময় ভট্টাচার্য্য বলেন, মানুষের মধ্যে সৃষ্ট আসুরিক শক্তি দূর হওয়ার পাশাপাশি বিশ্ব শান্তি কামনায় দেবী দুর্গার কাছে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়।

শ্রী মদন গুপ্তের ফুল পঞ্জিকায় ‘নবদুর্গা কাহিনি’তে পার্বতীর নয়টি রূপের বর্ণনা করা হয়েছে। 

এতে বলা হয়েছে, দেবী দুর্গার নবরূপের প্রথম রূপ হলো ‘শৈলপুত্রী’। পর্বতরাজ হিমালয়ের ঘরে জন্ম হয় বলে তার নাম হয় শৈলপুত্রী। বৃষভের পৃষ্ঠে তিনি আরোহিত। শৈলপুত্রী দেবীর দক্ষিণহস্তে ত্রিশূল এবং বাম হস্তে কমলপুষ্প। তিনি পূর্বজন্মে ব্রহ্মার পুত্র দক্ষ প্রজাপতির কন্যা ছিলেন। তখন তার নাম ছিল ‘সতী’।

“শৈলপুত্রী দুর্গার মহত্ব ও শক্তি অনন্ত। নবরাত্রি পূজার প্রথম দিনেই দেবীর পূজা ও আরাধনা করা হয়। উপনিষদের কাহিনী অনুসারে ইনি হৈমবতী রূপে দেবতাদের গর্ব চূর্ণ করেছিলেন।”

'ব্রহ্মচারিণী' দেবী দুর্গার দ্বিতীয় রূপ। ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ হলো তপস্যা। অর্থাৎ মা দুর্গা এখানে ব্রহ্মচারিণী তথা তপশ্চারিণী অর্থাৎ তপ আচরণকারী। দেবী ব্রহ্মচারিণী ডানহাতে জপের মালা এবং বাঁ হাতে কমণ্ডলু ধারণ করে আছেন। পূর্বজন্মে যখন তিনি হিমালয়ের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেন তখন নারদের পরামর্শে মহাদেবকে পতিরূপে লাভ করার জন্য কঠোর তপস্যা করেন। এই কঠোর তপস্যার জন্য তাকে তপশ্চারিণী বা ব্রহ্মচারিণী বলা হয়।

ত্রিলোকে দেবীর এই কঠোর তপস্যার জন্য দেবতা, ঋষি, সিদ্ধ সবাই ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগলেন। অবশেষে ব্রহ্মা দেবীর এরূপ তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দৈববাণী করলেন, ‘হে দেবী এখন পর্যন্ত তোমার মত এরূপ কঠোর তপস্যা আর কেউ করেনি। তোমার স্তবে আমি সন্তুষ্ট। তোমার মনোস্কামনা পূর্ণ হবে ও মহাদেবকেই তুমি পতিরূপে পাবে। এবার তুমি গৃহে ফিরে যাও।’ সিদ্ধিলাভের পর তিনি দেবাদিদেব মহাদেবের পত্নী হন।

দেবীর এ রূপের উপাসনায় ত্যাগ, বৈরাগ্য, সদাচার, সংযম বৃদ্ধি পায়। কঠিন সংঘর্ষেও দেবীর আরাধনায় সিদ্ধি ও বিজয় প্রাপ্তি হয়। এ থেকে ধৈর্য, ত্যাগ ও সংযমী হওয়ার শিক্ষা পাওয়া যায়।

দেবী দুর্গার তৃতীয় রূপ হলো 'চন্দ্রঘণ্টা'। নবরাত্রি আরাধনার তৃতীয় দিন এর বিগ্রহকেই পূজার্চনা করা হয়। দেবীর মস্তকে ঘণ্টার আকারে অর্ধচন্দ্র শোভা পায়, তাই দেবীকে চন্দ্রঘণ্টা বলা হয়।

এই দেবী দশভূজা। দেবীর দশ হস্ত নানান অস্ত্রে বিভূষিত। দেবীর বাহন সিংহ, দেবীর কৃপায় সাধকের সমস্ত পাপ ও বাধাবিঘ্ন দূর হয়। মাতা চন্দ্রঘণ্টার উপাসক যেখানেই যান তাকে দেখে মানুষ শান্তি ও সুখ অনুভব করে। তার আরাধনা করলে সংসারের দুঃখ, কষ্ট বিপদ-আপদ সব দূরীভূত হয়।

দেবী দুর্গার চতুর্থ রূপ 'কুষ্মাণ্ডা'। ইনিই হলেন জগতের আদি-স্বরূপা, আদি শক্তি। পুরাণে বর্ণিত আছে যখন চতুর্দিক অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল, জগৎ সংসারের কোনও অস্তিত্ব ছিল না, ঠিক সেই সময় দেবী ঈষৎ হাস্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন।

স্বল্পহাস্যে অণ্ড বা ব্রহ্মাণ্ডকে উৎপন্ন করায় দেবী ‘কুষ্মাণ্ডা’ নামে অভিহিত হন। দেবী কুষ্মাণ্ডা অষ্টবাহু সমন্বিতা। তাই তিনি অষ্টভূজা নামেও খ্যাত। দেবীর সাতটি হাতে যথাক্রমে কমণ্ডলু, ধনুক, বান, পদ্মফুল, অমৃতপূর্ণ কলস, চক্র এবং গদা ধারণ করে আছেন, অপর একটি হাতে রয়েছে সকল সিদ্ধি এবং নিধি প্রদানকারী জপমালা।

মাতা কুষ্মাণ্ডার উপাসনা করলে সমস্ত রোগ-শোক দূর হয় এবং আয়ু, যশ, বলবৃদ্ধি হয়। দেবী সামান্য সেবা-ভক্তিতেই প্রসন্ন হন।

দেবীর পঞ্চম রূপটি হলো 'স্কন্দমাতা'। 'কুমার কার্তিক'-এর অপর নাম ভগবান স্কন্দ। এই স্কন্দের মাতা হওয়ায় দেবী দুর্গার পঞ্চম রূপকে স্কন্দমাতা নামে অভিহিত করা হয়।

স্কন্দমাতা দেবী চতুর্ভুজা। প্রতিমায় তার ডানদিকের উপরের হাতে স্কন্দকে ধরে আছেন, নীচের হাতটি উপর দিকে পদ্মফুল ধারণ করে আছেন। দেবী শুভ্রবর্ণা এবং সিংহের উপরে উপবিষ্ঠা। স্কন্দমাতাকে ভক্তি সহকারে আরাধনা করলে ভক্তের মনোইচ্ছা তিনি পূর্ণ করেন।

দুর্গার ষষ্ঠ রূপটি হলো ‘কাত্যায়নী’। কত নামে এক বিখ্যাত মহর্ষির পুত্র ঋষি কাত্য ছিলেন আরো একজন মহর্ষি। মহর্ষি কাত্যায়ন সেই 'কাত্য’ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি বহু বছর ধরে ভগবতী দুর্গা মাকে তার কন্যা রূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করে সিদ্ধি লাভ করেন। ভগবতী মা তার এই প্রার্থনা পূরণ করেন। কাত্য এর কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার নাম হয় কাত্যায়নী। ভক্তি সহকারে শুদ্ধচিত্তে দেবীর আরাধনা করলে ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ রূপ ফলপ্রাপ্ত হয়। রোগ-শোক ও ভয় দূরীভূত হয়।

দেবী দুর্গার সপ্তম রূপটি হলো ‘কালরাত্রী’। ঘন অন্ধকার অমানিশার ন্যায় কালো দেবীর বর্ণ। এই দেবী চতুর্ভূজা। ভয়ঙ্কর মূর্তিমতী দেবী হলেও তিনি সব সময় শুভ ফল প্রদান করে থাকেন। সুতরাং দেবীর এই ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে ভক্তদের কোনও ভীত বা আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।

দেবীর এই কালরাত্রী রূপ দুষ্টের বিনাশ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। যারা দেবীর নিকট মনেপ্রাণে কোনো কামনা করেন, দেবী তার আশা পূর্ণ করেন। দেবীর উপসনায় অগ্নি-জল-জন্তু-শত্রু ও রাত্রিভয় থাকে না। সব প্রকার ভয়মুক্ত হয়ে ভক্ত সুখে শান্তিতে জীবন ধারণ করেন।

দুর্গার অষ্টম রূপ হলো 'মহাগৌরী'। দেবাদিদেব শিবকে পাওয়ার জন্য দেবী পার্বতী রূপে কঠোর আরাধনা শুরু করেন। আরাধনার সময় তিনি কালো বর্ণের হয়ে পড়েন। মহাদেব তার এই কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে গঙ্গার পবিত্র জলে স্নান করান, তখন তার শরীর বিদ্যুৎ প্রভার ন্যায় কান্তিমান গৌরবর্ণ ধারণ করে।

এর পর থেকেই তিনি মহাগৌরী নামে অভিহিত হন। তিনি পতিরূপে দেবাদিদেবকে লাভ করেন। দেবীর গাত্রবর্ণ সম্পূর্ণ গৌর। বসন ভূষণও শ্বেতবর্ণের।

দুর্গাপূজার অষ্টম দিনে দেবীর পুজা পাঠ করা হয়। দেবীর আরাধনা ভক্তের জন্য জগতের জন্য কল্যাণকর। দেবীকে মনেপ্রাণে প্রার্থনা করতে পারলে অলৌকিক সিদ্ধিলাভ হয়, ভক্তের সব দৈন্য, পাপ-সন্তাপ দূর হয়। তার পবিত্র ও অগয় পুণ্যের অধিকারী হয়।

দেবী দুর্গার নবম রূপ হলো 'সিদ্ধিদাত্রী'। তিনি সর্বপ্রকার সিদ্ধি প্রদান করে থাকেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণে আট প্রকার সিদ্ধির কথা উল্লেখ আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডে আর ১০ প্রকার অর্থাৎ মোট ১৮ প্রকার সিদ্ধির কথা উল্লিখিত আছে।

মাতা সিদ্ধিদাত্রী ভক্তদের এইসব সিদ্ধি প্রদান করে থাকেন। নবদুর্গার মধ্যে মাতা সিদ্ধিদাত্রী হলেন দেবী দুর্গার অন্তিম রূপ। ভক্তি সহকারে দেবীর আরাধনা করলে ভক্ত সিদ্ধিপ্রাপ্ত হন।