বিদ্যালয়টি এখনও এমপিওভুক্ত হয়নি। ৬০ জনের মত শিক্ষার্থী আছে। তাদের বই-খাতা ও পোশাক স্কুল থেকে দেওয়া হয়।
Published : 01 Apr 2025, 09:34 AM
সাধারণ স্কুলে ছবি আঁকতে শিশুরা যেমন বাড়ি থেকে রং-পেন্সিলের বাক্স নিয়ে যায়; এখানে তেমনটি নয়। বরং প্রকৃতি থেকে পাতা, ফুল, হলুদ সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়েই শিশুরা রং বানায়। তারপর তারা যে পাহাড়ে বাস করে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়- সেই প্রকৃতির ছবিই পরম মমতায় আঁকে।
খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত পাহাড়ের একটি স্কুলে এভাবেই শিশুদের পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে সহশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীরাও আনন্দের সঙ্গে এই পাঠে অভ্যস্ত হয়ে ওঠছে।
মাটিরাঙা উপজেলা সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ভেতরের গ্রাম ওয়াছু। সেখানে মূলত মারমা ও ত্রিপুরাদের বসবাস। সেই গ্রামেই শিশুদের ঝরেপড়া রোধে ছয় বছর আগে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বিন্দু বিদ্যানিকেতন’। এখানে শিশুরা প্রতিদিন বিন্দু বিন্দু করেই প্রকৃতি থেকে শেখে, প্রকৃতিকে রক্ষার শপথ নেয়।
স্থানীয় বাসিন্দা উথোই মার্মা বলছিলেন, ১, ২, ৩ ও ৪ নম্বর রাবার বাগান, কাইলাংশি পাড়া, তৈকুম্বা পাড়া, গণচন্দ্র কারবারি পাড়া, শিশক পাড়া, চিলোক পাড়া, বিল পাড়া, থাংতু পাড়া, হেডম্যান পাড়া ও নতুন পাড়া নিয়ে ওয়াচু এলাকা।
এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না। ফলে শিশুরা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তই পড়াশোনা করতে পারত। অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র। ফলে তাদের পক্ষে দূরের জেলা বা উপজেলা সদরে সন্তানকে রেখে পড়াশোনা করানো সম্ভব হয় না। সামর্থ্য আছে, সন্তানকে বাইরে রেখে পড়ান এমন পরিবারের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা।
২০১৯ সালে মাটিরাঙার বাসিন্দা জাহেদ আহমেদ টুটুল শিশুদের ঝরেপড়া রোধে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। প্রাথমিকভাবে তিনি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিশুদের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন।
স্থানীয় রুইপ্রুচাই মারমা বলেন, “এলাকার ছেলেমেয়েরা প্রাথমিকের পর পড়াশোনা করতে পারত না। টুটুল ভাই এসে প্রথমে গাছতলায় বাচ্চাদের পড়ালেখা শেখাতেন। এরপর তিনি একটা স্কুলঘর বানান। এলাকার সবাই মিলে উনাকে সহযোগিতা করল।
“আগে গ্রামের বাচ্চারা পড়াশোনায় তেমন আগ্রহী ছিল না। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে আসেন। এখন বাচ্চারা এখানে পড়ছে, ভালো রেজাল্ট করছে।”
১ নম্বর রাবারবাগান পাড়ার কারবারি খিলুঅং মারমা বলেন, “টুটুল ভাই এসে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারপর এখানে তিনি স্কুলটি নির্মাণ করেন। যাদের সার্মথ্য রয়েছে তাদের বাচ্চারা হয়তো মাটিরাঙা গিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে পড়াশোনা করত। যাদের সার্মথ্য নাই তারা প্রাথমিকের পরে আর পড়তে পারত না। এখন স্কুল হওয়ায় যারা গরিব তারা পড়তে পারছে।
“স্কুল গড়তে গ্রামের মানুষ এখানে শ্রম দিয়েছে। স্কুল নির্মাণের সময় অনেকে মাটি কেটেছে। কেউ বাঁশ দিছে, কেউ গাছ দিছে। সবার সহযোগিতা পেয়েছে। পাঁচ কিলোমিটার দূরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করানো সম্ভব না। এ কারণে এখানে স্কুল হয়েছে।”
২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় জাহেদ আহমেদ টুটুল মারা যান। তখন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন রাজীব চক্রবর্তী।
তিনি জানান, বিদ্যালয়টি এখনও এমপিওভুক্ত হয়নি। ৬০ জনের মত শিক্ষার্থী আছে। তাদের বই-খাতা ও পোশাক স্কুল থেকে দেওয়া হয়। ফলে খরচের জন্য স্থানীয় মানুষদের উপর নির্ভর করতে হয়।
৩৪ জন শিক্ষানুরাগীর অর্থায়নে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ২০২১ সালে তৎকালীন খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বিদ্যালয়ের তহবিলে দুই লাখ টাকা সহায়তা দেন। তবে এখানে পানি এবং বিদ্যুতের সংকট রয়েছে বলে জানান রাজীব চক্রবর্তী।
সম্প্রতি এক দুপুরে স্কুলটিতে গিয়ে কথা হয় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে। তারা জানান, ২০ শতাংশ জমিতে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বন থেকে সংগ্রহ করা পাতা, ফুল, হলুদ বেটে স্কুলের আঙ্গিনায় টেবিলের উপর রং তৈরি করছে। সেই রং দিয়ে সাদা কাগজের ক্যানভাসে আঁকছে শিক্ষার্থীরা। প্রকৃতির রঙে তাদের ক্যানভাসে ফুটে উঠছে গ্রামীণ বাংলার দৃশ্যপট। প্রতিদিনই চলে এমন কার্যক্রম।
বিদ্যালয়ের চারপাশে রয়েছে অসংখ্য চেনা-অচেনা বৃক্ষ। পাশেই রয়েছে একটি বড় প্রাকৃতিক বন। শিক্ষকরা প্রতিদিনই সেখানকার বৃক্ষরাজি শিক্ষার্থীদের চিনিয়ে দেন। শিক্ষার্থীরা বনের ভেতরে উদ্ভিদ চেনার এই পদ্ধতির নাম ‘প্রকৃতি পাঠ’। এতে শিক্ষার্থীরা উদ্ভিদ রক্ষার গুরুত্ব উপলদ্ধি করতে পারে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিশিতা ত্রিপুরা বলে, “আমাদের শিক্ষকরা পড়াশোনার পাশাপাশি আমাদের চারপাশে যে গাছপালা রয়েছে সেগুলো চেনায়। ছবি আঁকি। নাচ ও গান শেখায়। নাটকের রিহার্সেল করায়। বিদ্যালয় থেকে ড্রেস ও শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয়। কৃষি প্রজেক্ট করায়। এখানে খেলাধুলা ব্যবস্থাও রয়েছে।”
আরেক শিক্ষার্থী অংক্রা মারমা বলেন, “আগে আমাদের এখানে মাধ্যমিক স্কুল ছিল না। ফলে প্রাথমিকের পর কেউ পড়ত না। এখন এখানে পড়তে পারছি।”
বিদ্যালয়টিতে শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন হ্লাথুইচিং মার্মা, হ্লামংচিং মার্মা ও মিনা ত্রিপুরা। তারা জানান, বাচ্চাদের কাগজ-কলম, খাতা-বই, পোশাক সবই বিনামূল্যে দেওয়া হয়। বিদ্যালয়ের প্রাত্যহিক শপথ অনুষ্ঠানেও প্রকৃতি রক্ষার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। এখানে ১০ গ্রামে কোনো নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল ছিল না। এখন স্কুল হওয়াতে শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া রোধ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা পাঠদানের পাশাপাশি সহশিক্ষায় অংশ নিচ্ছে।
বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই যুক্ত রয়েছেন চিকিৎসক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য চিকিৎসক সুশান্ত বড়ুয়া। তিনি বলেন, মূলত পিছিয়ে পরা মানুষের মাঝে আধুনিক শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে জাহেদ আহমেদ টুটুল বিদ্যালয়টি শুরু করেন।
তিনি গ্রামের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ‘পাঠশালা বিন্দু থেকে’ পাঠদান শুরু করেন। এটি বর্তমানে ‘বিন্দু বিদ্যানিকেতন’ নামে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কয়েকজন শিক্ষানুরাগীর সহায়তায় বিদ্যালয়ের আর্থিক ব্যয় বহন করা হয়।
বিদ্যালয়টির এমপিওভুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক রাজীব চক্রবর্তী বলেন, “বিদ্যালয়ের ভূমি সংক্রান্ত কিছুটা জটিলতা রয়েছে। জটিলতা শেষ হলে আমরা এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করব।”
খাগড়াছড়ি মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়ের একাডেমিক সুপারভাইজার শরীফুল ইসলাম বিদ্যুৎ বলেন, “আমি বিদ্যালয়টি কয়েকবার পরিদর্শন করেছি। শিক্ষকরা সেখানকার স্থানীয় নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের দারুণ আন্তরিকভাবে পাঠদান করাচ্ছেন। এরই মধ্যে বিদ্যালয়টি ওই এলাকায় সাড়া ফেলেছে। তারা বছরের শুরুতে আমাদের বইয়ে চাহিদা দেয়। আমরা সেই অনুযায়ী বই সরবরাহ করি।”