‘মুল্লুক চলো’ দিবসকে ‘চা শ্রমিক দিবস’ ঘোষণার দাবি

হবিগঞ্জের চা শ্রমিকরা একইসঙ্গে ২০২৩-২৪ সালের চুক্তি সম্পাদন করে বকেয়া বেতন পরিশোধ ও ভূমির অধিকার নিশ্চিতসহ বিভিন্ন দাবি জানান ।

হবিগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2023, 10:46 AM
Updated : 20 May 2023, 10:46 AM

হবিগঞ্জের চা বাগানগুলোতে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ১০২তম ‘মুল্লুক চলো’ দিবস পালন করেছেন চা-শ্রমিকরা। এসব কর্মসূচিতে দিনটিকে ‘চা-শ্রমিক দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি জানিয়েছেন শ্রমিকরা। 

একই সঙ্গে ২০২৩-২৪ সালের চুক্তি সম্পাদন করে দ্রুত বকেয়া বেতন পরিশোধ ও ভূমির অধিকার নিশ্চিতসহ বিভিন্ন দাবি জানান শ্রমিকরা। 

দিবসটি উপলক্ষে শনিবার সকাল ১০টায় চানপুর চা বাগানে প্রথমেই অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল র‌্যালি। পরে বাগানে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও জাতীয় সংগীত শেষে শুরু হয় আলোচনা সভা। 

পরে বেলা ১২টায় লস্করপুর ভ্যালিতে র‌্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। 

এতে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন- বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল, চানপুর চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি সাধন সাঁওতাল, ইউপি চেয়ারম্যান ওয়াহেদ আলী মাস্টার, বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সমিতির সভাপতি খাইরুন আক্তার, লস্করপুর চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি রজনী কান্ত কালিন্দী প্রমুখ। 

সভায় নৃপেন পাল বলেন, “আজকের এই দিনটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দাবি আদায় করতে গিয়ে আমাদের বহু শ্রমিক ভাই-বোন প্রাণ দিয়েছেন। তাই আজকের এই দিনটিকে ‘চা শ্রমিক দিবস’ ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি জানাই।” 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনী ছড়ায় যখন প্রথম চায়ের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় তারপর থেকেই আসাম অঞ্চলে (সিলেট তখন আসামের অংশ) চা-শিল্পের ব্যাপক বিস্তার লাভ করতে থাকে। তবে শ্রমঘন চা-শিল্পের বিস্তারের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় শ্রমিক সংকট। 

এ জন্যে ব্রিটিশরা চা-শ্রমিকের জন্য আসামের বাইরে হাত বাড়ায়। মূলত বিহারের ছোট নাগপুর, উড়িষ্যা, অন্ধ প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ থেকে এই শ্রমিকদের সংগ্রহ করা হত। শ্রমিক সংগ্রহকারীরা দারিদ্রপীড়িত এলাকার মানুষকে এক সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে জাহাজে তুলে নিতো। 

কিন্তু যে জাহাজে ২০০ জনের ধারণ ক্ষমতা সেখানে তোলা হতো ১০০০ জনকে। পথ কাটত ক্ষুধা আর যন্ত্রণায়। জাহাজ যখন ঘাটে ভিড়ে তখন লাশ এবং জীবন্ত মানুষের সংখ্যা থাকত সমান। 

এরপর শ্রমিকদের প্রাথমিক কাজ ছিল হিংস্র পশু-পাখি আর পোকামাকড়ে ভরা আসামের বিস্তীর্ণ জঙ্গল পরিষ্কার করে চা বাগানের উপযোগী করা। আর তাতেও বেঘোরে মারা পড়তেন বহু শ্রমিক। 

একদিকে ভয়ংকর জঙ্গল, হিংস্র জন্তু-জানোয়ার, অর্ধাহার, অনাহার, রোগ-শোক অন্যদিকে চা বাগানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ইংরেজদের অমানবিক আচরণ-নির্যাতন। দ্রুতই এইসব অসহায় মানুষদের স্বপ্ন ফিকে হয়ে যেতে থাকে। তারা গণহারে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে থাকেন। 

এক হিসেবে দেখা যায়, প্রথম তিন বছরে যে ৮৪ হাজার ৯১৫ জন আসামে শ্রমিককে আমদানি করা হয়েছিল তার মধ্যে ৩১ হাজার ৮৭৬ জন এভাবেই মারা যান। 

এরপর ইংরেজদের বিরুদ্ধে যখন ভারতবর্ষে স্বদেশী আন্দোলন চলছিল তখন এর ঢেউ চা বাগানগুলোতেও পড়ে। চা-শ্রমিকরাও ধীরে ধীরে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে থাকেন, অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করেন। 

এর ধারাবাহিকতায় তাদের নেতা পণ্ডিত দেওশরন এবং গঙ্গা দীতির নেতৃত্বে ১৯২১ সালে তারা স্বভূমিতে ফিরতে ‘মুল্লুক চলো’ বা ‘দেশে চলো’ কর্মসূচির ডাক দেন। 

এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন চা বাগান থেকে বের হয়ে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক সিলেট রেলস্টেশনে এসে জড়ো হন। তাদের ঠেকাতে না পেরে ব্রিটিশ সরকার রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু দেশে ফিরতে মরিয়া শ্রমিকরা রেল পথ ধরে হেঁটে ২০ মে চাঁদপুর স্টিমার ঘাটে পৌছায়। 

কিন্তু সেখানে দীর্ঘ পথ হেঁটে ক্লান্ত, শ্রান্ত এই শ্রমিকদের ওপর নির্বিচার গুলি চালায় ব্রিটিশ সরকারের গুর্খা রেজিমেন্টের সৈন্যরা। গুলিতে ও বেয়নেট চার্জে হত্যা করা হয় শতশত শ্রমিককে। ঐদিন কত মানুষ নিহত হয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান কখনও জানা যায়নি। 

তারপর থেকেই ২০ মে কে চা-শ্রমিকরা ‘চা-শ্রমিক দিবস’ বা ‘মুল্লুক চলো দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন।